আবুজার গিফারী

  ২২ জানুয়ারি, ২০২২

পর্যবেক্ষণ

প্ররোচনায় আত্মহত্যা প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

ইমন ও নাজমা ভালো বন্ধু। বন্ধুত্বের সম্পর্ক শেষপর্যায়ে প্রেমে রূপ নেয়। অনার্স প্রথম বর্ষ থেকে তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম, যখন তারা অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। সম্পর্কের শুরুতে দুজনের মধ্যে বোঝাবুঝি ছিল বেশ। তবে মাস্টার্স পর্বে দুজনের মধ্যে ছোটখাটো জেরে প্রায়ই মনোমালিন্য দেখা যেত। বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক সব মিলিয়ে তারা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত ছয় বছর। সম্পর্ক দীর্ঘদিন হওয়ার দরুন একে-অপরের প্রতি দুজনে প্রবল আসক্ত। তাদের সিদ্ধান্ত দুজনের যেকোনো একজন চাকরি পেলে তারা বিয়ের পীড়িতে বসবে। ইমনের বাবা-মায়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হয় নাজমার। এভাবে দুজনের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়। ফলে নাজমা একসময় ইমনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। শুরুর দিকে অনিয়মিত হলেও পরে সেটা নিয়মিত চলতে থাকে। কিছুদিন হলো ইমন চাকরি পেয়েছে। ইমন নাজমার প্রতি এখন আগের মতো আসক্ত নয়। এমনকি নাজমার ফোন সে প্রায়ই রিসিভ করে না। নাজমা এক দিন খবর পায়, ইমন পাশের গ্রামের আজাদ চেয়ারম্যানের একমাত্র মেয়ে অনুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। এটা শুনে নাজমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ইমনের বাড়িতে যোগাযোগ করলেও ইমনের বাবা-মায়ের পক্ষ থেকে সন্তোষজনক কোনো উত্তর সে পায়নি। নাজমা এখন নিজেকে তিলে তিলে উপলব্ধি করছে। এমনকি সে সারাক্ষণ অনুশোচনা ও হতাশায় ডুবে থাকে। হঠাৎ এক দিন চিরকুট লিখে সে আত্মহত্যা করে। চিরকুটে লেখা- ‘আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী ইমন’।

আত্মহত্যা একটি সামাজিক ব্যাধি। সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত আত্মহত্যার প্রবণতা উপস্থিত। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায় তৎকালীন সময়ে প্রাচীন এথেন্সে সরকারের অনুমতিক্রমে আত্মহত্যা বৈধ ছিল। তবে প্রাচীন এথেন্সে যদি কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের অনুমোদন ব্যতিরেকে আত্মহত্যা করত তাহলে তাকে সাধারণ কবরস্থানের সম্মান দেওয়াকে অস্বীকার করা হতো। তাকে কবরস্থ করা হতো শহরের বাইরে অবস্থিত কোনো জায়গায় একা। শুধু তাণ্ডই নয় তার জন্য কোনো স্মৃতিফলকও ব্যবহার করতে দেওয়া হতো না। সাধারণ অর্থে- ব্যক্তি কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়াবিশেষ হলো আত্মহত্যা। লাতিন ভাষায় ‘সুই সেইডেয়ার’ থেকে আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে। যার অর্থ- নিজেকে হত্যা করা। সম্প্রতি একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। যার মধ্যে নারী-পুরুষ-শিশু সব বয়সের মানুষ রয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করে ২১ থেকে ৩০ বছরের নারী। আর প্রতি বছর দেশে কমপক্ষে ১৩ হাজার থেকে ৬৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। গত এক যুগে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে আত্মহত্যায় মৃত্যুহার প্রতি লাখ মানুষে কমপক্ষে ৭.৮ থেকে ৩৯.৬ জন। করোনা মহামারিকালীন এক বছরে সারা দেশে ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে।

আত্মহত্যার নেপথ্যে স্বভাবতই যে চিত্রটি মানসপটে ভেসে আসে তা হলো- যৌতুক, বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ, প্ররোচনা, মানসিক চাপ, হতাশা, প্রেমে ব্যর্থতা, চাহিদা এবং আকাক্সক্ষার মধ্যে ফারাক, নেতিবাচক চিন্তা, জীবনের উদ্দেশ্যহীনতায় হীনম্মন্যতা, আস্থাহীনতা ইত্যাদি। দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারানুযায়ী আত্মহত্যার চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ধারানুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে কিংবা অনুরূপ অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করে, তবে সে নিজেকে ধ্বংস করার অপচেষ্টার অপরাধে ১ বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ডে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। তবে ওই ব্যক্তি আত্মহত্যার মাধ্যমে মারা গেলে সংশ্লিষ্ট ধারা প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ আত্মহত্যা সংঘটনের চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ তবে সংঘটন হলে শাস্তির পরিধিমুক্ত। কেননা মৃত ব্যক্তির শাস্তি কার্যকর করা সম্ভব নয়। সম্প্রতি একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় দশ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য মতে প্রতি বছর সারা বিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম।

‘সুইসাইড নোট’ বর্তমান সময়ে একটি আলোচিত বিষয়। যখন কোনো ব্যক্তি তার মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুর কারণসংবলিত কোনো বক্তব্য লিখে যায়, তখন ওই বক্তব্য সংশ্লিষ্ট পেপারকে বলা হয় সুইসাইড নোট। ‘সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২’-এর ৩২ ধারানুযায়ী সুইসাইড নোট প্রাসঙ্গিক সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে। তবে শুধু একটি সুইসাইড নোটের ভিত্তিতে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। যখন ওই সুইসাইড নোটের সমর্থনে অপরাপর সাক্ষ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে কারো বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবে, তখনই শাস্তি দেওয়া যাবে। প্রেম চলাকালীন শারীরিক সম্পর্ক অতঃপর বিয়ে না করার দরুন আত্মহত্যা। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ কি না? এ সংশ্লিষ্ট আইন বাংলাদেশে কার্যকর নেই। অর্থাৎ জনমনে অভিযুক্ত ব্যক্তি এ প্রেক্ষিতে আইনের চোখে অপরাধী বলে বিবেচিত হবে না। যদিও সে সমাজের চোখে খুবই ঘৃণিত বা অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে এমন অপরাধ সংশ্লিষ্ট দুটি ধারা প্রচলিত আইনে লক্ষ করা যায়। যদিও ধারা দুটি এমন ঘটনাকে সরাসরি ডিফেন্স করবে না এটা সত্য, তবু পাঠকদের সুবিধার্থে জানানো প্রয়োজন।

প্রথমত, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ৯ক ধারাতে উল্লেখ আছে, কোনো নারীর সম্মতি ছাড়া বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত কোনো কার্য দ্বারা সম্ভ্রমহানি হওয়ার প্রত্যক্ষ কারণে কোনো নারী আত্মহত্যা করলে, ওই ব্যক্তি ওই নারীকে অনুরূপ কার্য দ্বারা আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করার অপরাধে অপরাধী হবেন। এরূপ অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ১০ বছর এবং সর্বনিম্ন ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। এ ছাড়া অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। অর্থাৎ এ ধারানুসারে ছেলেকে অভিযুক্ত করতে হলে মেয়েপক্ষকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে, মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছেলে সম্ভ্রমহানি ঘটিয়েছে। সংশ্লিষ্ট ধারানুসারে আমরা বলতে পারি, নাজমার পরিবার কার্যত এ ধারার অধীনে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারবে না। কেননা নাজমা ও ইমনের শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল তাদের দুজনের স্বাধীন ইচ্ছায়। কোনোপ্রকার জোরজবরদস্তি সেখানে ছিল না। দ্বিতীয়ত, দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারায় উল্লেখ আছে, কোনো ব্যক্তি যদি আত্মহত্যা করে, তবে যে ব্যক্তি আত্মহত্যায় সহায়তা বা প্ররোচনা দান করবে, ওই ব্যক্তি ১০ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। এ ছাড়া তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে। অত্র ধারানুযায়ী নাজমার পরিবার মামলার প্রাথমিক পর্যায়ে যদিও কিছুটা সুবিধা পেতে পারে তবু মামলার শেষপর্যায়ে সেটা কতটা টিকে থাকবে তা অনেকাংশেই প্রশ্নবিদ্ধ।

মোদ্দাকথা, ছেলে ও মেয়ে (উভয়ের সম্মতিতে) শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হলে এবং পরে এটা নিয়ে কোনো বিরোধ উত্থাপিত হলে মামলা-মোকদ্দমার মাধ্যমে কতটুকু অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে সেটার পরিবেশ আজ অবধি ঘোলাটে। তা ছাড়া উচ্চ আদালত বা নিম্ন আদালতে এ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মেয়ের পক্ষে রায় হয়েছে এমন রায় বা নজির এর আগে দেখা যায়নি। তবে যদি এ সংশ্লিষ্ট কোনো নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা যায় অথবা বর্তমানে প্রচলিত কোনো আইন সংশোধন করে এ সংশ্লিষ্ট ধারা সংযোজন করা যায়, তাহলে হয়তোবা নাজমার পরিবার আইনি সুযোগ পেতে পারে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক কোনো ছেলে বা মেয়ে যদি একে-অপরের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়, তাহলে সেটি অপরাধ নয়। তবে এ ক্ষেত্রে মেয়েকে অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্ক তথা ১৮ বছর বয়স হতে হবে। কেননা ১৮ বছরের কম বয়সের কোনো মেয়ের সম্মতি নিয়ে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হলে সেটি ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে। এখানে সম্মতি থাক বা না থাক সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। অর্থাৎ ধর্ষণ প্রমাণের ক্ষেত্রে মেয়ের বয়স ও সম্মতি প্রমাণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

কার্যত ছেলেমেয়ের সম্পর্ক চলাকালীন পরবর্তী সময়ে ছেলে যদি মেয়েকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে তাহলে মেয়ের পরিবার কিংবা স্বয়ং মেয়ে ছেলেকে বিয়ের জন্য বাধ্য করতে পারে না। কেননা বিয়ে একটা ব্যক্তিগত গুণাবলি সম্পর্কিত বিষয়। আইনের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত গুণাবলি সুনির্দিষ্টভাবে কার্যসম্পাদন করা যায় না তথা একে-অপরকে সংশ্লিষ্ট কাজটি সম্পাদন করতে বাধ্য করা যায় না। তবে এমন ঘটনা সংঘটিত হলে সাধারণত প্রতারণা বা জোরপূর্বক ধর্ষণ বা বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ হয়েছে বলে আদালতে মামলা করা হয়। অর্থাৎ মামলাটি গুরুত্ববহ করার জন্য কিছু সংশ্লিষ্ট অপ্রাসঙ্গিক বা মিথ্যা ঘটনা মামলার FIR (First Information Report) এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যদিও মেয়েপক্ষের আইনজীবী এ ক্ষেত্রে মেয়ের পরিবারকে মামলার রায় তাদের পক্ষে আসার কথা শুনিয়ে সাহস দেন। কার্যত তিনিও জানেন মামলাটি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে না কিংবা বড়জোর ছেলে হয়রানির শিকার হতে পারে বা কয়েক বছর তাকে কারাবন্দি থাকতে হতে পারে। কারণ এ সংশ্লিষ্ট মামলায় দিনশেষে ছেলে জামিন পায়। কেননা আদালত একপর্যায়ে সন্তুষ্ট হয় যে, শারীরিক সম্পর্কের সময় দুজনের স্বাধীন সম্মতি ছিল। তা ছাড়া বিয়ে একটি সামাজিক চুক্তি ও ব্যক্তিগত গুণাবলির অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং ছেলে মেয়েকে বিয়ে না করার দরুন অপরাধী হিসেবে পরিগণিত হবে না।

মুসলিম আইনে কোনো অবিবাহিত ছেলে মেয়ে যদি শারীরিক সম্পর্ক (ব্যভিচার) করে তাহলে তাদের উভয়কে ১০০টি বেত্রাঘাত ভোগ করতে হবে। অন্যদিকে বিবাহিত পুরুষ ও মহিলা যদি এরূপ কাজ করে তাহলে তাদের প্রকাশ্যে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে উভয়ের সম্মতি থাকলেও এরূপ বিধান কার্যকর হবে। বাংলাদেশে পারিবারিক কিছু বিষয় ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে মুসলিম আইন প্রযোজ্য নয়। তবে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে একে-অপরের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক ও পরে বিয়ে না করার দরুন কোনো পক্ষের (ছেলে/মেয়ে) আত্মহত্যা, এটি শাস্তিমূলক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রয়োজনে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করে বা অন্য কোনো আইন সংশোধন করে এটি কার্যকর বিচার বিভাগের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত বলে গৃহীত হতে পারে। সর্বোপরি আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। বরং আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে একটি পরিবার মুহূর্তেই তছনছ হয়ে যায়। এরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ছেলে বা মেয়ে উভয়কে মানানসই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। বিশেষ করে মেয়েরা তাদের আবেগ সংবরণ করে মানসিকভাবে শক্ত হয়ে তাদের স্বকীয়তার প্রমাণ দেবে বলেই আশা রাখি।

লেখক : শিক্ষানবিস আইনজীবী, ঢাকা জজকোর্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close