আকিজ মাহমুদ
পর্যবেক্ষণ
তাইওয়ান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষা
দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় ‘এশিয়ান টাইগার’ হিসেবে বিবেচিত চারটি দেশের অন্যতম হলো তাইওয়ান। একসময়ের অনুন্নত, পরিকল্পনাহীন এই দ্বীপ রাষ্ট্রটির সমৃদ্ধি ঘটেছে মূলত বিজিত শক্তির হাত ধরে। বিজেতা জাপানি উপনিবেশবাদের কবলে তাইওয়ানের অর্থ ভাগবাটোয়ারা হলেও দেশটির সমৃদ্ধিও ঘটেছিল। অল্প সময়ে বিপুল অর্থসম্পদ আত্মসাতের লক্ষ্যে উৎপাদন ও যোগাযোগ বাণিজ্যের উন্নয়নের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থাপনাও গড়ে তোলে জাপানিরা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ে প্রায় পাঁচ দশকের শাসন থেকে মুক্ত হয় তাইওয়ান। চীনের চিং রাজবংশের অধীনে থাকা তাইওয়ানবাসী জাপানের আগ্রাসনমুক্ত হলেও পরে আর স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি পায়নি। স্বাধীনতার প্রশ্ন সামনে এলেই চীনের পক্ষ থেকে চরম উত্তেজনাকর বক্তব্যের শিকার হতে হয় তাদের। চীন বিগত পাঁচ দশক ধরে তাইওয়ানের একীভূতকরণ নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতে উঠেছে। দ্বীপরাষ্ট্রটি চীনের রোষানল থেকে বাঁচতে পশ্চিমামুখী হয়েছে। তবে পশ্চিমা দেশগুলো তাইওয়ানের মিত্রতার প্রতিশ্রুতি আদৌ কতটুকু রক্ষা করতে পারবে, তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
আধুনিক তাইওয়ান সংকট বুঝতে হলে আমাদের ফিরতে হবে ত্রিশের দশকে শুরু হওয়া চীন গৃহযুদ্ধে। প্রায় দুই দশক স্থায়ী এই গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল চীনা কমিউনিস্টদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে। এতে পরাজিত চীনা জাতীয়তাবাদী দলের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী এবং এর সমর্থকরা তাইওয়ানে নির্বাসিত হয়েছিলেন। চীনের জাতীয়তাবাদী দলের শীর্ষ নেতা চিয়াং কাই শেক তাইওয়ানের দুর্বল নেতৃত্ব কব্জা করে সেখানেও নিজেকে শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত করেন। অধুনিক তাইওয়ানে তাই স্থানীয় তাইওয়ান জনগণের পাশাপাশি সাধারণ চীনাদেরও উপস্থিতি লক্ষণীয়। নির্বাসিত চিয়াং কাই শেকের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত তাইওয়ানকে অর্থনৈতিকভাবে পুনর্জীবিত করা এবং স্বদেশি অনুগামীদের জীবিকা নিশ্চিতের মাধ্যমে তাইওয়ানকে সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। উল্লেখ্য যে, জাপানের অধিকৃত অঞ্চল হওয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন জোটের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিল তাইওয়ান। মার্কিন আগ্রাসনে অনবরত বোমাবর্ষণের দরুন একটি বিধ্বস্ত ও ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছিল দ্বীপটি। এর ওপর চিয়াং কাই শেক যখন তাইওয়ানের শাসক হয়েছেন, তখন স্বভাবতই তাকে চীনের কমিউনিস্টদের রোষানলে পড়তে হবে তা অনুমিতই ছিল। কেননা মাও সে তুং চীনের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বহু নির্মম প্রতিহিংসার জন্ম দিয়েছিলেন। তিনি বিচ্ছিন্ন তাইওয়ানকে পুনরায় চীনের অন্তর্ভুক্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন। চিয়াং কাই শেক তা বুঝতে পেরে পশ্চিমাঘেঁষা রাজনীতি শুরু করেন। অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়া চীনকে পুনর্গঠনে যখন মাও সে তুং একের পর এক প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ড হাতে নিচ্ছিলেন, ঠিক একই সময় তাইওয়ানে চিয়াং কাই শেক এর নেতৃত্ব নিজেদের সমৃদ্ধশালী করতে যুগোপযোগী সব পদক্ষেপ নিতে শুরু করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মার্কিন-সোভিয়েত শীতলযুদ্ধে বৈশ্বিক রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে তাইওয়ান। যুদ্ধ-পরবর্তী অনুন্নত দেশগুলোতে কমিউনিস্ট মতাদর্শের বিস্তৃতির সম্ভাবনা দেখা দেয়। কমিউনিস্ট ভাবধারাকে প্রতিহত করতে তড়িঘড়ি করে পশ্চিমা দেশগুলো অনুন্নত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে বিনিয়োগ শুরু করে। ফলে চিয়াং কাই শেক তাইওয়ানে অর্থনৈতিক বিপ্লবের কর্মযজ্ঞ চালাতে পশ্চিমাদের থেকে বিভিন্ন অনুদান ও সহযোগিতা পেতে থাকেন। আন্তর্জাতিক এই রাজনৈতিক সমীকরণের ফায়দা চিয়াং কাই শেক উত্তরসূরিরা ভালোভাবেই লুটেছেন। এতে করে তাইওয়ানও শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামোয় দাঁড়িয়ে যায়।
এদিকে চীনা নেতৃত্ব পুনরায় একীভূতকরণের কথা বললেও তাইওয়ান মোটেই সেই পথে হাঁটেনি। চীনের দাবি তাইওয়ান ‘এক চীন’ নীতির অংশ এবং তাইওয়ান চীনের বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ। অপরদিকে দ্বীপরাষ্ট্রটি নিজেদের স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা চীনের সঙ্গে একীভূত না হয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মহলেও দেনদরবার করছে। তাইওয়ানের এই স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টা যে সুখকর হবে না তা বেইজিং থেকে কড়া ভাষায় হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে চীনের কমিউনিস্ট সরকার পশ্চিমা দেশগুলোকেও নাক গলাতে নিষেধ করেছে। ফলে তাইওয়ানকে একীভূতকরণে চীনের হুমকি পুরো বিশ্বকেই সরগরম করে তুলছে।
তাইওয়ান নিয়ে যে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলছে, এর মূল কারণ দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান। তাইওয়ানের ভৌগোলিক অবস্থান মার্কিন-সোভিয়েত শীতলযুদ্ধে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বর্তমানেও এই দেশটি পূর্ব এশিয়ায় চীনা আগ্রাসন রুখতে আমেরিকার ট্রাম্পকার্ড হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কেননা এই অঞ্চলে কমিউনিস্ট দেশগুলোর মধ্যে তাইওয়ানের গণতান্ত্রিক কাঠামো পশ্চিমা স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে পারে। ১৯৯৬ সাল থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার রদবদলও হচ্ছে দেশটিতে। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৮৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য অংশীদার আধুনিক তাইওয়ান। সেমিকন্ডাক্টরের জন্য তাইওয়ানের গুরুত্ব প্রযুক্তি দুনিয়ায় অপ্রতিরোধ্য। আমেরিকার প্রযুক্তি উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে তাইওয়ান নির্ভরযোগ্য দেশ। পশ্চিমা প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ দেশগুলো তাইওয়ানে তৈরি চিপসেটের প্রধান ক্রেতা। বাণিজ্যিক ও কৌশলগত সম্পর্কের বাহিরে, চীনের চিয়াং কাই শেক ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান হওয়ায় এবং চীন ও তাইওয়ানে খ্রিস্টধর্ম প্রচার, প্রসারে তার বংশের অবদানের জন্য পশ্চিমাদের সখ্য পেয়ে আসছে তাইওয়ান।
কিন্তু তাইওয়ানকেন্দ্রিক পশ্চিমা শক্তির এরূপ কাঁধের ওপর নিঃশ্বাস ফেলা চীনের জন্য অস্বস্তির কারণ। শুধু তাই নয়, পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে চীন যে ক্রমবর্ধমান প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেটিও তাইওয়ানে মার্কিন উপস্থিতিতে নস্যাৎ হওয়ার সম্ভাবনায় রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- চীন কেন দশকের পর দশক তাইওয়ান ইস্যুতে কেবল হুমকি-ধমকিতেই সীমাবদ্ধ? কেন তারা তাইওয়ান আক্রমণ করে ‘এক চীন’ বাস্তবায়ন করতে পারছে না। বেইজিংয়ের তরফ থেকে শান্তিপূর্ণ একীভূতকরণের কথা বলা হলেও তাইওয়ান তা বারবার নাকচ করে আসছে। অধিকন্তু, তাইওয়ান নেতৃত্ব চীনের বিশ্বজয়ের স্বপ্নের বড় বাধা আমেরিকাকে নিজেদের দেশে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। চীনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে গড়ে তুলছে উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যাদের প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করছে মার্কিনরা। বেইজিংয়ের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত চীনের রেডলাইন অতিক্রম করছে। অবশ্য মার্কিন প্রশাসনের মনোভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আমেরিকা তাইওয়ান ইস্যুতে খুব সহজেই চীনকে ছাড় দিতে নারাজ। কেননা তাইওয়ান ইস্যুতে চীনকে রুখতে ব্যর্থ হলে পূর্ব এশিয়ায় অনেক পরীক্ষিত মিত্রের কাছে আমেরিকার স্বার্থ জলাঞ্জলি যাবে।
তবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা চীনের এই আক্রমণাত্মক মনোভাবকে আপাতত শি জিন পিংয়ের জাতীয় রাজনীতির কৌশল হিসেবে দেখছেন। কেননা এ বছরেই তার দলের শীর্ষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। এতে তার যোগ্য কিছু অনুসারীকে নেতৃত্বে আনতেই তিনি বারবার তাইওয়ান ইস্যুকে আলোচনায় আনছেন। তা ছাড়া একের পর এক অঘোষিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সামাল দিয়ে এই মুহূর্তে যুদ্ধে জড়িয়ে কোন অঞ্চল দখলে নেওয়া আন্তর্জাতিকভাবেও চীনের নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এর ফলে যে পশ্চিমাদের বিরূপ প্রভাব দেশটির ওপর পড়বে, সেই সম্পর্কেও চীন যথেষ্ট অবগত। আর এজন্যই চীন আপাতত তাইওয়ান আক্রমণ না করে আরেকটু সময়ের অপেক্ষা করবে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
প্রযুক্তি শিল্প খাতে তাইওয়ানের গুরুত্ব এবং দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান চীনকে বিশ্বের অপ্রতিরোধ্য অর্থনৈতিক পরাশক্তি হওয়াকে প্রলুব্ধ করছে। আগামীতে চীন যেকোনো মূল্যে তাইওয়ানকে নিজেদের সঙ্গে একীভূত করার চেষ্টা করবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র পশ্চিমারা চীনের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে ওঠা এই তাইওয়ানকে নিয়ে চীনের নাভিশ্বাস কতটুকু ওঠাতে সক্ষম হয়, তাই এখন দেখার বিষয়। যদিও আমরা ইতিপূর্বে ভিয়েতনাম, কুয়েত এবং আফগানিস্তান ইস্যুতে আমেরিকার মিত্রতার প্রতি দায়বদ্ধতাকে যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেখেছি। আমেরিকা কি সেই কালিমা মোচনের পথাবলম্বন করবে নাকি চীনের একীভূতকরণকে স্বীকৃতি দিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিতে নিজেদের অবস্থান আরো একধাপ নিম্নগামী করবে?
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
"