রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৫ নভেম্বর, ২০২১

দৃষ্টিপাত

বৈশ্বিক সম্পর্কে চীন ও আমেরিকা

প্রায় ৫০ বছর ধরে চীনের নীতি খুব স্পষ্ট- তারা নিজেরা কখনো আগ বাড়িয়ে মারমুখী হবে না কিন্তু তারা আক্রান্ত হলে প্রতি-আক্রমণ করবে। চাপের কাছে তারা নতজানু হবে না। এ ব্যাপারে চীনকে এখন আপোষহীন বলেই মনে হয় এবং তাদের এই অবস্থান তারা আমেরিকাকে জানিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমাদের ব্যাপারে চীনের এই মনোভাবের পেছনে রয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের রক্তাক্ত ইতিহাস। ১৫০ বছর ধরে পশ্চিমা শক্তিগুলোর কাছে চীন নতজানু হয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের থাকার সময় চীন ভাগ হয়ে গেছে। চীনা সেনাদের হটিয়ে পশ্চিমারা চীনের বিভিন্ন জায়গায় তাদের সেনাঘাঁটি তৈরি করেছে। এমনকি ১০০ বছর ধরে চীনের ইয়াংসি নদীর নিয়ন্ত্রণ ছিল চারটি পশ্চিমা শক্তির নৌবাহিনীর কব্জায়। এসব স্মৃতি জাতি হিসেবে চীনাদের মনে গেড়ে বসে রয়েছে। তাদের কথা, আর কখনোই তারা পশ্চিমাদের ভ্রুকুটি দেখতে রাজিনয়। এ কারণে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে এই প্রথম চীনে নিষেধাজ্ঞাবিরোধী একটি আইন পাস হয়েছে। এর ফলে এখন থেকে চীনা কোনো নাগরিক বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করলে জড়িতদের ওপর পাল্টা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যাবে। সেইসব ব্যক্তি বা কোম্পানিকে চীন থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে, চীনের সঙ্গে তাদের ব্যবসা নিষিদ্ধ হতে পারে, চীনে তাদের সম্পদ কুক্ষিগত করা যেতে পারে। চীনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশ্চিমারা এত দিন প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে যে পথ নিয়েছে, চীন ঠিক সেই পথই নিচ্ছে। হংকংয়ের সিটি ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক ওয়াং জিয়াং উ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, আইনি পথে এই ধরনের পাল্টা নিষেধাজ্ঞার পথে যাওয়ার রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক শক্তি চীনের আগে ছিল না, এখন তাদের সেই ক্ষমতা হয়েছে। এ ছাড়া চীনা ঋণের জালে আটকে পড়ার ঝুঁকি নিয়ে যে প্রচারণা আমেরিকা শুরু করেছে তাতে তেমন কাজ হবে বলে চীন মনে করে না।

তবে এটা ঠিক চীন যে একশরও বেশি দেশে বিনিয়োগ করেছে তাদের সবাই সমানভাবে লাভবান হয়নি, কিন্তু এটিও সত্যি যে, ওইসব দেশ তাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছে প্রধানত বিশ্বব্যাংকের সূত্রে যেসব পশ্চিমা বিনিয়োগ হয়েছে তার সাথে বহু শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে যা নিয়ে পরে তারা বিপাকে পড়েছে। তারা দেখছে চীন অন্তত তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলায় না। গত তিন দশকে চীন তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে অবকাঠামো উন্নয়নে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে- যা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে আমেরিকা, উদ্বিগ্ন। তাদের ভয়, গত কয়েকশ বছর ধরে উন্নয়নশীল বিশ্বে তাদের যে প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে তা হুমকিতে পড়ছে। বিবিসির উত্তর আমেরিকাবিষয়ক সম্পাদক জন সোপেল বলছেন, আমেরিকার বর্তমান সরকার তার মিত্রদের বলতে চাইছে যে, পশ্চিমা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শ্রেষ্ঠত্ব বাকি বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে হবে। বাকি বিশ্বকে বলতে হবে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে আখেরে তাদের বিপদে পড়তে হবে, চীন মানবাধিকারের তোয়াক্কা করে না, সুস্থ প্রতিযোগিতার ধার ধারে না। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা বিবিসিকে জানিয়েছেন জি-সেভেন বৈঠকের দ্বিতীয় দিনের আলাপ-আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল চীন এবং বিশ্বে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলার উপায়। হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা বলেন, অবকাঠামো এবং অন্যান্য কারিগরি সাহায্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে চীন যেভাবে তাদের প্রভাব বলয় বাড়াচ্ছে তার মোকাবিলায় বিকল্প অভিন্ন একটি কৌশল নিতে নতুন একটি পশ্চিমা জোট তৈরির প্রস্তাব দেবেন মি. বাইডেন। কিছু দেশের একটি ছোট গোষ্ঠী সারা পৃথিবীর ভাগ্য নির্ধারণ করবে, সেই যুগ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে জি-সেভেন গোষ্ঠীর নেতাদের সতর্ক করে করে দিয়ে বলেছে চীন।

চীনের ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রভাব মোকাবিলা করতে জি-সেভেন গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতারা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের এক পরিকল্পনার ব্যাপারে একমত হয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে, চীনের পুনরুত্থান ঠেকাতে হলে পশ্চিমা শক্তিগুলোকে এখনই সক্রিয় হতে হবে। মনে করা হচ্ছে, জি-সেভেন শীর্ষ সম্মেলনের এক সমাপনী ঘোষণা প্রকাশ করবেন, যাতে জলবায়ু পরিবর্তন সংকটে আক্রান্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরো বেশি অর্থনৈতিক সহায়তা এবং উন্নয়নশীল বিশ্বে অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে আরো অর্থায়নের কথা থাকবে- যাকে বলা হচ্ছে চীনা কর্মসূচির বিকল্প। জি-সেভেন শীর্ষ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড নামে এমন এক পরিকল্পনার সূচনা করছেন যা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ কর্মসূচির চেয়ে উচ্চতর মানের হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বিনিয়োগ কর্মসূচিতে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন, যার আওতায় নানা রকম অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। তবে সমালোচকরা বলছেন, চীনের এই কর্মসূচি দরিদ্রতর দেশগুলোর ওপর ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে যা তারা শোধ করতে পারছে না। এখন ক্ষমতাধর পশ্চিমা দেশগুলোর জোট জি-সেভেন এরই পাল্টা এক কর্মসূচি হাজির করতে চাইছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার ঐতিহাসিক নিরাপত্তা চুক্তির তীব্র সমালোচনা করে চীন এ চুক্তিকে ‘চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন’ ও ‘সংকীর্ণ মানসিকতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ওই চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য অস্ট্রেলিয়াকে পরমাণু চালিত সাবমেরিন নির্মাণের প্রযুক্তি দিয়ে সহযোগিতা করবে।

কিন্তু ইন্দো-প্যাসিফিকে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চলার জন্য তারা বেইজিংয়ের ওপর শক্ত চাপও সৃষ্টি করছে। সংঘাতের শঙ্কাও তারা সেখানে কমিয়েছে। ঠান্ডাযুদ্ধের ভীতিও এড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন একটি সমন্বিত পরিকল্পনার নীতি গ্রহণ করেছে। এগিয়ে যাওয়ার জন্য সামরিক ও বেসামরিক দুটি ক্ষেত্রেই এই কৌশল তারা নিয়েছে। নিজেদের শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং সহযোগীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটাচ্ছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বাস্তবায়নের জন্য ‘আকাস’ হচ্ছে জোটভিত্তিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা। এটা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতিকে নিশ্চিত করবে।

একটা বিষয় প্রায় সবারই জানা, ২০২০ সালেও চীন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার উত্তেজনা যদি স্থায়ী হয়, তবে দুই দেশ এই অঞ্চলে তাদের অংশীদার বাড়াতে চেষ্টা করবে। সে ক্ষেত্রে আসিয়ান গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল হয়ে উঠবে। আসিয়ানের দেশগুলো আমেরিকার সঙ্গে চীনের ‘দায়িত্বশীল প্রতিযোগিতা’র ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে। এটাকে কাজে লাগিয়ে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বাড়াতে পারে। এদিকে জার্মানিসহ ইউরোপের অনেক দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতার বর্তমান যে চিত্র তাতে চীনের সঙ্গে খোলাখুলি বড় কোনো বিবাদে জড়িয়ে যাওয়া তাদের জন্য কষ্টকর হবে বলে অধিকাংশ বিশ্লেষক মনে করেন। চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান বাণিজ্য সহযোগী দেশ। ইইউ এবং চীনের মধ্যে গত বছর বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। চীনে ইইউ জোটের দেশগুলোর রপ্তানি ছিল ২০ হাজার ৩০০ কোটি ডলার।

ইউরোপের শিল্পোন্নত কয়েকটি দেশের সঙ্গে, বিশেষ করে জার্মানি এবং ইতালির সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বছরে বছরে বাড়ছে। জার্মানির বড় বড় অনেক শিল্পের প্রধান বাজার এখন চীন। এ কারণে, গত সাত বছর ধরে দেন-দরবারের পর চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে কয়েক মাস আগে দীর্ঘমেয়াদি একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে, যদিও উইঘুর ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা পাল্টা-নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ওই চুক্তির চূড়ান্ত অনুমোদন স্থগিত হয়ে রয়েছে। কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ মাহমুদ আলি বলেন, যদিও চীনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক এখন ততটা ‘স্থিতিশীল নয়, কিন্তু গত ১০ বছর ধরে চীন আলাদা আলাদাভাবে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছে। চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তদের বিআরআইয়ের আওতায় ইতালি, গ্রিস, হাঙ্গেরি এবং সার্বিয়ায় অনেক বিনিয়োগ করেছে।

ফলে, চীনের ইস্যুতে ইউরোপে ঐক্যবদ্ধ কোনো অবস্থান এখন আর নেই। একেক দেশের দৃষ্টিভঙ্গি একেক রকম। আমেরিকা চীনকে যতটা হুমকি হিসেবে দেখছে, যতটা প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে, ইউরোপের অনেক দেশ সেভাবে দেখছে না, ভাবছে না। চীনকে দেখে নিতে আমেরিকার যতটা একরোখা, ইউরোপের বহু দেশই তা নয়। গত কয়েক বছর ধরে চীনকে নিয়ে আমেরিকায় রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং প্রতিরক্ষাবিষয়ক যেসব সরকারি নথিপত্র তৈরি হয়েছে তাতে পরিষ্কার যে, তারা চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে উইঘুর ইস্যুতে আমেরিকার সঙ্গে তাল মেলানোর পাশাপাশি, সম্প্রতি ব্রিটেন এবং ফ্রান্স দক্ষিণ চীন সাগরের প্রভাব বিস্তার নিয়ে চীনের সঙ্গে চলমান রেষারেষিতে আমেরিকার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করতে ওই অঞ্চলে মহড়ার জন্য যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছে। তারপরও চীন বিশ্বাস করে আমেরিকা এখন তাদের যে চোখে দেখে, ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গি ততটা কট্টর নয়। চীনের ব্যাপারে তাদের উৎকণ্ঠা রয়েছে, কিন্তু আমেরিকার মতো তাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি এখনো নেই। তবে আলাপ-আলোচনা কিংবা আরো নতুন কোনো উপায়ে জোট হিসেবে কিংবা আলাদা দেশ হিসেবে আসিয়ান তাদের ভূমিকা পালন করতে পারে। আসিয়ান এবং এই অঞ্চল, আমেরিকা ও চীনের মধ্যকার সর্বাত্মক প্রতিযোগিতাকে দায়িত্বশীল প্রতিযোগিতায় রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close