মো. আরাফাত রহমান

  ২৫ নভেম্বর, ২০২১

বিশ্লেষণ

যৌন নির্যাতনের রাশ টেনে ধরতে হবে

যৌন হয়রানি বিষয়ে অভিজ্ঞতালব্ধ এবং গুণগত মানসম্পন্ন তথ্য বাংলাদেশে খুব কমই পাওয়া যায়। তবে অ্যাকশন এইড পরিচালিত এক সমীক্ষা প্রতিবেদন- ‘উইমেন অ্যান্ড দ্য সিটি-৩ : সাত দেশে নারী ও মেয়েদের উপর সহিংসতার প্রাথমিক তথ্যের সার সংক্ষেপ’-এ দেখা যায়, বাংলাদেশে যৌনতা প্রকাশ পায় এমন অঙ্গভঙ্গি বা মন্তব্য করা, কটু কথার মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা এবং যৌন তাৎপর্যপূর্ণ কৌতুক করার মতো ঘটনাগুলোই সাধারণভাবে ঘটে থাকে এবং ইভটিজিং বা যৌন হয়রানির শিকার নারীদের এ ধরনের অভিজ্ঞতাই সবচচেয়ে বেশি। নারীদের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, সব পাবলিক প্লেসের মধ্যে রাস্তায়ই সবচেয়ে বেশি সহিংসতার মতো ঘটনাগুলো ঘটে অথবা সেখানেই নারীরা সব থেকে অনিরাপদ বোধ করে।

সমীক্ষাটি সাতটি জেলা সদরে পরিচালনা করা হয়। সেখানে দেখা যায়, ৮৪ শতাংশ নারী জানিয়েছেন তারা কটু কথা বা যৌন মন্তব্য, ৫৬ শতাংশ জানিয়েছেন তারা যৌন হয়রানি-ইভটিজিং এবং ২২ শতাংশ জানিয়েছেন তারা যৌন আক্রমণ, ধর্ষণ বা ধর্ষণ আতঙ্কের শিকার। এসব অভিজ্ঞতা হয়েছে এক মাসে বা বছরে। রাস্তায় আলোর স্বল্পতা, রাতে কাজ করা বা যাতায়াত করা এবং উত্তরোত্তর ভয়ের অনুভূতি বৃদ্ধি বা প্রকৃত সহিংসতার চিত্র ব্যাপক প্রচার পাওয়ার মতো বিষয়গুলোর মধ্য দিয়েই নিরাপত্তার ঘাটতি তৈরি হয় বলে নারীরা মনে করেন। যেসব কারণে নারীরা যৌন হয়রানি বা যৌন আক্রমণের অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকেন সেগুলো হলো- এ ধরনের অভিযোগ করে কোনো লাভ হয় না, অভিযোগ করার প্রক্রিয়াটি খুব জটিল ও বিরক্তিকর, সামাজিক অপবাদ বা কলঙ্কের ভয় এবং আরো নিপীড়নের আশঙ্কা।

যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে শিশুরা কোনো প্রাপ্তবয়স্ক বা বড় শিশুর দ্বারা যৌনতামূলক আচরণের শিকার হয়। এক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন বলতে বুঝায় কোনো শিশুর যৌনতামূলক কাজে অংশগ্রহণ করা যার উদ্দেশ্য কোনো ব্যক্তির শারীরিক সন্তুষ্টি লাভ বা বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়া। এই ধরনের যৌন নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে কোনো শিশুকে যৌনতামূলক কাজ করতে বলা বা চাপ দেওয়া, যৌনাঙ্গের প্রদর্শন করতে বলা বা বাধ্য করা, শিশুকে পর্ন দেখানো, কোনো শিশুর সঙ্গে সত্যিকার অর্থে যৌন সঙ্গীর মতো আচরণ করা, শিশুর যৌনাঙ্গ স্পর্শ করা বা দেখা বা শিশু পর্ন তৈরি করা এবং শিশুদের কাছে যৌনতামূলক সেবা বিক্রয় করা।

শিশু যৌন নির্যাতনের প্রভাবের মধ্যে লজ্জা ও আত্মগ্লানি, হতাশা, দুশ্চিন্তা, ট্রমা পরবর্তী স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, আত্মসম্মানের অভাব, যৌন অক্ষমতা, প্রজনন অঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, আসক্তি, নিজেকে আঘাত করা, আত্মহত্যার প্রবণতা, বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, পরবর্তী সময়ে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর পুনরায় উক্ত ঘটনা ঘটানো/ঘটনার শিকার হওয়ার প্রবণতা, বুলিমিয়া নার্ভোসা এবং শিশুর শারীরিক আঘাতও হতে পারে অন্যান্য সমস্যাগুলোর একটি। আত্মহত্যার প্রচেষ্টার ঝুঁকিপূর্ণ প্রভাবক হলো শিশু যৌন নির্যাতন। নির্যাতিত হওয়ার অনেক বছর পরও নির্যাতিতের মাঝে অধিকাংশ ক্ষতিই দৃশ্যমান থাকে। পারিবারিক সদস্যদের মাধ্যম দ্বারা যৌন নির্যাতিত হলে লম্বা সময়ের জন্যে মানসিক ট্রমাসহ ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে।

যেসব শিশু যৌন হেনস্তা বা নির্যাতনের শিকার হয়, তারা যৌন বাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে কারণ তাদের ওইসব রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা তৈরি হয়নি এবং জোর পূর্বক যৌন মিলনের ফলে তাদের শ্লৈষিক ঝিল্লি ছেড়ার মতো ক্ষতি হতে পারে। কম বয়সে যৌনতার শিকার হওয়াকে এইচআইভি ছড়ানোর ঝুঁকির সঙ্গে বিবেচনা করা হয় কারণ যৌনতা সম্পর্কে কম জ্ঞান, এইচআইভির দ্রুত বৃদ্ধি, যৌন মিলনের ঝুঁকিপূর্ণ প্রয়োগ, কনডম ব্যবহার না করা, নিরাপদ যৌন মিলনের পন্থা না জানা, ঘন ঘন যৌন সঙ্গী বদল, অনেক বছর ধরে যৌন কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা।

বিশ্বে ১৮-১৯ শতাংশ মহিলা এবং ৮ শতাংশ পুরুষ তাদের শৈশবকালে যৌন নির্যাতিত হওয়ার কথা প্রকাশ্যে এনেছে। মেয়েদের উচ্চমাত্রায় নির্যাতিত হওয়া বা ছেলেদের যৌন নির্যাতনের কথা প্রকাশ্যে না আনার প্রবণতা বা উভয় কারণের জন্য লিঙ্গ বৈষম্যই মূলত দায়ী। অধিকাংশ শিশু যৌন নির্যাতনকারী নির্যাতিতের পূর্বপরিচিত। ৩০ শতাংশ নির্যাতনকারী খুব নিকট আত্মীয় এমনকি কাকা, মামা অথবা কাজিনও হতে পারে। অন্যান্য ৬০ শতাংশ পরিচিতের মধ্যে পারিবারিক বন্ধু অথবা প্রতিবেশী হতে পারে। এ ছাড়া মাত্র ১০ শতাংশ নির্যাতনকারী অপরিচিত হয়ে থাকে। অধিকাংশ শিশু যৌন নির্যাতন পুরুষের দ্বারা হয়ে থাকে তবে মহিলাদের দ্বারা সংঘটিত নির্যাতনের ১৪ শতাংশ মেয়েদের প্রতি এবং ৬ শতাংশ ছেলেদের প্রতি হয়ে থাকে বলে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে। গবেষণা অনুযায়ী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ বোধশক্তির অভাবে যৌন লাঞ্ছিত বা নির্যাতিত হওয়ার বড় ঝুঁকিতে আছে। বয়স্ক মানুষ বিশেষ করে যাদের মানসিক সমস্যা আছে তারাও যৌন নির্যাতনের ঝুঁকিতে আছে। অনেক সময় নির্যাতিতদের বিশ্বাস করা হয় না কারণ মানসিক সমস্যার কারণে তাদের বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। অপরাধীরা বারবার এদের টার্গেট করে কারণ তারা জানে এরা বিশ্বাসের অনুপযোগী। রক্ষণাবেক্ষণকারীদের দ্বারা নির্যাতনও একটি অপরাধ। নির্যাতিতরা আত্মসম্মানের ভয়ে বা অনিচ্ছার জন্য নির্যাতনের কোনো রিপোর্ট করে না বা তদন্তকারীকে সহায়তা করে না।

বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানে কোনো মহিলা কর্মীর সঙ্গে তার পদমর্যাদা বা অবস্থান নির্বিশেষে, একই প্রতিষ্ঠানে কোনো ব্যক্তি এমন কোনো ব্যবহার করতে পারবে না যা অশোভনীয় বা সেই মহিলা শ্রমিকের শালীনতাকে হানি করে। ২০০৯ সালের মে মাসে পূর্ববর্তী ২০০৮ সালের পিটিশন নং ৫৯১৬ এর শুনানিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট যৌন হয়রানিবিষয়ক বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান করে এবং নিয়োগকর্তাদের এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে জরুরি পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। যৌন হয়রানিবিষয়ক নির্দেশিকা সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা আবশ্যক এবং যৌন হয়রানি বিষয়ে শুরু থেকে শেষ অবধি এবং শ্রমিককে ধারণা প্রদান করতে হবে। এই নির্দেশিকা যৌন হয়রানি অপরাধের প্রতিরোধ সংক্রান্ত পদক্ষেপসহ সচেনতা বৃদ্ধি এবং যৌন অপরাধ সম্পর্কে আইনি বিধানমালা প্রচার করার কাজ চিহ্নিত করে থাকে। এ ছাড়াও এই নির্দেশিকার মধ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, অভিযোগ প্রক্রিয়াসহ কর্মস্থলে একটি অভিযোগ কমিটির প্রতিষ্ঠা এবং ফৌজদারি মামলাগুলোর বিবরণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩ অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তার শরীরের যেকোনো অঙ্গ বা বস্তু দ্বারা কোনো নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোনো অঙ্গ স্পর্শ করেন বা কোনো নারীর শ্লীলতাহানি করেন তাহলে তার এই কাজ হবে যৌন পীড়ন এবং তজ্জন্য উক্ত ব্যক্তি অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন? যৌন নির্যাতন ও হয়রানি রোধসহ একটি সুরক্ষিত ও নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনসাধারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকরি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের এ সম্পর্কে সচেতন করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার-প্রচারণা চালানো ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল

ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close