মাজহারুল ইসলাম শামীম

  ১৭ জানুয়ারি, ২০২২

পর্যবেক্ষণ

ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের অন্তরালে

বিংশ শতক ছিল আমেরিকার, একবিংশ শতক কার? যে প্রকল্পের সম্ভাবনার ওপর নির্ভর করছে, তার অনেক নাম। প্রথমে ডাকা হচ্ছিল নয়া রেশমপথ (সিল্ক রোড) নামে। পরে বলা হলো ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবর)। কিন্তু ‘ওয়ান’ বা ‘একক’ কথাটার মধ্যে একাধিপত্যের লক্ষণ থাকায় এর সর্বশেষ নাম দেওয়া হয়েছে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অন্তত ৭০টি দেশের জলে ও স্থলে সংযোগ স্থাপনের (কানেকটিভিটি) পরিকল্পনা এটি। আছে এসব অঞ্চলের অবকাঠামো নির্মাণ, সাংস্কৃতিক বিনিময় ও বাণিজ্য বাড়ানোর নানা পরিকল্পনা। স্থলভিত্তিক সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট এবং সমুদ্রগামী মেরিটাইম সিল্ক রোড এই উদ্যোগের অন্তর্ভুক্ত।

ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডকে সংক্ষেপে ‘ওবর’ অথবা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ ইনিশিয়েটিভও বলা হচ্ছে। প্রকল্পটিতে অর্থায়নের জন্য এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইটি) নামে চীনের নেতৃত্বে ১০ হাজার কোটি ডলারের মূলধনে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ ছাড়া চার হাজার কোটি ডলারের সিল্ক রোড তহবিল গঠন করেছে চীন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাচ্ছে দেশটি। প্রকল্পটির ব্যাপারে চীনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয়েছে ৪৪টি দেশের সমঝোতা স্মারক। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত দেশগুলোকে আগ্রহী করে তোলার জন্য এর মধ্যে ২০টিরও বেশি দেশ সফর করেছেন। এই নতুন রুটের চীনা স্বপ্নদ্রষ্টা তিনিই। ২০১৩ সালের অক্টোবরে বিশ্বের সামনে তিনি এই পরিকল্পনা তুলে ধরেন। বর্তমানে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড বা ওবিওআর বিশ্বের একটি আলোচিত বিষয়।

একুশ শতাব্দী চীনা শতাব্দী হবে কি না, তা নির্ভর করছে এই বৈশ্বিক বাণিজ্য অবকাঠামো নির্মাণে সফলতার ওপর। তিনটি বৃহৎ শক্তি এখানে এক হয়েছে। একত্রিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্র, সবচেয়ে বড় অর্থায়ন ও সবচেয়ে বেশি জনসমষ্টি। বলা হচ্ছে, এটিই হতে যাচ্ছে আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রকল্প। ৬৮টি দেশ, ৬০ শতাংশ বিশ্ব জনসংখ্যা এবং ৪০ শতাংশ উৎপাদন নিয়ে এই নয়া রেশমপথ রচনা করছে এশীয় আদলের নতুন বিশ্বায়ন।

পুরোদমে বাস্তবায়িত হওয়া শুরু হলে বিআরআই হয়ে উঠবে বিশ্বায়ন ২.০। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ৯০ দশকের গোড়ার বিশ্বায়নকে বলা হচ্ছে বিশ্বায়ন ১.০। আর এটা ঘটছে এমন সময়ে, যখন পশ্চিমা বিশ্বায়ন নিজের ভেতর থেকেই বাধার মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ব্রিটেনে ব্রেক্সিটের বিজয় বাণিজ্যিক বিশ্বায়নের ধারণার সমালোচনা করে আবার ফিরিয়ে আনছে জাতিরাষ্ট্র ও জাতীয় বাজারের ধারণা। এ রকম সময়ে চীনা বিশ্বায়ন বিশ্বের সামনে নিয়ে এসেছে নাটকীয় সম্ভাবনার চ্যালেঞ্জ। চীনের নেতৃত্ব কতটা উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছে, এই কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রকল্প তার প্রধান উদাহরণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত ইউরোপকে পুনর্গঠনে ‘মার্শাল প্ল্যান’ যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছিল পৃথিবীর শীর্ষ শক্তির স্বীকৃতি। সে সুবাদেই আমেরিকা বলতে ভালোবাসে, বিশ শতক হলো আমেরিকান শতক। কিন্তু মার্শাল প্ল্যান ছিল কেবল ইউরোপের বিষয়, আর বেল্ট অ্যান্ড রোড এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকাকে ধারণ করলেও এর আওতায় আসবে সারা পৃথিবীর বাণিজ্যই।

বেল্ট অ্যান্ড রোডের মধ্য দিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিনিময় হয়েছে। চীনের নতুন ‘সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’ ও ‘টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি মেরিটাইম সিল্ক রোডও’ একই কাজ করবে। নতুন নতুন ও উন্নততর অবকাঠামো নির্মাণের মধ্য দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংস্কৃতি ও চিন্তার প্রসার হবে, ফলে সবারই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে।

সরকারিভাবে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের যে মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দেখা যায়, চীনের সিয়ান থেকে উরুমকি, তুরস্কের ইস্তাম্বুল ও ইউরোপের স্পেনের মাদ্রিদ পর্যন্ত সড়কপথ তৈরি হবে, যা কিনা মধ্য এশিয়ার কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান হয়ে মস্কো, পোল্যান্ড, জার্মানির হামবুর্গ, হল্যান্ডের রটারডাম হয়ে মাদ্রিদে গিয়ে শেষ হবে।

একই সঙ্গে চীন একটি মেরিটাইম তথা সামুদ্রিক সিল্ক রোডের মহাপরিকল্পনা করছে। এই সিল্ক রোডের মাধ্যমে একদিকে আফ্রিকার জিবুতি, কেনিয়ার মোমবাসা বন্দরের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর ও মিয়ানমারকেও যুক্ত করতে চায় চীন।

‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ সম্মেলন : শুরুতে চীনের বেইজিংয়ের গ্রেট হলে বসে দুই দিনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ সম্মেলন। প্রথম দিন বিশ্বজুড়ে যোগাযোগব্যবস্থা পুনর্গঠন প্রকল্পে ১২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয় চীন। এই মেগা প্রকল্পে যে কেউ চাইলে অংশ নিতে পারবে বলে জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেসহ শতাধিক দেশের সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান, প্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী দলের সদস্যরা অংশ নেন সম্মেলনে। সম্মেলন বয়কট করেছে ভারত। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও পাকিস্তান এই সম্মেলনে অংশ নেয়।

শি জিনপিং বলেন, ‘আমরা বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প বাস্তবায়নকে এ অঞ্চলে শান্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করছি। উন্মুক্ত উন্নয়নকে উৎসাহিত করা এবং সুষ্ঠু, যৌক্তিক ও স্বচ্ছ বিশ্ববাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিধিব্যবস্থা গড়ে তোলার এখনই সময়। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা কিংবা আমেরিকা যে দেশই হোক না কেন, বেল্ট অ্যান্ড রোড পরিকল্পনায় তাদের সবারই সহযোগিতা ও অংশীদারত্ব থাকবে।’

প্রস্তাবিত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ বাস্তবায়িত হলে ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে ঐক্য আরো জোরালো হওয়ার পাশাপাশি এ অঞ্চলের অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হবে বলে মন্তব্য করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। তবে এর মাঝে ভারতের বিতর্ক আছে কিছুটা। তা হলো, প্রথমত এটা যাবে কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে, যেটা নিয়ে ভারতের বহুদিনের বিরোধ আছে আরেক প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে। আর দ্বিতীয়ত, এটার অর্থায়ন মোটেও সলিড কোনো খাত থেকে হচ্ছে না। বরং সেটা হবে ডেট ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে, অর্থাৎ এটা আপনাকে ঋণের মধ্যে ফেলে দেবে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সুফল হলো ২০১৭ সালকে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ‘বন্ধুত্ব ও আদান-প্রদানের’ বছর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ তৈরিতে বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার বা বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডর নিয়েও কাজ করছে বেইজিং। এই উদ্যোগের পাশাপাশি শিল্পায়নের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, বিনিয়োগ, সমুদ্র খাত সহযোগিতা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা এবং সংস্কৃতি ও দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি নিয়ে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে। এ ছাড়া চীন-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করবে উভয় পক্ষ। অনেকের মতে, এ প্রকল্পের মাধ্যমে চীন বিশ্বে আরো বড় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। কিন্তু চীনা কর্তৃপক্ষ এ সমালোচনা মানতে নারাজ। তাদের মতে, যেকোনো দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন করতে হলে অবকাঠামোর উন্নতি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে চীন দেশগুলোকে সহায়তা করছে। এটাই চীনের নীতি। এতে উভয়ই লাভবান হবে। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে চীনের বড় আগ্রহ রয়েছে, কারণও রয়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না।

লেখক : শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, তৃতীয় বর্ষ

ফেনী সরকারি কলেজ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close