মোহাম্মদ আবু ইউসুফ
নীতি ও নৈতিকতা
পাপ থেকে বিরত থাকার উপায়
কামনা-বাসনা বা রিপু মানবজাতির সহজাত প্রবৃত্তি। এর ওপর নির্ভর করে মানুষের জান্নাত ও জাহান্নাম। কামনা-বাসনাকে আরবিতে শাহাওয়াত বলা হয়, যা দ্বারা জাহান্নামকে ঘিরে রাখা হয়েছে। আর যা মানুষ অপছন্দ করে তাকে বলা হয় মাকারিন। এই অপছন্দনীয় বিষয় দ্বারাই জান্নাতকে ঘিরে রাখা হয়েছে। অতএব, জান্নাতে যাওয়ার জন্য আমাদের নানা ধরনের বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হবে। কেননা জান্নাতের পানে গমনের রাস্তা ফুল বিছানো নয়!
অন্যদিকে, আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক হচ্ছে, যা কিছু মন্দ ও নিষিদ্ধ তা করতে আমাদের ভালো লাগে। সুতরাং, আমরা যদি আমাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করি তবে আমাদের গন্তব্য হবে জাহান্নাম।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন, জাহান্নামকে ঘিরে রাখা হয়েছে আকর্ষণীয় কাজকর্ম দিয়ে আর জান্নাত কে ঘিরে রাখা হয়েছে নিরস কাজকর্ম দিয়ে। (বোখারি, খণ্ড ৭, ২৪৫৫)
গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য অনেক উপায় থাকলেও এর মধ্য থেকে সহজ কয়েকটি উপায় প্রতিদিনের সংবাদের পাঠকদের তুলে ধরা হলো-
১. গুনাহের পথ বন্ধ করে দেয়া : কোনো গুনাহের কাজ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে দ্রুত তা থেকে ফিরে আসা। কারণ আমাদের সমাজে সাধারণত চলতে গেলে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় আমাদের বিভিন্ন ধরনের গুনাহের সম্মুখীন হতে হয়। তাই আমরা যদি এসব গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে চাই তবে আমাদের গুনাহের পথগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। আমাদের সমাজে একটি প্রবাদ আছে, ‘খাল কেটে কুমির আনা।’
কিন্তু গুনাহের ক্ষেত্রে, এমন করা যাবে না অর্থাৎ কুমির আসার সম্ভাবনা থাকলে খাল কাটা থেকে বিরত থাকতে হবে।
২. দৃষ্টিকে সংযত রাখা : মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনুল কারিমে ব্যাভিচারকে নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা জিনার ধারে কাছেও যেও না। কারণ এটি একটি লজ্জাজনক ও নিকৃষ্ট কর্ম, যা অন্যান্য নিকৃষ্ট কর্মের পথ খুলে দেয়।’ (সুরা আল ইসরা : ৩২)
আমরা জানি, ব্যাভিচারের দ্বার উন্মুক্ত করে দৃষ্টি। প্রথমে চোখ দিয়ে মানুষ কাউকে দেখে। পছন্দ হলে তাকে মন থেকে অনুভব করে এবং পরবর্তী পর্যায়ে তা চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ধাবিত হয়।
তাই ব্যাভিচার থেকে বাঁচতে হলে আগে আমাদের চোখকে সংযত করতে হবে। এটিতে সক্ষম হলে ব্যাভিচারের পথও বন্ধ হয়ে যাবে।
৩. গোপন অভিসার থেকে দূরে থাকা : যাদের সঙ্গে নারী-পুরুষের বিবাহ অবৈধ তারা ছাড়া বাকি সবার সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কারণ যাদের বিবাহ করা বৈধ সেসব পুরুষ ও নারী নির্জনে মিলিত হলে সেখানে তৃতীয় আরেকজন থাকে এবং সে হচ্ছে শয়তান। সুতরাং সেই পথটি বন্ধ করা প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য। এখানে ফাঁকফোকর খোঁজার চেষ্টা সুবিধাবাদীদের অপচেষ্টা মাত্র।
মূলত শয়তানকে কোনোভাবেই সুযোগ দেওয়া যাবে না। এমনটা করলে সে আমাদের হারামের পথেই নিয়ে যাবে।
ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যখনই কোনো পুরুষ পরনারীর সঙ্গে নির্জনে দেখা করে তখনই শয়তান সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত হয়।’ (তিরমিজি : ২১৬৫; ইবনে হিব্বান : ৫৫৮৬)
৪. ইন্টারনেট ব্যবহারে সতর্ক থাকা : আজকের পৃথিবীর অন্যতম জীবন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে ইন্টারনেট। এখানে যেমন রয়েছে ভালো ও উপকারী বিষয় তেমনি রয়েছে মন্দ ও অশ্লীলতা। আমরা ভালোকে গ্রহণ করে মন্দগুলো থেকে নিজেকে সংযত রাখতে পারলেই মানুষ পাপকর্ম থেকে দূরে থাকতে সক্ষম হবে।
৫. সালাত আদায় করা : নামাজ মানুষকে অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখে। তাই যথাসম্ভব নামাজ আদায়ের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা অবশ্য কর্তব্য। এর সঙ্গে প্রাত্যহিক রুটিনের একটি বিষয় রয়েছে। কারণ আমরা যদি প্রতিদিনের রুটিন ঠিক নেই তবে সঠিক সময়ে নামাজ আদায় করতে পারব।
আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত, নবী করিম (সা.) মুনাফিকের জন্য ফজর আর এশার সালাত যত কষ্টকর অন্য আর কোন সলাত অনুরূপ কষ্টকর নয়, তারা যদি এ দুটি সালাতের সওয়াব সম্পর্কে জানত, তাহলে নিতম্বে ভর করে হলেও এ দুই সালাতে উপস্থিত হতো। (বোখারি : ৫৮০)
রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ফজরের সলাত জামাতে আদায় করে, সে আল্লাহর জিম্মায়-দায়িত্বেই থাকে, আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জিম্মা-দায়িত্ব বিনষ্ট করে আল্লাহ তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (তিবরানি)
৬. আল্লাহর ভয় অন্তরে লালন করা : কোরআন ও হাদিসের পরিভাষায় এ ভয়কে তাকওয়া বলা হয়। তাকওয়া বা আন্তরিকতাবিহীন কোনো কাজই সফলতা বয়ে আনে না। যেকোনো কাজের প্রাণ হলো তাকওয়া। বিশেষ করে ইবাদত হিসেবে যা কিছু করা হয় তা আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় হওয়ার জন্য তাকওয়া একান্ত প্রয়োজন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বান্দা যখন কোনো গুনাহর কাজ করে তখন তার অন্তরে এক ধরনের কালো দাগ পড়ে যায়। যদি ইস্তেগফার করে তাহলে এই দাগ দূরীভূত করে তার অন্তর সুচালু, ধারালো ও পরিশীলিত হয়। আর এই দাগের কথা কোরআনেই আছে, খবরদার! তাদের অন্তরে দাগ রয়েছে যা তারা কামাই করেছে। (তিরমিজি, ৫ খণ্ড : ৩৩৩৪)
গুনাহ সম্পর্কে জানা উচিত সেটা ছোট বা বড় (সগিরা বা কবিরা) যা-ই হোক না কেন এবং সর্বদা চেষ্টা করতে হবে ছোট ছোট গুনাহ থেকেও বেঁচে থাকার জন্য।
পাপ করলে যেসব ক্ষতি হতে পারে : ইবনুল কাইযিম আল-জওজিয়্যাহ (র.) তার প্রণীত ‘আদণ্ডদা ওয়াদ দাওয়া’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, গুনাহর ক্ষতি অনেক। নিম্নে এর কয়েকটি বর্ণনা করা হলো।
ক. জ্ঞান থেকে বঞ্চনা।
খ. ইবাদত-আনুগত্য থেকে বঞ্চনা।
গ. নেক কাজের সৌভাগ্য কমে যাওয়া।
ঘ. গুনাহকারীর মর্যাদাহানি হওয়া।
ঙ. মন থেকে লজ্জা চলে যাওয়া।
চ. বরকত চলে যাওয়া।
ছ. বক্ষ সংকুচিত হওয়া।
জ. অন্তর কঠিন হয়ে যাওয়া।
ঝ. লাঞ্ছনার শিকার হওয়া।
ঞ. অশুভ পরিণতি নেমে আসা।
ট. আখেরাতে আযাবের সম্মুখীন হওয়া।
ইমাম ইবনুল কাইযিম আল-জাওজিয়্যাহ আরো বলেন, ‘প্রতিটি পাপ আরো অনেক পাপের জন্ম দেয়, একটি পাপ আরেকটি পাপের দিকে নিয়ে যেতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই পাপরাশি মানুষটিকে এমনভাবে কাবু করে ফেলে যে কৃত পাপগুলোর জন্য তাওবা করাকে তার কাছে কঠিন বলে মনে হয়।’
তিনি আরো বলেন, একজন পাপাচারী লোক তার পাপের জন্য অনুতপ্ত হয় না। কারণ তার অন্তর এরই মধ্যেইমরে গেছে।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, পাপ হলো শেকলের মতন যা পাপীকে আটকে রাখে যেন সে তাওহিদের বিশাল বাগানে বিচরণ করতে এবং সেখানকার ফল সৎকর্মগুলো সংগ্রহ করতে না পারে। (মাজমাউল ফাতাওয়া : ১৪/৪৯)
আল্লাহ আমাদের যেসব গুনাহকে গোপন করেছেন তথা মানুষের কাছ থেকে আড়াল করেছেন সেসব গুনাহর কথা জনে জনে বলে বেড়ানো উচিত নয়। কেননা এতে নিজের মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর মর্যাদাও ক্ষুণœ করা হয়। এই কাজ থেকে বাঁচতে কোনো কঠিন সাধনার প্রয়োজন হয় না; বরং তা থেকে বিরত থাকাটাই সহজ।
পাপ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করতে পারি। অশ্লীলতা ও চারিত্রিক অসৎ কামনা-বাসনা মুক্ত থাকতে হাদিসের নির্দেশনা মেনে চলা জরুরি। হাদিসে এসেছে-
হজরত যিয়াদ ইবনে ইলাক্বাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি তার চাচা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন,
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন মুনকারাতিল আখলাক্বি ওয়াল আ’মালি ওয়াল আহওয়ায়ি।’
অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি তোমার কাছে খারাপ চরিত্র, অন্যায় কাজ ও কুপ্রবৃত্তির অনিষ্টতা তথা মন্দ কামনা-বাসনা থেকে পানাহ চাই। (তিরমিজি)
এছাড়া আরো বহু পথ ও পন্থা রয়েছে নিজেকে গুনাহের কাজ বিরত রাখার। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সেসব থেকে দূরে থাকার তওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : সাংবাদিক
"