এ কে এম এ হামিদ

  ২৪ নভেম্বর, ২০২১

পর্যবেক্ষণ

টেকসই মানব উন্নয়নের পূর্বশর্ত

সম্প্রীতি শব্দটি সম্পর্কের দিক থেকে বহুমাত্রিক। ব্যক্তিক, পারিবারিক ও সমষ্টিগত বিচারে তা ধর্মীয় সম্প্রদায়গত, শ্রেণিগত, জাতিগত, এমনকি রাষ্ট্রিক ও বৈশ্বিক। যেকোনো সমৃদ্ধ ও উন্নত জাতি-রাষ্ট্র গঠনের জন্য ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সম্প্রীতির পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান জনশক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। উন্নয়ন বা সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সম্প্রীতি, আধুনিক জ্ঞান ও কর্মনৈপুণ্য একটি অপরটির পরিপূরক। এ তিনটি সমন্বয় ছাড়া উন্নয়ন ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। কেননা, এর একটির ব্যত্যয় ঘটলে জাতীয় জীবনের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে বাধ্য। এই স্থিতিশীলতার জন্য দেশের জনগণের মধ্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক ও জাতীয় দায়বদ্ধতার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যা শুধু উন্নয়ন চিত্র দিয়ে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। একটি জাতির সমষ্টির মনন জগৎ সমৃদ্ধ না হলে ওই জাতি বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যতই উন্নতির আবরণে আবিষ্ট হোক না কেন, প্রকৃতার্থে ওই জাতি সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারে না। এই সমৃদ্ধির পথে এগোতে হলে সমষ্টির চিন্তার জগৎ মানবিক ধ্যান-ধারণায় পরিপুষ্ট হতে হবে; ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশার ঊর্ধ্বে উঠে জ্ঞান ও কর্মপ্রেরণার সমন্বয় সাধনে মনোযোগ দিতে হবে। জাতীয় চিন্তা-চেতনা, দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গির ধ্যান-জ্ঞান, কর্মপ্রেরণায় ভেদাভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। এর ব্যত্যয়ে যখন ধর্মীয় কিংবা শ্রেণি বিভাজনে সমষ্টির জ্ঞান ও কর্মশক্তি বিভাজিত হবে, তখন জাতীয় জীবনের স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে বাধ্য। সম্প্রীতির উষ্ণ মানবিক বন্ধনই একটি দেশ-জাতিকে প্রকৃত মানবিক জাতি-রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে।

বিষয়টি উপলব্ধি করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সব ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সহাবস্থান ও সমান অধিকারের গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক, তারা হীন-নিচ; তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে, সে কোনো দিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। অনুরূপ প্রবল আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিন্তা-চেতনায়। তিনি যথার্থই বলেছিলেন, মানবতার এই মহান যুগে একবার/গণ্ডি কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বল যে,/তুমি ব্রাহ্মণ নও, শূদ্র নও, হিন্দু নও, মুসলমানও নও,/তুমি মানুষ-তুমি ধ্রুব সত্য। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের এই প্রবল আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। তখন এ দেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, বাঙালি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। সম্প্রীতির মেলবন্ধনে এই যুদ্ধে কেউ প্রশ্ন করেনি- আপনি কোন ধর্মের বা সম্প্রদায়ের মানুষ কিংবা আপনার শ্রেণি-পেশার পরিচয় কী? এটাই ছিল একটি পরাক্রমশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের মূল শক্তি।

সম্প্রীতির পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি সমৃদ্ধ জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় সহায়ক ভূমিকা রাখে। বিষয়টির উপলব্ধি করে ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনকে জাতীয় শিক্ষাদর্শনের রূপরেখার পরামর্শ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষা দর্শন অনুযায়ী শিক্ষার জন্য শিক্ষা নয় বা কেরানি সৃষ্টি বা আজ্ঞাবহ সৃষ্টির জন্য নয়। আমি চাই, আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান শিক্ষাব্যবস্থা। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া স্থিতিশীল রাখার জন্য ওই দেশের নাগরিকদের দক্ষতা জ্ঞান ও উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, যেসব দেশের কারিগরি শিক্ষা ও দক্ষতা উচ্চমানের, ওইসব দেশ বৈশ্বিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনেক বেশি কার্যকর এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়াও অনেকটা স্থিতিশীল। আধুনিক শিক্ষা ও উন্নয়ন ধারণায় বলা হয়ে থাকে- ‘ইফ এডুকেশন ইজ দ্য কি টু ডেভেলপমেন্ট দেন টিভিইটি ইজ দ্য মাস্টার কি’। সংগত কারণেই বিষয়টি অনুধাবন করে জীবন দর্শন ও জীবন চাহিদার আলোকে স্বাধীন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি প্রথম শিক্ষা কমিশনকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, দেশবাসী চায় শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে নতুনভাবে বিন্যাস করা হোক। আমিও তাই আশা করি। এদিকে, নজর রেখে শিক্ষা কমিশন বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের চাহিদা অনুযায়ী বাস্তবানুগ সুপারিশ ত্বরান্বিত করবে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষা দর্শন অনুযায়ী শিক্ষার জন্য শিক্ষা নয় বা কেরানি সৃষ্টি বা আজ্ঞাবহ সৃষ্টির জন্য নয়; আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান শিক্ষাব্যবস্থা। তবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর শাসকগোষ্ঠী সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে জীবনমুখী করার বাস্তব প্রয়াস নেয়নি। অথচ শিক্ষাব্যবস্থায় পেশাগত দক্ষতার বিষয়টি যুক্ত হওয়া প্রয়োজন ছিল। কেননা, শিল্প কারখানার চাহিদাভিত্তিক পেশার সঙ্গে পরিচিত শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশের শ্রমবাজারের চাহিদা ও জোগানের সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম। মূলত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেকোনো জাতির উন্নয়ন পরিক্রমা ও এর স্থিতিশীলতা অধিকতর সম্পর্কিত। এই বাস্তব ধারণাটি জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় বরাবর উপেক্ষিত হওয়ায় দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক ও কাক্সিক্ষত মাত্রায় উন্নয়নে অবদান রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।

আমাদের বুঝতে হবে, আজ যে উন্নয়নের বীজ বোপিত হচ্ছে, সেটির ধারাবাহিকতা ধরে রেখে প্রজন্মের পর প্রজন্মের জীবন সমৃদ্ধি অব্যাহত রাখাই হলো সেই উন্নয়নের সার্থকতা। প্রযুক্তির গণমুখী ব্যবহার, উন্নয়ন-মানবদক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনাচরণ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। প্রযুক্তি যেমন আশীর্বাদ হয়ে আসে, তেমনি এর অপব্যবহার বা প্রায়োগিক কৌশলের ঘাটতি সভ্যতায় বিশাল বিপর্যয় ঘটাতে পারে। তাই সভ্যতার ধারাবাহিকতায় মানব উন্নয়নে প্রযুক্তিজ্ঞানের পাশাপাশি জীবন চাহিদার আলোকে এর সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিশ্বের সঙ্গে তালমিলিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সঠিক সময়ে বাস্তবমুখী না হওয়ায় প্রকৃতার্থে মানব উন্নয়ন সাধিত হয়নি। বরং লক্ষ্য করা গেছে, মানবিক উৎকর্ষ সাধনে জীবনবোধকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে কখনো প্রকৃতি বিজ্ঞান তথ্যপ্রযুক্তিকে অবহেলা করা হয়েছে, আবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞানকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে গিয়ে জীবনবোধ কেন্দ্রিক শিক্ষাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে শিক্ষার মাধ্যমে আমরা প্রকৃত দেশপ্রেমিক সুনাগরিক গড়ে তুলতে পারিনি। যে শিক্ষিত সমাজ অন্ধকারকে দূর করে আলোর পথে জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার কথা, সেখানে অপ্রত্যাশিতভাবে লক্ষ্য করা যায়- তাদের অধিকাংশের কর্মযজ্ঞে জীবনবোধ, রাষ্ট্রচিন্তা, উন্নয়ন দর্শন হোঁচট খাচ্ছে। এখানেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল দুর্বলতা।

উন্নয়ন এমনই একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া, যেটি কেবল অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচককে নির্দেশ করে না; এর সঙ্গে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আর্থিক প্রবাহ, গতিশীলতা বা মানব নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোও ব্যাপকভাবে জড়িত। মূলত মানব উন্নয়নের সামগ্রিক সূচকই উন্নয়নের গতিপথ নির্দিষ্ট করে দেয়। ‘দ্য হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট-১৯৮০’-তে স্পষ্টতই বলা হয়েছে, ‘ওয়ান্স দ্য আইডিয়া দ্যাট আওয়ার প্ল্যানেট হ্যাড লিমিটিস দ্যাট নিডেড টু বি রেসপেকটেড গ্রেও, টুগেদার উইথ দ্যআইডিয়া দ্যাট প্রগ্রেস ইজ নট অনলি অ্যাবাউট ইকোনমিক গ্রোথ, ইন্টেগ্রেটেড সল্যুশনস স্টারডেট টু ডেভেলপ- অ্যাজ ইজ দ্য কেস উইথ দ্য হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স (এইচডিআই)।’ প্রযুক্তি বিপ্লবে ভর করে সাময়িক যে অগ্রগতির ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়, তা অর্থনৈতিক এবং শিল্প কার্যক্রম পরিবেশ ও সামাজিক ভারসাম্যের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এ ধরনের বিরূপ প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে নাড়া দিলে টেকসই বা স্থিতিশীল উন্নয়নের বিষয়টি সামনে চলে আসে। ব্রন্ডল্যান্ড কমিশন (১৯৮৭) টেকসই উন্নয়নের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজস্ব চাহিদা মেটানোর ক্ষমতাকে বজায় রেখে বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা মেটানোকে টেকসই বা স্থিতিশীল উন্নয়ন বলে। এই স্থিতিশীল উন্নয়নের বৈশিষ্ট্য হলো (ক) পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নমূলক কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে সাহায্য করে, (খ) প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূপ্রাকৃতিক পরিবেশের গুণগতমান বজায় রেখে মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করে। স্থিতিশীল উন্নয়নের স্বার্থে স্থিতিশীল পরিবেশ, পৃথিবী, মানব উন্নয়ন, শান্তি ও বিকাশ, অপচয় হ্রাস ও টেকসই প্রযুক্তির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

এসব অর্জনে সর্বপ্রথম মানব উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা, মানব উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে টেকসই বা স্থিতিশীল উন্নয়ন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বস্তুত বিষয়টি উপলব্ধি করে এ দেশের বৃহত্তর পেশাজীবী সংগঠন ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশের (আইডিইবি) ৫১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও গণপ্রকৌশল দিবস-২০২১-এর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সম্প্রীতি সমৃদ্ধ জাতি গঠনে আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান শিক্ষা’। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন পূরণের পথ মসৃণ হোক।

লেখক : সভাপতি

ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি)

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close