সাহাদাৎ রানা

  ২৩ নভেম্বর, ২০২১

মুক্তমত

গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ হোক

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির খবর সব সময়ই আলোচিত খবর হয়ে আসে সবার কাছে। সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির খবরও সবার সামনে এসেছে। তবে সেই খবর আর বড় খবর হয়ে থাকেনি। তেলের মূল্যবৃদ্ধির খবরকে পাশ কাটিয়ে গণপরিবহনের মালিকদের অতিরিক্ত ভাড়া বৃদ্ধির খবর হয়ে উঠে আলোচিত। শুধু আলোচিতই নয়, ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘটের ডাকও দেয় মালিক ও শ্রমিকরা। এখানেই থেমে থাকেনি। সারা দেশের যাত্রীদের জিম্মি করে তারা জিতেও যায়। আর হেরে যায় সাধারণ জনগণ। প্রতিদিনই বাসভাড়াকে কেন্দ্র করে যাত্রীদের সঙ্গে চালক ও সহকারীর সঙ্গে বাগবিকণ্ডা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, যাত্রীর সঙ্গে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটছে। এক্ষেত্রে সরকার ঘোষিত নির্ধারিত ভাড়ার নিয়মও মানা হচ্ছে না।

তবে ভাড়া বৃদ্ধির খবরে অবশ্য শুরু থেকেই বাসে যাত্রীদের সঙ্গে ঘটছে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। বেশি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগে এমন ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। গত শনিবার শনির আখড়ায় একটি বাসে এক কলেজছাত্রী অর্ধেক ভাড়া দিতে চাইলে তাকে বাসচালকের সহকারীর ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার ঘটনা সর্বশেষ উদাহরণ। এমন ঘটনার খবর সত্যিই সবার জন্য উদ্বেগের। ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে ঝগড়ার মূল কারণ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধির কোনো তালিকা বা কাগজপত্র প্রদর্শন করছে না বাস মালিক-শ্রমিকরা। বরং নিজেদের ইচ্ছামতো তারা ভাড়া আদায় করছে। এ কারণে যাত্রীদের সঙ্গে বাগবিক-ায় জড়িয়ে পড়ছেন। এখানে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, যাত্রীরা আসলে বুঝতে পারছেন না কোন বাস ডিজেলে আর কোন বাস সিএনজিতে চলছে। এ ক্ষেত্রে সিএনজি ও ডিজেলচালিত বাসের শনাক্তকরণ চিহ্ন হিসেবে স্টিকার লাগানোর নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। সব বাসের মধ্যে যদি সিএনজি ও ডিজেল চালিত বাসের শনাক্তকরণ চিহ্ন হিসেবে স্টিকার লাগানোর নির্দেশনা মানা সম্ভব হয় তবে কিছুটা হলেও নৈরাজ্য কমবে। অবশ্য কয়েক দিন ধরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে। তারা অনিয়ম পেলেই জরিমানা করছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়মিত পরিচালিত হলে কিছুটা হলেও অস্থিরতা কমবে। কিন্তু এমন অভিযানের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

সম্প্রতি গণপরিবহনে যাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি ১৩ দফা দাবি জানিয়েছে। যাত্রীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এসব দাবিগুলোর দিকে এবার একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক। ১. ডিজেলচালিত স্টিকার লাগিয়ে বাড়তি ভাড়া আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে বিআরটিএ প্রণীত বাসভাড়ার তালিকা বাসে স্থায়ীভাবে লাগানোর ব্যবস্থা করা। ২. মালিকদের নির্দেশে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় বন্ধ করে সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায়ের বিষয় নিশ্চিত করা। ৩. অন্যায়ভাবে কোনো যাত্রীকে যাতে কোনোভাবে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নৈরাজ্যের মাধ্যমে অপমান অপদস্ত হতে না হয়, তার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করা। ৪. ওয়েবিলে যাত্রী গুনে ভাড়া আদায়ের নামে সিটিং সার্ভিসের নামে ভাড়া-ডাকাতি বন্ধে শুধু মৌখিক ঘোষণা নয়, কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। ৫. সিটিং সার্ভিসে বাস চালালেও ভাড়া নির্ধারণের শর্তানুযায়ী গড়ে ৭০ শতাংশ যাত্রীবোঝাই করে সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় বাস চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিশ্চিত করতে হবে। সিটিং সার্ভিসবিহীন বাসে দাঁড়ানো যাত্রীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নিতে হবে। ৬. ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ডিজেলচালিত বাস-মিনিবাসের ভাড়া বৃদ্ধির সুযোগে সিএনজিচালিত বাস-মিনিবাসের পাশাপাশি হিউম্যান হলার, লেগুনা, টেম্পু, অটোরিকশায় যে হারে ভাড়া নৈরাজ্য চলছে তা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ৭. যাত্রী প্রতিনিধি ছাড়া মালিক-সরকার মিলে একচেটিয়াভাবে বাড়ানো ভাড়া বাতিল করে একটি ন্যায্য ও গ্রহণযোগ্য ভাড়া নির্ধারণ করা। ৮. ঢাকা-চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৫৫ শতাংশ যাত্রী তিন কিলোমিটারের কম দূরত্বে যাতায়াত করে। তাই সিটি সার্ভিসে সর্বনিম্ন বাসভাড়া দুই কিলোমিটার পর্যন্ত পাঁচ টাকা নির্ধারণ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর জন্য আলাদা আলাদা ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। ৯. ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে বিআরটিএর প্রতীকী অভিযান বন্ধ করে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করতে হবে। ১০. দূরপাল্লার রুটে ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে কিলোমিটার চুরি ও ভাড়ার তালিকা জালিয়াতি বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। ১১. ভাড়া নির্ধারণের শর্ত লঙ্ঘন করে দৈনিক চুক্তিতে চালক-হেল্পারের কাছে বাস ইজারা দেওয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। ১২. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি, পুলিশের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ১৩. কথায় কথায় যেকোনো ঠুনকো অজুহাতে গণপরিবহন বন্ধ করে দিয়ে যাত্রীদের জিম্মি করার মতো আইনবিরোধী কর্মকা- বন্ধ করতে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির এসব দাবি যৌক্তিক। এসব দাবিগুলো বাস্তবায়ন হলে অনেকাংশে গণপরিবহনে নৈরাজ্য বন্ধ হবে। তবে এসব দাবি বাস্তবায়নে সরকারের নীতি নির্ধারকদের আন্তরিক হতে হবে।

বাসের ভাড়া বৃদ্ধির ঘটনার পর নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি কমাতে ‘সিটিং’ ও ‘গেটলক’ বাস সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন মালিকরা। কিন্তু ঘোষণার পরও তা কার্যকর হচ্ছে না। মালিকরা তাদের ইচ্ছামতো ‘সিটিং’ ও ‘গেটলক’ বাস সার্ভিস চালিয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না। সিটিং সার্ভিসের কথা বলে বাড়তি যাত্রী তোলা হয়। গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে যাতায়াত করতে হয় যাত্রীদের। তাই নামে সিটিং সার্ভিস হলেও কার্যক্ষেত্রে চিত্র ভিন্ন। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে ন্যায্য ভাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের দেশের যাত্রীদের দুর্ভাগ্য কখনো চাহিদা অনুযায়ী উন্নত বাস সার্ভিস চালু হয়নি। বিশেষ করে রাজধানীতে। বিভিন্ন সময়ে রাজধানীতে বাসের সংখ্যা বাড়লেও সেবার মান বাড়েনি। বরং দিন দিন তা কমেছে। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। বাসভাড়া বৃদ্ধির খবরে যা আবারও সামনে আসল। কিন্তু এখন আর পেছনে ফিরে তাকালে হবে না। আগামীতে যেন কেউ যাত্রীদের জিম্মি করে ইচ্ছামাফিক ভাড়া আদায় করতে না পারে সে বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। তবেই গণপরিবহনে নৈরাজ্য অনেকাংশে কমে আসবে। আর রাজধানীর শনির আখড়ায় কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া বাসচালক ও তার সহযোগীর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। বিষয়টি নিশ্চিত হলে স্বস্তি পাবেন যাত্রীরা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close