শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ

  ১২ জানুয়ারি, ২০২২

বিশ্লেষণ

প্রসঙ্গ : অর্থপাচার এবং খেলাপি ঋণ

বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে ফাঁকি দিয়ে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা পাচার হচ্ছে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে। দেশ থেকে এসব অর্থ যাচ্ছে পৃথিবীর ৩০-এর অধিক দেশে। সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে ১০ দেশে। যার বড় অংশই জমা হচ্ছে সুইস ব্যাংকে। এ ছাড়া অর্থপাচারে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। এসব অর্থপাচারের কয়েকটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন অর্থনীতিবিদরা। এর মধ্যে রয়েছে- বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি, আইনের শাসনের ঘাটতি এবং বেপরোয়া দুর্নীতি। দেশ থেকে অর্থপাচার রোধে বহু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এ ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সুফল না পাওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে ৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। এ হিসাবে গড়ে প্রতি বছর পাচার হচ্ছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য ওঠে এসেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় টাকা পাচার বেড়েছে। এ ছাড়া দুর্নীতিও টাকা পাচারের অন্যতম কারণ। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, দেশ থেকে প্রতি বছর যে পরিমাণ টাকা পাচার হয়, তার আংশিক তথ্যই প্রকাশ পায়। এ অবস্থায় বিস্তারিত তথ্য খুঁজে বের করে অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া না হলে পাচার কমবে না। একইসঙ্গে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া অর্থপাচার রোধে আইনে তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে যতই ক্ষমতা দেওয়া হোক, তারা যদি কাজে দক্ষতার পরিচয় দিতে না পারে, তাহলে কাক্সিক্ষত সুফল মিলবে না। অভিযোগ রয়েছে, টাকা পাচারের বিষয়ে সরকার অবহিত থাকলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কারণ দেশের প্রভাবশালীদের অনেকেই অর্থপাচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া অনেক রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সরকারি চাকরিজীবীসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও জড়িত, যারা নীতি-নৈতিকতা ও দেশপ্রেম ভুলে বিদেশে অর্থপাচার করছেন। এ প্রবণতা বন্ধ না হলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিপুল অঙ্কের টাকা পাচারের কারণে এসডিজির সফল বাস্তবায়ন ও অন্যান্য লক্ষ্য অর্জন বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়লে এবং দুর্নীতি কমলে বিদেশে অর্থপাচার হ্রাস পাবে। কাজেই অর্থপাচার রোধে দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি দুর্নীতি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, পাচারের অর্থের সংখ্যাটি বড়। এসব অর্থের উৎস মূলত দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হয়। তবে পাচারের ক্ষেত্রে দেশের সার্বিক অবস্থা বিশেষ করে নিজের নিরাপত্তা, পরবর্তী প্রজন্মের নিরাপত্তা, সম্পদের নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন কেউ মনে করেন, এসব নিরাপত্তা নেই কিংবা থাকলেও ভবিষ্যতে না থাকার অনিশ্চয়তা থাকে, তখন অনেকে বিদেশে অর্থপাচার করে। তিনি জানান, অধিকাংশ আমলা, ব্যবসায়ীদের ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে। সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তারা টাকা সরানোর চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে এ দেশে বিনিয়োগ বা টাকা রাখায় আস্থা নেই। অনেকে বাড়ি বিক্রি করছে, সম্পদ বিক্রি করে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে টাকা সরানো এখন কঠিন কিছু নয়। অপরদিকে, খেলাপি ঋণ ব্যাংক এবং আর্থিক খাতের জন্য একটি ক্ষত কিংবা কলঙ্কজনক অধ্যায়; যদি তা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ২ শতাংশ পর্যন্ত যদি ঋণখেলাপি থাকে তবে সেটাকে সহনীয় মাত্রার খেলাপি ঋণ বলে মনে করা হয়। এর বেশি খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতের জন্য দুর্বিষহ। খেলাপি ঋণ নিজে তো আয় করতেই পারে না, বরং এটি ভালো ঋণের মাধ্যমে অর্জিত আয়কেও গ্রাস করে নেয়। অর্থাৎ এটি দুইভাবে ব্যাংকের ক্ষতি করে।

প্রথমত সে নিজে অনুপার্জনক্ষম হয়ে যায়; দ্বিতীয়ত ভালো ঋণের আয়ে ভাগ বসায়। তাই খেলাপি ঋণ ব্যাংকের সদা-সর্বদা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। খেলাপি ঋণ নির্ধারিত সীমার মধ্যে রাখার জন্য ব্যাংকগুলোকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্টে দেখা যায়, ঋণের শ্রেণিবিন্যাস নীতি শিথিল করা সত্ত্বেও দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে! বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকায়, যা ৯ মাস আগের তুলনায় ১৪ শতাংশ ও গত এক বছরের তুলনায় ৭ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনাভাইরাস মহামারি আঘাত হানার পরপরই ঋণ পরিশোধে ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখনো ঋণ পরিশোধে কিছুটা ছাড় দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তা সত্ত্বেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। অর্থনীতির জন্য এটি একটি অশুভ লক্ষণ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যানুসারে, চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। দ্বিতীয় প্রান্তিকের শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ১৯১ কোটি টাকা যা তৃতীয় প্রান্তিকের শেষে বেড়ে ৫০ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। সরকারি ব্যাংকে ৪৭ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা, বেসরকারি ব্যাংকে ৫০ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপির পরিমাণ ২ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালের পর অর্থপাচার সংক্রান্ত সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। এমনকি ২০১৫ সালের পর জাতিসংঘকে বৈদেশিক বাণিজ্যের কোনো তথ্য দেয়নি বাংলাদেশ। এ বিষয়ে পাঁচটি কারণ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। কারণগুলো হলো- ১. বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব ২. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কা ৩. রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি ৪. আইনের শাসনের ঘাটতি এবং ৫. বেপরোয়া বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে টাকা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পাচার হওয়া অর্থের একটি আংশিক চিত্র দিয়েছে জিএফআই। প্রতি বছরই নানা কায়দায় অর্থপাচার বাড়ছে। যারা অর্থপাচার করছেন, তারা আর্থিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিকভাবে অনেক প্রভাবশালী। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সদিচ্ছার ঘাটতি, স্বচ্ছতা ও দৃঢ়তার ঘাটতি অর্থপাচার প্রতিরোধে ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।

অভিযোগ আছে, অনেকেই বিভিন্ন সুযোগণ্ডসুবিধা পাওয়ার পরও ঋণ পরিশোধ করছেন না। যার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। তারা ভাবছেন, ঋণ পরিশোধের সুবিধা আরো বাড়তে পারে। তাই ঋণ পরিশোধ না করে আবারও নতুন ব্যবসায় বিনিয়োগ করছেন। অন্য কথায় বলা যায়, খেলাপি ঋণ ক্যানসারের মতো। প্রথমত, নতুন করে যেন আর ঋণখেলাপি না হয়, তার জন্য পরিকল্পিত ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থাৎ ভালো গ্রাহক নির্বাচনে ঋণদাতাদের সচেষ্ট হতে হবে। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে পথ খুঁজতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রয়োজনে বিশেষ কমিশন গঠন করা যেতে পারে। খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনি প্রক্রিয়া দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার ব্যবস্থা করা। অনিচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের জন্য আবার ঋণের ব্যবস্থা করে তাদের জন্য নতুন করে ব্যবসার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে। খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রে চীন যে ব্যবস্থা নিয়েছে; আমাদের দেশেও তেমন কিছু করা যেতে পারে।

অর্থপাচার এবং খেলাপি ঋণ আমাদের দেশের অর্ধশতাব্দীরও অধিক সময় ধরে চলে আসা এক পুঞ্জীভূত সমস্যা। তাই রাতারাতি এ সমস্যার সমাধান হয়তো সম্ভব নয়। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণে সম্মিলিতভাবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের সক্রিয় এবং আন্তরিক সহযোগিতাও অত্যন্ত জরুরি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close