রেজাউল করিম খোকন

  ২৪ নভেম্বর, ২০২১

দৃষ্টিপাত

বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি শেখ হাসিনার আহ্বান

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক মানবতার অভিন্ন স্বার্থে দৃঢ় অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মহামারি বহু মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে এবং আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে উল্লেখ করে জাতিসংঘ সংস্থার ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ইউনেস্কো সদর দপ্তরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেছেন, এটি আমাদের উদ্ভাবনী কাজ এবং গতির মাধ্যমে বেঁচে থাকতেও শিখিয়েছে। মহামারি থেকে পুনরুদ্ধারের পথে থাকা বিশ্বের সামনে চারটি পরামর্শ তুলে ধরে তিনি বলেন, আসুন আমাদের বিশ্ব মানবতার অভিন্ন কল্যাণের জন্য দৃঢ় অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে এই মুহূর্তটি কাজে লাগাই।

বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম। করোনা মহামারির ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করছে করোনা প্রতিরোধী টিকাগুলো। শুরুতে এক আর দুই ডোজের টিকার প্রাধান্য দেওয়া হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টিকার কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় এখন বুস্টার ডোজের কথা ভাবা হচ্ছে। এমনিতেই টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর চেয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো বেশ পিছিয়ে। আবার টিকাদান কার্যক্রমও ধীরগতিতে চলছে এই দেশগুলোতে। এভাবে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকলে ২ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। এই ক্ষতির মুখে পড়বে মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলো। ওদিকে বুস্টার ডোজ নিয়ে কোটি কোটি ডলারের মুনাফা কামানোর স্বপ্ন দেখছে টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। অপ্রিয় হলেও নির্মম বাস্তব সত্যি হলো, সাধারণ মানুষের টিকা প্রাপ্তির বিষয়টি মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করা হচ্ছে না। টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো কোটি ডলার কামানোর ধান্দায় রয়েছে। তাই সাধারণ মানুষ যাতে টিকা নিতে পারে, জীবন বাঁচাতে পরে সেজন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে আরো সোচ্চার হতে হবে। বাংলাদেশের মতো উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর টিকাদান কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আগের তুলনায় করোনার টিকার জোগান অনেকটাই শক্তিশালী করেছে বাংলাদেশ সরকার। অন্ততপক্ষে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কোথাও ক্রয় চুক্তি, আবার কোথাও বিনামূল্যে টিকা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি আদায়ে সক্ষম হয়েছে। যদিও এরমধ্যে কোনো কোনো দেশ বা সংস্থার সময়মতো প্রতিশ্রুতি বা চুক্তি না রাখার নজিরও তৈরি হয়েছে। ফলে সরকার টিকার গতি বাড়িয়েও তা ধরে রাখতে পারছে না, গতি একটু বাড়ালেই হোঁচট খেতে হচ্ছে বারবার। শুরুর দিকে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছিল টিকা আমদানি ও সরবরাহের জন্য। কিন্তু বাস্তবে এখন পর্যন্ত দেশের কোনো বেসরকারি উদ্যোক্তা কিংবা প্রতিষ্ঠানকে এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না। তবে প্রকাশ্যে না থাকলেও অনেকেই সরাসরি বিদেশের নির্দিষ্ট কোম্পানির কাছ থেকে টিকা এনে সরকারকে সরবরাহের জন্য তৎপরতা চালাচ্ছে। শুধু আমদানিই নয়, যথেষ্ট সুযোগ থাকার পরও টিকা উৎপাদনে গতি আসছে না বেসরকারি উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় মাত্রায় সুযোগ না দেওয়ার কারণে। স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে টিকার সুষম বণ্টন না হলে শুধু পশ্চিমা দেশগুলোতে বুস্টার ডোজ প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হলে বিশ্বজুড়ে করোনায় মৃত্যুহার আরো বাড়বে। কারণ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো তাদের নাগরিকদের জন্য এখনো করোনার টিকার প্রথম ডোজই নিশ্চিত করতে পারেনি। এজন্য বুস্টার ডোজ স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকা, চীনের তৈরি সিনোফার্ম, ফাইজার এবং মডার্নার ভ্যাকসিন। দেশে টিকা উৎপাদনের ক্ষেত্রে আরো সুযোগ থাকলেও সরকার তা ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারছে না। শুধু দেশীয় সমস্যাই নয়, বৈশ্বিক পরিস্থিতির শিকার হয়েও টিকায় বাংলাদেশ প্রত্যাশিত জায়গা থেকে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। অন্য দেশগুলো আগেভাগে টিকা কিনে ফেলায় এখন সরকারের হাতে টিকার জন্য পর্যাপ্ত টাকা থাকলেও সময়মতো টিকা পাচ্ছে না বাংলাদেশ। এখন সব দেশই সরকারের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক এবং অন্যান্য বিষয়ে বোঝাপড়ার মাধ্যমে টিকা ছাড় করছে বা চুক্তি করছে।

ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম ধীরগতির কারণে ক্ষতির মুখে পড়বে মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলো। টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর চেয়ে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেক পিছিয়ে আছে। এরই মধ্যে উন্নত দেশগুলো তাদের নাগরিকদের বুস্টার ডোজ দিতে শুরু করেছে। যেখানে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য টিকা সরবরাহের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা অপ্রতুল রয়ে গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব দেশ ২০২২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাদের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ টিকা দিতে ব্যর্থ হবে তারা ২০২২-২৫ মেয়াদে দুই ট্রিলিয়ন ইউরোর সমান ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ইআইইউ বলেছে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো এই ক্ষতির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বহন করবে এবং উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক দূরত্ব বেড়ে যাবে। তারা সতর্ক করেছে, টিকা বিলম্বিত হওয়ায় অসন্তোষ বাড়তে পারে এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে সামাজিক অস্থিরতার ঝুঁকি বাড়বে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা প্রায় মোট ক্ষতির তিন-চতুর্থাংশ। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে টিকাদান কার্যক্রম মন্থর গতিতে এগিয়ে চলছে। আজ এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, দরিদ্র দেশগুলোকে টিকা সরবরাহে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বাস্তব পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সাধারণ মানুষের টিকা প্রাপ্তির ব্যাপারে মানবিক দিক বিবেচনা করা হচ্ছে না। এমনিতেই টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেক পিছিয়ে আছে। আর টিকাদান কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতির সম্মুখীন হবে এই দেশগুলো। তাই সাধারণ মানুষ যাতে টিকা নিতে পারে, জীবন বাঁচাতে পরে সেজন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে আরো সোচ্চার হতে হবে। করোনা মহামারির ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসতে শুরুতে এক আর দুই ডোজের টিকার প্রাধান্য দেয় টিকা উৎপাদনকারী সংস্থাগুলো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টিকার কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় বুস্টার ডোজের পরামর্শ দিচ্ছে তারা। আর এই বুস্টার ডোজ নিয়ে কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখছে টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। এদিকে বুস্টার ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া দেশের তালিকা দিন দিনই বাড়ছে। যে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কোভিড টিকা তৈরি ও সরবরাহ করছে, তারা অতি মুনাফা না করলে মানুষ হয়তো পাঁচ ভাগের একভাগ দামে টিকা পেত। করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক মানবতার অভিন্ন স্বার্থে দৃঢ় অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি শেখ হাসিনার আহ্বান সবাইকে নতুনভাবে আলোড়িত করেছে। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে উজ্জ্বল, সমৃদ্ধ, মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে- নিঃসন্দেহে বলা যায় এটা। এটা বিশ্ববাসী গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে, এখন তিনি শুধু বাংলাদেশের নেত্রী হিসেবেই নন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একজন শক্তিশালী নেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এটা আমাদের জন্য অবশ্যই গর্বের বিষয়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close