নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার

  ২০ জানুয়ারি, ২০২২

দৃষ্টিপাত

বিদেশে নারীশ্রমিক পাঠাতে সতর্কতা জরুরি

বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নতরাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার জন্য যে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে, এ কথা না মানার কোনো সুযোগ নেই। এরই মধ্যে এ দেশের অর্থনৈতিক খাতকে শক্তিশালী করতে যে কটি খাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে তার মধ্যে অন্যতম প্রবাসী আয়। যে খাতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও এগিয়ে এসেছেন। ফলে যেমন কমছে বেকারত্ব, তেমনি অর্জিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। অভাবের সংসারে আলো জ্বালানোর লক্ষ্যে প্রতি বছরই বিপুলসংখ্যক শ্রমিক রোজগারের সন্ধানে পাড়ি জমাচ্ছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এর মধ্যে অন্যতম বাজার হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। প্রতিনিয়তই অর্থ আসছে এসব দেশ থেকে। দেশে চলতি অর্থবছরে (জুলাই-নভেম্বর) পর্যন্ত ব্যাংকিং চ্যানেলে এসেছে ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকেই এসেছে এ অর্থের ৫৪ দশমিক ২৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে প্রবাসী আয় পাঠানোর শীর্ষে থাকা ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কুয়েত, আরব আমিরাত, কাতার, মালয়েশিয়া, ওমান, ইতালি ও বাহরাইন। এ দশটি দেশের মধ্যে ৬টি মধ্যপ্রাচ্যের।

এসব দেশে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারের আরো গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। একদিকে যেমন শ্রমবাজার ধরে রাখতে হবে, অন্যদিকে শ্রমিকদের সুবিধা-অসুবিধার কথাগুলোও বিশেষভাবে বিবেচনায় আনতে হবে সরকারকে। একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশায় সহায় সম্বল বিক্রি করে বিদেশের টাকা জোগাড় করতে দেখা যাচ্ছে অনেককেই। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব রিক্রুট এজেন্সির (বায়রা) তথ্য মতে, বর্তমানে প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি নারীশ্রমিক বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। প্রতি মাসে তারা প্রায় ৭৫০ থেকে ৮০০ কোটি টাকার মতো আয় করছেন। যেহেতু এদের বেশির ভাগই গৃহকর্মী, তাই তাদের টাকা পাঠানোর হারটাও বেশি। সম্প্রতি যে বিষয়টি বিশেষভাবে নজরে এসেছে তা হলো মধ্যপ্রাচ্যের নারীশ্রমিক। তথ্য বলছে, গত ৫ বছরে এ দেশ থেকে সৌদি আরব গেছে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৫৭৪ জন শ্রমিক। কিন্তু এসব শ্রমিক সেখানে যাওয়ার পর তাদের দিনবদলের পরিবর্তে কী ঘটছে তা দেখার দায়িত্ব এ দেশের সরকারের। কারণ বেশির ভাগ পরিবারই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এদের সঙ্গে শারীরিক-মানসিক নিপীড়ন-নির্যাতন করা হচ্ছে কি না- এ সমন্ধে খোঁজখবর নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো- এ সময়ের মধ্যে ১৯৮ জন নারী লাশ হয়ে ফিরেছেন। কিন্তু কাজের সন্ধানে গিয়ে কেন এ লাশ হয়ে ফিরে আসা? এমনকি অনেক নারীশ্রমিক গর্ভে সন্তান নিয়ে দেশে ফিরে আসছেন বলেও জানা যায়।

বিদেশে নারীকর্মীরা আপদকালীন সেবা পেতে নেই কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ও প্রশিক্ষণ। পাচ্ছেন না কোনো আইনি আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ। এসব বাস্তবতায় নারীশ্রমিকদের বিদেশ পাঠানো দিন দিন ভয়ানক হয়ে উঠছে। বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী গত ৫ বছরে সৌদি আরব থেকেই ফিরে এসেছে প্রায় ২৪ হাজার নারীশ্রমিক। সরকারের পক্ষ থেকে এ হিসাবটা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। সমস্যাটা হলো যারা ফিরে এসেছেন তারা কেউ স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসেননি। বিভিন্ন নির্যাতনের স্বীকার হয়ে ফিরে এসেছেন আশার অপমৃত্যু নিয়ে। বিদেশ থেকে ফিরে এসে অর্থনৈতিকভাবে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তার চেয়ে বেশি হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন সামাজিকভাবে। আর শারীরিক ক্ষতিগ্রস্ততা তো রয়েছেই। ফিরে আসা নারীশ্রমিকদের ভাষ্য মতে, শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনসহ চুক্তি অনুযায়ী বেতন না পাওয়া, নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি কাজ করানোর মতো অভিযোগ রয়েছে। গত বছর প্রকাশিত রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্স ইফনিটের (রামরু) সমীক্ষা মতে, পরিবারের ভাগ্য বদলাতে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে কর্মস্থলে ৩৫ শতাংশ নারীকর্মী শারীরিকভাবে, ৫২ শতাংশ মানসিকভাবে এবং ১১ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

বেশির ভাগই নারীকর্মী তাদের ওপর অত্যাচারের কাহিনি প্রকাশ করতে চান না। কারণ দেশে ফিরে আসার পর সামাজিকভাবে হেনস্তা হওয়ার ভয় থাকে। ১৯৯১ সাল থেকে সৌদি আরবে নারীশ্রমিকদের যাওয়া শুরু হলেও ব্যাপকভাবে যাওয়া শুরু হয় ২০১৫ সাল থেকে। কারণ সৌদি সরকারের অনুরোধে সেখানে নারীকর্মী পাঠানোর বিষয়ে ২০১৫ সালে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। ওই সময় বেশ কটি দেশ নির্যাতনের কারণে তাদের দেশ থেকে নারীশ্রমিক সৌদিতে পাঠানো বন্ধ করে দেয়। হয়তো সৌদি সরকারের চাপের ফলে বাংলাদেশ সরকার সম্মতি দেয় দেশের স্বার্থে। যেহেতু আমরাও প্রচুর পরিমাণে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছি না সে কারণে বিদেশে শ্রমিক পাঠানো আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। শ্রমিক যেহেতু পাঠাতে হবে তাই তাদের ভালোমন্দের দিকটায় বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে সরকারের পক্ষ থেকে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যেসব দেশে নারীশ্রমিক পাঠানো হচ্ছে, সেসব দেশে আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সঠিকভাবে এই শ্রমিকদের দেখাশোনা করতে পারছেন না বিভিন্ন কারণে। যার ফলে এসব শ্রমিক বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। যেসব শর্তে এসব নারীকে বিদেশ পাঠানো হচ্ছে তাদের সেসব শর্ত সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না, তা দেখার ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আমাদের মিশনগুলোকে আরো কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। যেসব নারীশ্রমিক বিদেশে যাচ্ছেন, তাদের শিক্ষা কম থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই প্রতারণার ফাঁদে পড়ছেন। বেশির ভাগ শ্রমিকই যাচ্ছেন গ্রামের দালালদের মাধ্যমে। যারা যাচ্ছেন তারা জানেনও না তাদের কাজ কী হবে? বেতন সম্পর্কে দেওয়া হয় মিথ্যা তথ্য। যার ফলে বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। সমস্যাটা হলো যারা এই নারীদের বিদেশে বিভিন্ন প্রলোভন দিয়ে পাঠাচ্ছে, তারা অপরাধ করেও থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সরকারের পক্ষ থেকে সঠিকভাবে এদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। এমনকি যারা নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরেছেন তাদের নির্বাসনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যেসব এজেন্ট বাংলাদেশ থেকে শ্রমিকদের বিদেশ পাঠাচ্ছে, তাদের সঠিকভাবে বিধিনিষেধ মানতে বাধ্য করাতে পারছে না সরকার।

এ ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে সচেতনতার অভাব। সবচেয়ে ঝামেলা হলো যারা গ্রামগঞ্জে এসব লোক সংগ্রহ করে থাকে, তাদের নেই কোনো এজেন্ট আইডি এবং লেনদেনেরও সঠিক কোনো পদ্ধতি বা নিয়ম নেই। যার ফলে অনেক দালাল অবৈধভাবে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ফলে লেনদেনের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রেই তৈরি হচ্ছে ঝামেলা। আমাদের মনে রাখতে হবে নারীশ্রমিকদের বিদেশ পাঠানো হচ্ছে এবং যেসব কারণে ফিরে আসছে তা অত্যন্ত খারাপ নজির। এর ফলে পুরুষশ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রেও নতুন করে প্রভাব পড়তে পারে। জিটুজি পদ্ধতিতে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রেও চলে এজেন্টদের বিরোধিতা। এসব কারণে তৈরি হয় সিন্ডিকেট এবং নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তাদের হাতে। যেখানে যে পদ্ধতিতে লোক পাঠানো ভালো হয় সে পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে সরকারকে। সম্প্রতি মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারের একটি চুক্তি হয়েছে, এটাকে কেন্দ্র করে দালালরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যার ফলে প্রতারণার শিকার হয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে বড় কথা- আমাদের এই বড় খাতটির দিকে যথেষ্ট পরিমাণ নজর দেওয়া প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক শ্রমিকবান্ধব আইন তৈরি করে যথাযথ প্রয়োগ ঘটানো প্রয়োজন। আর সবচেয়ে বেশি যে দিকটায় আরো তদারকির প্রয়োজন, তা হলো বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠানো। তাহলে আয় যেমন বাড়বে, তেমনি বৃদ্ধি পাবে শ্রমিকের চাহিদা। তাহলে এ দেশের শ্রমিকরা তাদের দক্ষতা দিয়ে বিশে^র বিভিন্ন দেশে জায়গা করে নিতে পারবেন, এতে করে বিভিন্ন নির্যাতন বন্ধেও একটা প্রভাব পড়বে। মোটকথা, সরকারকে শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে।

লেখক : শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close