সাদিয়া আফরিন
মতামত
নারী ফুটবল দল এবং বাঙালির রক্ষণশীলতা
বছর শেষে অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল দল দারুণ এক বিজয়ের খবর দিয়েছে বাংলাদেশকে। সাফ গেমসে প্রতিপক্ষ ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশ দল বিজয়ী হয়েছে। মাঠভর্তি দর্শক এ খেলা দেখেছে। মাঠ ও মাঠের বাইরে সবাই দলটিকে অভিনন্দন জানিয়েছে। বহুদিন পর ক্রীড়াজগতে সাফল্যের এ খবরে বাংলাদেশের মানুষ আপ্লুত। ফুটবল তথা ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের বেতন-বৈষম্য নিয়ে কথা বলেছে। চেয়েছে নারী খেলোয়াড় হিসেবে অন্যান্য সমগোত্রীয় দলের সমান মর্যাদা। লক্ষণীয়, এখন পর্যন্ত নারীদের এই ফুটবল দলে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মেয়েদেরই প্রাধান্য অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত কম সচ্ছল, দারিদ্র্যপীড়িত পরিবার থেকে উঠে আসা, বিশেষ করে আদিবাসী মেয়েরা। মেয়েদের খেলাধুলাকেন্দ্রিক বিভিন্ন তথ্য থেকে দেখা গেছে, জাতীয়পর্যায়ে যেসব মেয়ে খেলতে আসে, তাদের ৮৩ শতাংশই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এবং তাদের খেলাধুলার জগতে পা রাখার অন্যতম কারণ হলো খেলাধুলার দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে পরিবারের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনা।
বাংলাদেশের টেবিল টেনিসের রানি জোবেরা রহমান লীনু এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা খেলাধুলায় এসে পাঁচণ্ডছয় হাজার টাকা যা পায়, সেই প্রাইজমানি পরিবারের হাতে তুলে দেওয়াই তাদের কাছে বড় সুযোগ বলে মনে করে। তবে এ টাকা সচ্ছল পরিবারের কাছে তেমন কোনো মূল্য বহন করে না বলে তারা খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী হয় না। যদিও নিম্ন ও মধ্যবিত্ত; এ দুই বিত্তের পরিবারের মেয়েদের কথা লীনু উল্লেখ করেছেন; কিন্তু এই বিত্তীয় বিভাজনে কত শতাংশ নিম্নবিত্তের আর কত শতাংশ মধ্যবিত্তের, সে বিষয়ে আলাদা উপাত্ত আমাদের হাতে নেই। তবে বর্তমান অনূর্ধ্ব ১৯ দলে দেখা গেছে নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েদেরই আধিক্য, বিশেষ করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর।
বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলে বহু জাতির অর্থাৎ বাঙালি-আদিবাসীর এই সম্মিলন দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু বছর ধরে। এর আগে ২০১৫ সালের নারী ফুটবল দলের আট সদস্যই ছিলেন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর। বাংলাদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশেরও কম। জনসংখ্যার এই ক্ষুদ্রতম অংশের মেয়েদের শারীরিক উপযুক্ততা সমতলের মেয়েদের চেয়ে বেশি ভালো থাকে বিধায় তারা খেলাধুলায় বেশি পারঙ্গম হয়ে থাকে। বিপুলসংখ্যক মধ্য ও উচ্চবিত্তের মেয়েরা এখনো খেলাধুলায় আসেনি। তার বড় কারণ হিসেবে অনেকে চিহ্নিত করেন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধাকে, যার মূলে রয়েছে নারীর প্রতি রক্ষণশীল মনোভাব। অনেকেই মনে করেন, এই রক্ষণশীল মনোভাব যত কমে আসবে, মেয়েরা তত বেশি খেলাধুলায় উৎসাহী হবে।
নারীর প্রতি রক্ষণশীল মনোভাব বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক সব পরিসরে প্রবলভাবে বিস্তৃত। এই রক্ষণশীল মনোভাব কোনো হালকা বিষয় নয় বরং বাঙালি পরিবার ও সমাজপাঠের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কেন নারীর প্রতি এই রক্ষণশীলতা? নারীর প্রতি রক্ষণশীলতা মূলত ‘আদর্শ নারী’র ধারণা থেকে উৎসারিত এবং শ্রেণি-প্রভাবিত। এটি এক ধরনের সামাজিক নির্মাণ, যা ‘ভালো’ মেয়ে, স্ত্রী ও মা প্রভৃতি ভূমিকায় নারীর জন্য প্রেসক্রাইবড কিছু আচরণ, নিয়ম ও অনুশাসনের সমন্বয়ে তৈরি। আদর্শ নারী হওয়ার জন্য একজন নারীকে কিছু ভালো বা উত্তম গুণাবলি আয়ত্ত করার দিকে শৈশব থেকেই শিক্ষা দেওয়া হয়। নিজের চাহিদা ও ইচ্ছাকে যথাসম্ভব চেপে রেখে স্বামীর ইচ্ছায় জীবনাচরণ পরিচালিত করা, সন্তান প্রতিপালনে নিজেকে নিবিষ্ট রাখা, অনেক ক্ষেত্রে চাকরি ও পড়াশোনা বাদ দেওয়া, সর্বোপরি ত্যাগী ও বঞ্চিতের জীবনযাপন।
নারীর এই লিঙ্গীয় ভূমিকা যদিও স্থির ও পরিবর্তনের অযোগ্য কোনো বিষয় নয় বরং বিভিন্ন সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এসব লিঙ্গীয় ভূমিকার ধীরগতিতে হলেও বদল আসছে; তবে মোটা দাগে ‘আদর্শ নারী’ ধারণার সঙ্গে যেসব বৈশিষ্ট্য অসামঞ্জস্যপূর্ণ বা নারীর আকাক্সিক্ষত প্রতিকৃতির সঙ্গে খাপ খায় না সেসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারীর জন্য প্রেসক্রাইবড নয়, এমন পরিসরে পা ফেলার জন্য প্রথম ও প্রধান যুদ্ধটিই হলো মতাদর্শগত। মধ্য ও উচ্চবিত্তের মেয়েদের জন্য তেমন একটি পরিসর হলো ক্রীড়াজগৎ। যে সমাজে মেয়েদের চলতে-ফিরতে বসতে গেলে হাজারো নিয়ম ও অনুশাসনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেখানে মেয়েরা ঘরের বাইরে গিয়ে খেলবে- সেই ভাবনার বদল ঘটানো খুব সহজ কাজ নয়।
ফলে খেলাধুলা ভদ্র পরিবারের নারীদের জন্য আদর্শ পেশা নয়, কিন্তু শিক্ষকতা, কারণ এতে সামাজিক সম্মান আরোপিত আছে। তা ছাড়া খেলাধুলার জন্য নারীদের যে ধরনের পোশাক পরিধান করতে হয়, সে ধরনের পোশাক পরিধানের ব্যাপারে এসব ‘ভদ্র পরিবার’ অনেকটাই রক্ষণশীল। এই রক্ষণশীলতা ধর্মীয় কারণেও। বাঙালি মধ্যবিত্ত নারী ছোটবেলা থেকেই যে ধরনের রক্ষণশীল অনুশাসনের মধ্য দিয়ে বড় হয়, তা নিম্নবিত্তের নারীর কম। কেননা, ক্ষুধা নিবারণের মতো অপরিহার্য বিষয় যখন সামনে চলে আসে, তখন সামাজিক অনুশাসন মেনে চলার চাপ নিম্নবিত্তের কাছে গৌণ হয় বৈকি! অন্যদিকে আদিবাসী সমাজে এ ধরনের রক্ষণশীলতা অনেকটা অনুপস্থিত বা সীমিত। ফলে তাদের খেলাধুলার জগতে টিকে থাকার হার বাঙালি মেয়েদের চেয়ে বেশি বলে অনেকে মনে করেন।
খেলাধুলার জগতে নারীদের জায়গা তৈরি করা নিয়ে একদিকে নারীরা যেমন রক্ষণশীলতার মুখোমুখি হয়, সেই ধারণাটি মূলত নারীদের সংরক্ষিত বা হেফাজতে রাখা বা সম্মান বজায় রাখার ধারণাকে বিস্তৃত করে। একই ধারণার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই সামাজিক, রাষ্ট্রীয় সব পরিসরে। বাংলাদেশে নারীকে সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা রয়েছে পার্লামেন্টে, বাসের সিটে এবং অতিসম্প্রতি সমুদ্রসৈকতে। যদিও নানা আপত্তির মুখে সংরক্ষিত সৈকতের ব্যবস্থাটি বিলোপ করা হয়েছে, কিন্তু এই চিন্তার পেছনের কারণকে যদি খতিয়ে দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে ‘আদর্শ নারী’র ধারণা থেকেই এমন একটি পদক্ষেপের উৎপত্তি এবং আদর্শ নারীর সুরক্ষার প্রাথমিক ব্যবস্থাপত্রই হলো অবরোধ। কারণ যিনি আদর্শ নারী তিনি নিজেকে সীমিত রাখবেন, গুটিয়ে রাখবেন, অবগুণ্ঠিত রাখবেন; শরীর ও মনে অবরোধবাসিনী হবেন।
ঊনবিংশ শতকের ধর্মীয় গোঁড়ামিপূর্ণ সময়ে বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, ‘ভগিনীগণ! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন- অগ্রসর হউন। বুক ঠুকিয়া বল মা! আমরা পশু নই; বল ভগিনী। আমরা আসবাব নই; বল কন্যে। আমরা জড়োয়া অলঙ্কার-রূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বল, আমরা মানুষ!’
শতকের পর শতক পার হয় অথচ নারীর অবরোধবাস শেষ হয় না। একটা সময় নাম দস্তখত করতে পারা আর চিঠি পড়তে পারাকেই নারীর জন্য উপযুক্ত মনে করা হয়েছে। কেননা, অধিক পড়ালেখা জানা নারী স্বামীর হুকুম তামিল করবে না। ভাবা হতো, নারীকে বাইরে কাজ করতে দেওয়া যাবে না। তাহলে চোখ ফুটে যাবে, সংসার টিকবে না। অথচ এই একবিংশ শতকেও এই ভাবনা টিকে আছে। কিন্তু অল্প কিছুদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে প্রাণ দিতে হয়েছে স্বামীর কথামতো পড়ালেখায় ইস্তফা না দেওয়ার জন্য। যৌতুক, হত্যা, ধর্ষণ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। নীতিনির্ধারকরা তাই নারীকে সুরক্ষা করতে চান। সুরক্ষা দিতে চান নারীকে অবরোধবাসিনী করে। নারীরা ধর্ষিত হতে পারে; তাই ঘরের বাইরে যেও না। বিপদ হতে পারে, তাই সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফের। বাসে চড়লে নির্ধারিত সিটে বসো; পার্লামেন্টে নির্ধারিত আসন নাও; ১৫০ গজের সি-বিচে যাও। কিন্তু যে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পদক্ষেপ নারীর প্রকৃত অবস্থা বদলাতে পারে, সে বিষয়ে কোনো অগ্রগতি এখনো নেই। নারীর সম্পত্তিতে সমান ভাগ নেই; সন্তানের বৈধ অভিভাবকত্ব নেই; সমান মজুরি নেই; খেলাধুলায় সমান প্রাইজমানি নেই; সর্বক্ষেত্রে অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতির সবেতন ছুটি ও বিশ্রামের সুযোগ নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এসব নিয়ে ভাবাভাবির যথাযথ লোক নেই। চারদিকে নারী উন্নয়নের জয়জয়কার দেখে মাঝেমধ্যে তাই মনে হয়, ‘হায়! সবই যে মরীচিকা! নারীর জন্য কতকিছু আছে অথচ কিছুই নেই।’
লেখক : নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক
"