জি এম আরিফুজ্জামান

  ১১ জানুয়ারি, ২০২২

মুক্তিযুদ্ধ

একাত্তরের জেনোসাইড নিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরের শেষ দিনে বাংলাদেশের ইতিহাসে যুক্ত হলো একটি নতুন অধ্যায়। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘দ্য লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন’ সংক্ষেপে ‘লেমকিন ইনস্টিটিউট’ বাংলাদেশে একাত্তরের জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করে। ১৯৭১ সালে ৯ মাসব্যাপী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের দ্বারা সংঘটিত জেনোসাইডের স্বীকৃতি বিষয়ে প্রায় ৫০ বছর পর প্রথম আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হলো। সংস্থাটি মূলত সারা পৃথিবীর জননিরাপত্তা, জেনোসাইড প্রিভেনশন, আন্তর্জাতিক আইন, শান্তি বাস্তবায়ন, ট্রমা দূরীকরণের বিষয় নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে তৌহিদ রেজা নূর ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশে একাত্তরের জেনোসাইডকে স্বীকৃতির জন্য লেমকিন ইনস্টিটিউটে আবেদন জানালে যাচাই-বাছাই করে গত ৩১ ডিসেম্বর এ ইনস্টিটিউট ‘বাংলাদেশে একাত্তরের জেনোসাইড’কে স্বীকৃতি দিয়ে বিবৃতি দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে একাত্তরের জেনোসাইডের আলোচনায় চারটি বিষয়কে ব্যাখ্যায় আনা যায়।

প্রথমত, এই স্বীকৃতির মাধ্যমে এটা পরিষ্কার- ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসরদের দ্বারা পরিচালিত হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন এবং বাঙালি নিধনের অভিযান ছিল ‘জেনোসাইড’। বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তান সরকার, তাদের আন্তর্জাতিক সহযোগী রাষ্ট্র এবং এ দেশীয় দোসররা মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচালিত কর্মকাণ্ডকে যুদ্ধের অংশ হিসেবে প্রচার করার হীন চেষ্টা চালিয়েছে। দীর্ঘ ৫০ বছর পরে এসেও পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে একাত্তরের জেনোসাইডের জন্য ক্ষমার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়নি। এ ধরনের দম্ভের ওপর একটা বড় ধরনের আঘাত এই স্বীকৃতি।

দ্বিতীয়ত, একাত্তরের জেনোসাইডকে স্বীকৃতির জন্য সময়ের পরিধি নিয়েও আলোচনা হয়। যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী, তাদের পক্ষ থেকে সব সময় একাত্তরের জেনোসাইড বিষয়ে অপপ্রচার এবং সময়ের ব্যাপ্তিকে সামনে নিয়ে এসে সন্দেহের উদ্রেক করার চেষ্টা চালানো হয়। এই প্রেক্ষাপটে আর্মেনিয়ান জেনোসাইডের স্বীকৃতি নিয়ে আলোচনা করা যাক। ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অটোমান সাম্রাজ্যে ১৫ লাখের বেশি আর্মেনীয়কে হত্যা করা হয়। দীর্ঘ ৫০ বছর পর ১৯৬৫ সালে উরুগুয়ে, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা ও রাশিয়া ওই জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দেয়। প্রায় ১০০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর ২০২১ সালের ২৪ এপ্রিল আর্মেনীয় হত্যাকাণ্ডকে ‘জেনোসাইড’ বলে স্বীকৃতি দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে এ ধরনের স্বীকৃতি আর্মেনীয় হত্যাকাণ্ডকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সুতরাং এটা স্পষ্ট- সময় কোনো বিষয় নয়। একাত্তরের জেনোসাইডের ক্ষেত্রে ৫০ বছর পর এ ধরনের স্বীকৃতি একাত্তরের জেনোসাইডের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভের পথকে আরো সুগম করে তুলেছে।

তৃতীয়ত, অ্যাকাডেমিক এবং ব্যক্তিপর্যায়ের গবেষণার ফল অনেক সময় রাষ্ট্রের কাজকে অনেক বেশি সহজ করে দেয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশে একাত্তরের জেনোসাইডের স্বীকৃতির পথকে সুগমের জন্য ব্যক্তিপর্যায় থেকে লেমকিন ইনস্টিটিউটে আবেদন এবং তাদের স্বীকৃতির বিষয়টি অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের অ্যাকাডেমিক পর্যায়ে বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ’, ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’, ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’ জেনোসাইডের ওপর বিভিন্ন ধরনের কোর্স, গবেষণাকর্ম, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় কনফারেন্স, বক্তৃতামালা, প্রকাশনা চলমান রেখেছে বাংলাদেশে একাত্তরের জেনোসাইড বিষয়ে গবেষণাধর্মী জ্ঞানকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি না এলেও যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আর্জেন্টিনা, হংকং, পোল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জেনোসাইডের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে। এমনকি একাধিক বিদেশি গবেষকও বাংলাদেশের জেনোসাইড নিয়ে গবেষণা করছেন। লেমকিন ইনস্টিটিউট নিশ্চয়ই তাদের পর্যবেক্ষণে অ্যাকাডেমিক এবং ব্যক্তিপর্যায়ের গবেষণার ফলকে মূল্যায়ন করেছে। একইভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এবং জাতিসংঘের স্বীকৃতি আদায়ে অ্যাকাডেমিক এবং ব্যক্তিপর্যায়ের গবেষণালব্ধ ফল সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

চতুর্থত, জাতিসংঘে বাংলাদেশে একাত্তরের জেনোসাইডের স্বীকৃতির জন্য প্রস্তাব আনয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য একটি শক্তিশালী দিক উন্মোচিত হলো। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ বাংলাদেশের মহান জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চকে ‘জেনোসাইড দিবস’ ঘোষণার বিষয়টি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। ওই বছর মার্চে বাংলাদেশ সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী পর্যায়ের পক্ষ থেকে একাত্তরের জেনোসাইডের স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব উত্থাপনের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে কয়েক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন এই স্বীকৃতির ফলে বাংলাদেশকে দ্রুততার সঙ্গে জাতিসংঘে ‘একাত্তরের জেনোসাইড’-এর স্বীকৃতি বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপনের দিকে দৃষ্টিপাত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষপে গ্রহণ করা উচিত।

জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ‘বাংলাদেশে একাত্তরের জেনোসাইড’-এর স্বীকৃতি আদায়ে লেমকিন ইনস্টিটিউটের এই স্বীকৃতি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই স্বীকৃতিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করতে হবে।

লেখক : রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close