মোতাহার হোসেন

  ২৩ জানুয়ারি, ২০২২

পর্যবেক্ষণ

বিজয়ের অর্ধশতবর্ষে শতভাগ বিদ্যুৎ

স্বাধীন বাংলাদেশ ৩০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ নিয়ে যাত্রা শুরু করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রামীণ জনপদে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু বিদ্যুৎ খাতের ভিত্তি রচনার পাশাপাশি ব্রিটিশ গ্যাস কোম্পানির কাছ থেকে সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন পাউন্ডে পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কিনে নেন, যা দেশের জ্বালানির মূল চাহিদা মেটাতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদ্যুৎ খাত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। এর ফলে গত এক যুগে বিদ্যুৎ খাতের যুগান্তকারী উন্নয়ন হয়েছে। ২০০৯ সালে ৪৬ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত। এখন দেশে ৯৯ শতাংশের বেশি মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। এখন দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন এবং বিতরণ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। দেশের প্রতিটি ঘরে শতভাগ বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে ১১ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার অবিশ্বাস্য ও স্বপ্ন মনে হলেও নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিজয়ের মাস গত ডিসেম্বরে মুজিববর্ষের মধ্যেই শতভাগ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের ফলেই মাত্র ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে বড় বিপ্লব ঘটেছে।

বর্তমানে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশই আসে বেসরকারি খাত থেকে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হওয়ায় লোডশেডিং শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। নির্ধারিত সময়ের আগে এই শতভাগ বিদ্যুতের লক্ষ্য পূরণে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতাও ছিল। এর মধ্যে প্রত্যন্ত চরাঞ্চল ও পাহাড়ি অঞ্চলে বিদ্যুতের লাইন নেওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আবার মানুষ নিজের গ্রাম, আদিনিবাস ছেড়ে ‘মাঠে-প্রান্তরে’ কিংবা নতুন সড়কের পাশে বাড়িঘর তৈরি করছে। ফলে বিদ্যুতের বর্ধিত চাহিদা জোগান দেওয়ার পাশাপাশি সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন স্থাপনসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিদ্যুৎ বিভাগকে এগোতে হয়েছে এবং সাফল্যের দৃষ্টান্ত রেখেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্য ছিল ২৭টি। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৩৭টি। মাত্র ১২ বছরেই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ১১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছে। ২০০৯ সালে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে উৎপাদন সক্ষমতা ২৪ হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াট। ১২ বছর আগে দেশে বিদ্যুৎ গ্রাহক ছিল এক কোটি আট লাখ। বর্তমানে বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। সঞ্চালন লাইন ছিল আট হাজার সার্কিট কিলোমিটার, সেটা এখন প্রায় ১৪ হাজার সার্কিট কিলোমিটার। গ্রিড সাবস্টেশন ছিল ১৫ হাজার ৮৭০ এমভিএ, তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার এমবিএ। ২০০৯ সালে বিতরণ লাইন ছিল দুই লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার। এখন তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৬ লাখ কিলোমিটারের কিছু বেশি। ১২ বছর আগে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ২২০ কিলোওয়াট ঘণ্টা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩০ কিলোওয়াট ঘণ্টায়। এখন বিতরণ লস ৯.৩৫ শতাংশ।

বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জ্বালানি সংকটের কারণে ২০০৯ সালের আগে বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্থবিরতা দেখা দেয়। পরিস্থিতির উত্তরণে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার মিশ্র ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্যাসের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়। তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নির্মাণের পাশাপাশি কয়লা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং সৌর, বায়ু, বায়োগ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে উদ্যোগ নেয়। ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার। দ্রুততম সময়ে চাহিদা ও উৎপাদনের ভারসাম্য রক্ষায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে বড় আকারের সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়। এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীও এগিয়ে আসছে।

সরকারের ধারাবাহিকতার ফলে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকায় স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এলএনজি আমদানি হচ্ছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বিদ্যুৎ খাত ছিল চরম অস্থিতিশীল। ওই সময় চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন খুবই কম থাকায় দিন-রাত লোডশেডিং লেগেই থাকত। বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ায় এ খাতে স্বস্তি ফিরে আসে। এরপর সরকার মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়নে মনোযোগ দেয়। বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে মিশ্র জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দিয়ে তেল-গ্যাসের পাশাপাশি কয়লা এবং এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে।

বর্তমানে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি হওয়ার কারণে লোডশেডিং হওয়ার সুযোগ নেই। মূলত লোডশেডিং হলো বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি থাকলে একদিকে সংযোগ দিয়ে অন্যদিকে সংযোগ বন্ধ রাখা। উৎপাদন বেশি থাকায় সে অবস্থা আর নেই। তারপরও মাঝে মধ্যে লোডশেডিং হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘বর্তমানে দুটি বিষয়ের জন্য লোডশেডিং দেখা দেয়। একটি হলো, এখন সারা দেশে বিদ্যুৎ উন্নয়নে প্রচুর কাজ হচ্ছে। উন্নয়ন কাজের জন্য বিদ্যুৎসংযোগ বন্ধ করতে হয়। সে কারণে কোনো একটি লাইনে কাজ হলে সেটাকে বন্ধ রাখলে ওই এলাকায় তখন বিদ্যুৎ থাকে না। দ্বিতীয় কারণ হলো, উৎপাদন ও গ্রাহক বাড়ছে কিন্তু ট্রান্সফিউশন ডিস্ট্রিবিউশন শতভাগ নিশ্চিত করা যায়নি। সে কারণে কিছু জায়গায় সমস্যা হচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত করে কাজ করা হচ্ছে। অবশ্য এখন এ সমস্যা নেই।’

দেশে প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে ঢাকায় বিংশ শতকের প্রথম বছর। আর এর সব আর্থিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন ঢাকার নবাব আহসানউল্লাহ। ৭ ডিসেম্বর, ১৯০১ সালে ঢাকার রাস্তায় বিদ্যুতের বাতি জ্বলে ওঠে। এর আগে ১৯০১ সালের জুলাই মাসে ঢাকা পৌরসভা কর্তৃক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানানো হয়, সব রাস্তায় ও এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। পৌরসভার অধীনে বিদ্যুৎব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ‘দি ঢাকা ইলেকট্রিক ট্রাস্টি’ নামে পরিষদ গঠন করা হয়। পাকিস্তান সরকার দেড় বিলিয়ন ডলারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। কিন্তু তখন দেশে মাত্র ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা ছিল। পশ্চিমা সরকার পূর্ব পাকিস্তানের দিকে নজর দেয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু রাশিয়ার সহায়তা নিয়ে দেশে নতুন করে বিদ্যুৎ খাত পুনর্গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশ পিছিয়ে যায়। তখন দেশে বিদ্যুতের সিস্টেমলস বেশি থাকায় দাতারা দেশের বিদ্যুৎ খাতে অর্থ দিতে চাননি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আইপিপি নীতি গ্রহণ করে। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বার্জ মাউন্টেন্ড বিদ্যুৎ নিয়ে আসেন। এ সময়ে ক্যাপটিভ নীতি করে শিল্পে বিদ্যুৎ দেওয়া হয়। এরপর, ২০০৯ সালে আবার বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তখন থেকে প্রয়োজনীয় নীতির পরিবর্তন করে সরকার বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার করে।

শতভাগ বিদ্যুতায়নের পর সাশ্রয়ী এবং মানসম্মত সরবরাহ এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সারা বিশ্বেই পরিবর্তন এসেছে। বিদ্যুৎ সেক্টরকেও পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভঙ্গুর বিদ্যুৎ খাতের পুনর্গঠনে মনোযোগ দেয়। তখন সরকার বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। এরপর ২০০০ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ খাতকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। ফলে সব দিক থেকে দেশ পিছিয়ে যায়। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা তার নির্বাচনী ইশতেহারে ২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। তখন ব্যাপক আর্থিক সংকট থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার সাহসী উদ্যোগে দুই থেকে তিন বছরে দেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সরকারের সময়োপযোগী উদ্যোগই বিদ্যুৎ খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। ভবিষ্যৎ চাহিদা মাথায় রেখে সরকার পায়রা, মাতারবাড়ি, রূপপুর, রামপালে মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এছাড়া, জ্বালানি খাতে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল, ঢাকাণ্ডচট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ-হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর এবং বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে তেল সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। রামপালে মৈত্রী সুপার থার্মাল প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বিদ্যুতের এ সব অর্জন মূলত পিতার জন্মশতবর্ষ এবং বিজয়ের ৫০ বর্ষে জাতিকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহারও বটে। প্রত্যাশা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিদ্যমান অর্জনকে টেকসই করা হবে। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণের চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নেও বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখাটাই জরুরি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close