রেজাউল করিম খোকন
দৃষ্টিপাত
বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য অর্জন
বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বাংলাদেশকে আমূল বদলে দিয়েছে। টেকসই উন্নয়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এ দেশ। দুর্বল, অনুন্নত, নড়বড়ে অবস্থা থেকে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। প্রচলিত অবকাঠামোর আধুনিক রূপান্তর সম্ভাবনার নতুন নতুন দিক উন্মোচন করছে প্রতিদিন। যেসব খাত কিংবা ব্যবসা আগে অবহেলিত অবস্থায় ধুঁকে ধুঁকে চলছিল, সেগুলোতে নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। অমিত সম্ভাবনার হাতছানি এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত, আগ্রহী করে তুলছে। অবহেলায়, অযতেœ লালিত সেই সম্ভাবনাময় খাতগুলো ক্রমেই জেগে উঠছে।
বাংলাদেশের মানুষ কোনোভাবেই অক্ষম, দুর্বল, মেধাহীন নয়। তারা অনেক পরিশ্রম করতে পারে। সেই সক্ষমতা, উদ্যমী মনোভাবকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে একজন ক্যারিশমেটিক নেত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন নতুন বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন। তার সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এ দেশের অগণিত মানুষ জেগে উঠেছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষ যারা এর আগে বেকারত্ব, দরিদ্রতা আর অসহায়ত্বের বেড়াজালে নিজেদের বন্দি করে রেখেছিল, তারা এখন নিজের মেধা, বুদ্ধিমত্তা, শক্তি, সাহস, পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে সম্ভাবনার নতুন নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন। উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নিজেই নিজের ভাগ্য নতুনভাবে গড়ে তুলছেন। এভাবে সবার সম্মিলিত উদ্যোগে পাল্টে যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকা, জনপদের চিত্র।
বাংলাদেশ কখনোই ভিক্ষার ঝুলি ছিল না। দেশের সাম্প্রতিক সময়ের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নই তা প্রমাণ করে। বরং স্বাধীন দেশেও দীর্ঘদিন সামরিক শাসন থাকার কারণে বাংলাদেশ সম্ভাবনা অনুযায়ী সাফল্য অর্জন থেকে পিছিয়ে পড়েছে। টানা ১৫ বছর সামরিক শাসন না থাকলে বাংলাদেশ হয়তো ৫০ বছরেই উন্নত দেশে পরিণত হতো। তা সত্ত্বেও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে। একাত্তরে বিশ্বের মানচিত্রে যখন নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়, তখন অর্থনৈতিকভাবে এটির টিকে থাকা নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। অথচ সেই দেশটিই অর্থনৈতিক ও সামাজিক এমন কোনো সূচক নেই যে, অগ্রগতি লাভ করেনি। আর সবচেয়ে বড় নিন্দুকরাও এখন বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করছেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন অবিশ্বাস্য রকমের। বিশ্ববাসী যা ভাবতে পারেনি, তাই করে দেখিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প বিশ্বের বৃহত্তমশিল্পের মধ্যে অন্যতম। ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত পাট ও পাটজাত পণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এ সময় পাট রপ্তানি করে দেশটি অধিকাংশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করত। বিশ্বে পলিপ্রোপাইলিন যুগ আসার পর পাটপণ্যের চাহিদা দ্রুত হ্রাস পায়, কিন্তু সেই শূন্যস্থান ক্রমান্বয়ে দখল করে নেয় তৈরি পোশাক খাত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি অবদান এই তৈরি পোশাক খাতেরই। এই শিল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মোট প্রবৃদ্ধির ৬-৮ শতাংশই আসছে পোশাক খাত থেকে। বাংলাদেশের এই শিল্পকে বর্তমানে উন্নত বিশ্বসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো অনুকরণ করছে। স্বাধীনতার পর যে শিল্প আমাদের অর্থনীতিকে দাঁড় করিয়েছে, তার একমাত্র মাধ্যম কিন্তু এই পোশাকশিল্পই। বিশ্বের বুকে নিজেদের কঠোর শ্রম ও উৎপাদন দক্ষতা দেখাতে পারার প্রমাণ মেলে এই শিল্পের মাধ্যমে। এই শিল্পের ওপর ভর করেই বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশ বর্তমানে ৪১তম স্থানে উঠে এসেছে। বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল দেশের তালিকায় বাংলাদেশ এখন পঞ্চম।
এককালের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ ২০৩৫ সালে হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি। ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর)। অথচ স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনা শোনা যেতে থাকে। মূলত এসব দুর্ভাবনা ছড়িয়েছিল একাত্তরের যুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান সরকার। তাদের বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশ যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে অর্থনৈতিক দিক থেকে একটা টেকসই রাষ্ট্র হবে না। মূলত এই ধারণা থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে একটি ভিক্ষার ঝুলি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে প্রথম যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল, সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে হতাশার কথাই ছিল বেশি। বিশ্বব্যাংক বলেছিল, ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ একটি নাজুক ও জটিল উন্নয়ন সমস্যার নাম। দেশের মানুষরা গরিব। মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলার, যা গত ২০ বছরেও বাড়েনি। একটি অতি জনবহুল দেশ (প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৪০০) এবং জনসংখ্যা আরো বাড়ছে (বছরে ৩ শতাংশ হারে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি) এবং দেশটির মানুষ অধিকাংশই নিরক্ষর (সাক্ষরতার হার ২০ শতাংশের কম)।’
স্বাধীনতার ঠিক পাঁচ বছর পর ১৯৭৬ সালে নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফ্যালান্ড এবং ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জে আর পারকিনশন বাংলাদেশ : দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট নামের একটি গবেষণামূলক বইয়ে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, যদি এই দেশটি উন্নতি করতে পারে, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায় পৃথিবীর যেকোনো দেশ উন্নতি করতে পারবে।’ এর আগে ১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘বটমলেস বাস্কেট’ বা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে অভিহিত করেছিলেন। যার মানে হচ্ছে, এখানে যত অর্থই ঢালা হবে, তলা না থাকায় কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না। কিসিঞ্জারের পর সেই সময়ের অর্থনীতিবিদদের মধ্যেও অনেকেই তার এই বক্তব্যকে সমর্থন করে বলেছিলেন বাংলাদেশ হবে অর্থনৈতিক তত্ত্বের একটি অগ্নিপরীক্ষা বা টেস্ট কেস।
সেসব সংশয় উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে, তখন অনেক বিবেচনাতেই বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। এখন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য এবং বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিবিদ ও সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মুখে বাংলাদেশের উন্নয়নের জয়গান শোনা যায়। সমৃদ্ধির বহু নামে বাংলাদেশকে পরিচিতি দেওয়া হয় বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে। কিন্তু ঈর্ষণীয় এসব অর্জনের উচ্চতার সবচেয়ে বড় পরিমাপের পরিষ্কার ধারণা উঠে এসেছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে। বিশ্বের নীতিনির্ধারণী এই আন্তর্জাতিক সংস্থার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তকমা ঘুচিয়ে উন্নয়নশীল দেশ। স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক বছর বাংলাদেশের লেগেছে পুনর্গঠনের জন্য। পাকিস্তানি সেনারা অত্যন্ত নির্মমভাবে এ দেশের রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাঠামোকে ধ্বংস করেছিল। ধ্বংস করেছিল দেশের অবকাঠামোকে কিন্তু তা সত্ত্বেও পুনর্গঠনের পর্যায় অতিক্রম করার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। এই এগিয়ে যাওয়াটা অত্যন্ত দ্রুত হয় নব্বইয়ের দশক থেকে। তখন শুরু করে এখন পর্যন্ত গত তিন দশকে বাংলাদেশে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। বিতর্ক থাকলেও মাথাপিছু আয় অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। মানবসম্পদের দিক থেকেও বাংলাদেশে অনেক উন্নতি হয়েছে।
বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনেও অভূতপূর্ব সাফল্য দেখা গেছে। স্বাধীনতার সময়ের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেশি খাদ্যশস্য এখন উৎপাদন করতে পারছে দেশ। শুধু তাণ্ডই নয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও অনেক বেড়েছে। বেড়েছে প্রবাসী আয়, আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়। সবচেয়ে বড় কথা, সেই ভিক্ষার ঝুলির অপবাদ পাওয়া সেই বাংলাদেশ এখন অনেকটাই স্বাবলম্বী হওয়ার পথে। ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে এই দেশের উন্নয়ন ব্যয়ের ৮০ শতাংশই বিদেশি সাহায্য ও ঋণের মাধ্যমে মেটানো হতো। বর্তমানে সেই দেশের বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয়ে বিদেশি ঋণ ও সাহায্যের পরিমাণ অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। রাজস্ব আয়ের যে উদ্বৃত্ত অংশ থাকে, তা বিনিয়োগ করা হচ্ছে উন্নয়ন বাজেটে। এখন উন্নয়ন ব্যয়ের মাত্র ৩০ শতাংশ আসছে বৈদেশিক সাহায্য থেকে। বাকি ৭০ শতাংশই নিজস্ব অর্থ থেকে জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। একসময় বৈদেশিক অর্থায়ন না পেলে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হলেও সেটি নেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু এখন সেই অবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। এখন নিজেদের অর্থে বৈদেশিক ঋণ ছাড়াই প্রকল্প নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন হয়েছে, যার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতুর মতো ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন। এর কৃতিত্ব জনগণের এবং আওয়ামী লীগ সরকারের। জনগণ টাকা দিয়েছে আর আওয়ামী লীগ সরকার নিজ দেশের টাকায় এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সাহস দেখিয়েছে। এসব থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশ কখনোই ভিক্ষার ঝুলি ছিল না। ভিক্ষার ঝুলির তকমা লাগা সেই বাংলাদেশের গত ৫০ বছরে সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উত্তরণ।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক
"