আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

  ১৪ জানুয়ারি, ২০২২

বিশ্লেষণ

পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি

এই পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহতায়ালার প্রতিনিধি। আল্লাহতায়ালা মানুষকে যে চারটি মর্যাদার জন্য সৃষ্টির সেরা জীবের ঘোষণা করেছেন, তন্মধ্যে প্রতিনিধি অন্যতম। প্রতিনিধি শব্দটি দেখতে খুব ছোট হলেও এর তাৎপর্য বিশাল।

মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে কেমন মর্যাদার অধিকারী তা উপলব্ধির জন্য একটা উদাহরণ টানা যাক।

ধরুন, আপনাদের গ্রামে বিশেষ কোনো এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আসার কথা। কিন্তু নির্ধারিত দিন তিনি আসতে পারলেন না। কোনো এক বিশেষ কারণে তাকে দেশের বাইরে যেতে হয়েছে। তবে তিনি না আসতে পারলেও তার পক্ষ থেকে প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন। তবে যাকে তাকে নয়, তার পরে যার স্থান তাকেই পাঠিয়েছেন। যাকে তাকে কেন পাঠালেন না? কারণ যাকে তাকে পাঠালে এলাকাবাসী ক্ষুণœ হতে পারে বা সম্মান জানাতে অনীহা দেখাতে পারে। এজন্যই তিনি তার পরের স্থানের মন্ত্রীকে প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছেন।

এবার বলুন তো, প্রধানমন্ত্রী এলে যে চেয়ারে বসানো হতো, সেই চেয়ারে কি তার প্রতিনিধিকে বসানো হয়নি? অবশ্যই বসানো হয়েছে। কেন না তিনি প্রধানমন্ত্রী না হলেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি। আল্লাহতায়ালা মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি বানিয়ে ঠিক এই মর্যাদার আসনেই বসিয়েছেন। পৃথিবীর প্রথম খলিফা বা প্রতিনিধি হলেন হজরত আদম (আ.)। পবিত্র কোরআনের ঘোষণা, ‘স্মরণ করো, যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদের বলেছিলেন-আমি প্রতিনিধি বানাতে চাই।’ (সুরা বাকারা : ৩০)

হজরত আদম (আ.) এর পর তাঁর পরবর্তী নবী-রাসুলরা খলিফা হয়েছেন। নবী-রাসুলরাই যুগে যুগে পৃথিবীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালার সাজানো বাগান তথা সৃষ্টি পরিবারের যত্ন নিয়েছেন, পরিচর্যা করেছেন। একইভাবে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষদের আগলে রেখেছেন। কেউ যেন আলোর পৃথিবী ছেড়ে অন্ধকারের চোরাগলিতে হারিয়ে না যায়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন। কিন্তু তারপরও কিছু মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় পরে মরীচিকার পেছনে ছুটেছে। ভুল পথে পা বাড়িয়েছে। অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো আলোর পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার জন্য আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে, দেশে দেশে তাঁর প্রতিনিধি করে এই নবী-রাসুলদের পাঠিয়েছেন। যেমন হজরত নুহ (আ.) এর পর আদ জাতির কাছে হজরত হুদ (আ.) কে পাঠানো হয়েছে। পবিত্র কোরআনের বাণী, ‘আর তোমরা স্মরণ করো, যখন আল্লাহ তোমাদের (আদ জাতিকে) নুহ জাতির পর খলিফা বানিয়েছেন।’ (সুরা আরাফ : ৬৯)

এমনিভাবে সামুদ জাতির কাছে হজরত সালেহ (আ.) কে নমরুদের অনুসারীদের কাছে হজরত ইবরাহিম (আ.) কে এবং ফেরাউনের অনুসারীদের কাছে হজরত মুসা (আ) কে পাঠিয়েছেন। আর দাউদ (আ.) কে তো সরাসরি প্রতিনিধি সম্বোধনই করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, অতএব, তুমি মানুষের মাঝে ন্যায়সঙ্গতভাবে রাজত্ব করো এবং খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না। তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দেবে।’ (সুরা সোয়াদ : ০৬)

নবী-রাসুলদের প্রতিনিধি হওয়ার এ সিলসিলা সমাপ্ত হয় আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে।

হজরত মুসা (আ.) এর অনুসারী ইহুদিরা এবং হজরত ঈসা (আ.) এর অনুসারী খ্রিস্টানরা যখন তাদের নবীর আদর্শ থেকে ছিটকে পড়ে, তখনই আল্লাহতায়ালা শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর উম্মত তথা আমাদের প্রতিনিধি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলে দাও, কে নিঃসহায়ের ডাকে সাড়া দেন, যখন সে ডাকে এবং কষ্ট দূরীভূত করেন আর তোমাদের পৃথিবীতে পূর্ববর্তীদের স্থলাভিষিক্ত করেন?’ (সুরা নামল : ৬২)

আলহামদুলিল্লাহ। পৃথিবীতে একমাত্র আমরাই হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করায় নবী-রাসুল না হয়েও আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়ার মর্যাদায় ভূষিত হয়েছি। এর আগে কোনো নবীর উম্মত এমন মর্যাদা পাননি। তবে এই মর্যাদা শুধুমাত্র মুসলমানের ঘরে জন্ম নিলেই পাওয়া যাবে না। এই মর্যাদা প্রাপ্তির জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। যেমন-

এক. ঈমান আনা বা বিশ্বাস স্থাপন করা : আল্লাহতায়ালা এক ও অদ্বিতীয়। তিনি আমাদের রব। আমরা তার আজ্ঞাবহ। তিনি সমগ্র জাহানের মালিক। সকল সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা। লালনকর্তা, পালনকর্তা। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। অন্তরে এই বিশ্বাস স্থাপন করার নামই হচ্ছে ঈমান। একইভাবে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর শেষ নবী। আর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে বেগুনাহ ফেরেশতাদের প্রতি, আসমানি কিতাবগুলোর প্রতিও। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি, তাঁর রাসুলদের প্রতি এবং অবতীর্ণ নুরের (আসমানি কিতাব) প্রতি।’ (সুরা তাগাবুন : ০৮)

ইমানের ৭০টিরও বেশি শাখা-প্রশাখা রয়েছে। তবে সাতটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যথা- ১. আল্লাহতায়ালার প্রতি। ২. ফেরেশতাদের প্রতি। ৩. আসমানি কিতাবগুলোর প্রতি। ৪. নবী-রাসুলদের প্রতি। ৫. কেয়ামত দিবসের প্রতি। ৬. ভালো-মন্দ তাকদির (ভাগ্য) এর প্রতি। ৭. মৃত্যুর হাশরের ময়দানে পুনরায় জীবিত হওয়ার প্রতি। (বুখারি শরিফ : ৫০)

দুই. আল্লাহতায়ালার ইবাদত করা : আরবি ইবাদত শব্দের বাংলা অর্থ গোলামি করা, মালিকের হুকুম মানা ইত্যাদি। সহজ কথায়, সমগ্র জাহানের মালিক আল্লাহতায়ালার হুকুম মানার নামই হচ্ছে ইবাদত। অনেকেই ইবাদত বলতে শুধুমাত্র নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকারকেই বোঝে থাকেন। ইবাদতের পরিধি এতেই সীমাবদ্ধ নয়। ইবাদত হচ্ছে আল্লাহতায়ালার সব হুকুমণ্ডআহকাম যথাযথ পালন করা। একইভাবে কোরআন সুন্নাহয় যা নিষেধ করা হয়েছে, তা থেকে বিরত থাকা। আল্লাহতায়ালার বাণী- ‘রাসুল (সা.) তোমাদের যা দেন (যা নিয়ে এসেছেন), তা গ্রহণ করো এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো। আর আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ (সুরা হাশর : ০৭)

শুধুমাত্র নামাজ রোজা পালনেই প্রতিনিধির গুণ অর্জিত হয় না। নামাজ রোজা পালনের সঙ্গে সঙ্গে সুদণ্ডঘোষ আদান-প্রদান, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, মানুষকে কষ্ট দেয়া, খুন করা, গুম করা। অকারণে পশু-পাখি হত্যা করাসহ যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যকেও এসব গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে। এজন্যই তো আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো।’ (সুরা বাকারা : ২০৮)

তিন. ঈমান ও ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক না করা : আল্লাহতায়ালার বাণী, ‘জেনে রাখুন, নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদত আল্লাহরই জন্য। যারা আল্লাহ ব্যতীত অপরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে এবং বলে যে, আমরা তাদের ইবাদত এজন্যই করি, যেন তারা আমাদের আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। নিশ্চয় আল্লাহ তাদের মধ্যে তাদের পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ বিষয়ের ফয়সালা করে দেবেন। আল্লাহ মিথ্যাবাদী কাফেরকে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’ (সুরা জুমার : ০৩)

এ আয়াতের দ্বারা আল্লাহতায়ালা ওইসব মানুষদের উদ্দেশ্য করেছেন, যারা মনে করে মানুষের পক্ষে সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন বা তাঁর কাছে কিছু চাওয়া সম্ভব নয়। এমন ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুশরিকরা আল্লাহর কিছু সৃষ্টিকে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছিল। যেমন তারা ফেরেশতাদের আল্লাহতায়ালার কন্যা জ্ঞান করত। একইভাবে হজরত ঈসা (আ.) কে আল্লাহর পুত্র দাবি করত। তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করার পরও ফেরেশতা ও ঈসা (আ.) এর উপাসনা করে। আমাদের মুসলমানদের মধ্যেও একশ্রেণির মানুষ এমন ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে বেড়ায়। তারা কবরে ফুল দেওয়া, আলোক সজ্জা করা, সিজদা করাকে আল্লাহ পাওয়ার মাধ্যম মনে করে। যা নিঃসন্দেহে শিরক। এসব গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং যারা এসব কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত, তাদের থামাতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর ইবাদতে কাউকেও শরিক করো না।’ (সুরা নিসা : ৩৬)

এ চারটি শর্ত পূরণের মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধির মর্যাদায় ভূষিত হয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

খতিব, কসবা জামে মসজিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close