আসিফ হোসেন

  ২২ নভেম্বর, ২০২১

মুক্তমত

আধুনিকতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

পরিবর্তন পৃথিবীর এক অপরিহার্য সত্য। পরিবর্তন থেকেই জন্ম নিয়েছে আজকের এই অত্যাধুনিক বিশ্ব। দুই যুগ আগের সময়ের সঙ্গে বর্তমানকে তুলনা করলে বিজ্ঞান ও আধুনিকতার চরম বিপ্লবকে উপলব্ধি করা একদমই কষ্টসাধ্য নয়। এসব পরিবর্তন আমাদের কাজকে সহজ, সাশ্রয়ী, কম সময় ক্ষেপণ করছে। সেইসঙ্গে সৃষ্টি করছে অনেক দুরূহ সমস্যারও। আধুনিকতার স্পর্শে উন্নত হচ্ছে পুরো দুনিয়া। আবার এটাই কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের জন্য। এক দিকে মানুষের মহামূল্যবান সময় রক্ষা পাচ্ছে। অন্য দিকে, কিছু আবিষ্কার আমাদের ব্যস্ত করেছে মূল্যহীন সব কাজে। জীবন রক্ষাকারী সব খোঁজ আজ প্রাণ হরণকারী আয়োজনে পরিণত হচ্ছে। অভূতপূর্ব আবিষ্কার দ্বারা তৈরি হচ্ছে আকাশচুম্বী স্থাপনা। আবার এরই মাধ্যমে ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের আঙিনা। প্রতিটি মুদ্রার ভিন্ন দুই পৃষ্ঠের মতো প্রতিটি বিষয়েরও থাকে ভিন্ন চেহারা। বিজ্ঞান ও আধুনিকতার বিশাল বিপ্লবের আড়ালেও বিশ্ব ও মানবজাতি সম্মুখীন হচ্ছে অপূরণীয় সব ক্ষয়ক্ষতির। বিজ্ঞানের হাত ধরে বহু সমস্যার সমাধান আসছে, সেইসঙ্গে আসছে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। যা দিন দিন রূপ নিচ্ছে বড় থেকে বৃহত্তরের। বিশেষজ্ঞদের কপালে টানছে চিন্তার রেখা।

ঘোড়ার গাড়িকে সরিয়ে তার স্থান করে নিয়েছে মোটরযান। ডাকবিভাগকে রিটায়ার্ড করে দিচ্ছে ই-মেইল। এখন আর অন্ধকারে রাত্রি অতিবাহিত করার প্রয়োজন নেই। গ্রীষ্মের মৌসুমে হাত পাখার ব্যবসাও বিলুপ্তপ্রায়। কুঁড়েঘরগুলোর আর তেমন দেখা মেলে না, গড়ে উঠছে বিশাল বিশাল স্থাপনা। আকাশের দিকে তাকালেই বিমান, হেলিকপ্টারের অবাধ বিচরণ। এসব তো রোগের প্রতিষেধক। তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো কী?

চলছে পৃথিবী আপন গতিতে। আর মানুষ বিশ্বকে উন্নত করছে দুর্বার গতিতে। মানবসভ্যতার পথে যত বাধা, সমস্যা এসেছে মানুষই তার সমাধা করেছে। তবে, প্রতিটা সমাধানই যেন জন্ম দিচ্ছে আরো জটিল কিছু। প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল ডিনামাইট তৈরি করেছিলেন পাহাড়, অনাকাক্সিক্ষত স্থাপনা ধ্বংস করে মানুষের নির্মাণকাজকে প্রগতিশীল করার জন্য। এর পেছনে যতই মহান উদ্দেশ্য থাকুক না কেন, বর্তমানে মানুষ হত্যায় বহুল ব্যবহৃত অস্ত্র কিন্তু এটিই। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, আরডিএক্স, টিএনটি, এইচএমএক্স প্রতিটি বিস্ফোরক পদার্থের আবিষ্কারের ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা ডিনামাইটের অনুরূপ। দেশে দেশে সহিংসতা ও আতঙ্ক সৃষ্টিতে সুপরিচিত। আগে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে পাড়ি দিতে হতো নদী, পাহাড়, সমুদ্র। কয়েক মাসের যাত্রা শেষে ক্লান্ত শরীর পৌঁছাত গন্তব্যে। আবার কিছু ক্ষেত্রে মৃত শরীর। এত ভোগান্তি ও জটিলতার প্রতিষেধক হয়ে আসল মোটরযান, রেল, নৌযান ও আকাশযান।

একইভাবে, আদিকাল ও আধুনিক যুগের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য সৃষ্টি করেছে বিদ্যুৎ। বিজ্ঞানের আজ পর্যন্ত সবচেয়ে মূল্যবান আবিষ্কার হিসেবে বিদ্যুৎকে চিহ্নিত করলে ভুল হবে না। বিদ্যুতের উপস্থিতি ব্যতীত আধুনিক বিজ্ঞানকে কল্পনা করা কোনোভাবে সম্ভব নয়। বিদ্যুতের গুরুত্ব যেমন সীমাহীন, এর ক্ষতিকর দিকগুলো তেমনই অপূরণীয়। এগুলোর প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক হলেও এর বিরূপ প্রভাবকে অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় নেই।

আজ বিশ্ববাসীর জন্য সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা। যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ার সিংহভাগই কার্বন মনোঅক্সাইড নামক বিষাক্ত গ্যাস। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও শিল্প কারখানাগুলোর ধোঁয়া থেকে বস্তুকণা, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সিসাসহ অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। এগুলো এক দিকে দূষিত করছে বায়ু। অপর দিকে, বাড়িয়ে চলছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। যার ফলে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। ডুবে যাচ্ছে সমুদ্র তীরবর্তী বহু নিচু এলাকা। লবণাক্ত হয়ে পড়ছে লাখ লাখ হেক্টর কৃষি জমি। সেইসঙ্গে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণার তথ্য মতে, দেশে কালো ধোঁয়ার কারণে প্রতি বছরে মারা যাচ্ছে ৮৫ হাজারের বেশি মানুষ। যার মধ্যে শহরাঞ্চলের লোকজনের সংখ্যা বেশি।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, কালো ধোঁয়ায় থাকা বস্তুকণা ও সালফার ডাই-অক্সাইডের প্রভাবে ফুসফুস, কিডনি জটিলতা ও হৃদরোগের ঝুঁকি রয়েছে। এ ছাড়া নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও সিসার কারণে শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস ও শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তি ব্যাহত হয়। সেইসঙ্গে এসব গ্যাসের ফলে ‘পৃথিবীর রক্ষাকবচ’ বায়ুম-লের ওজন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেটা সূর্য থেকে নির্গত ক্ষতিকর অতিবেগুনি তেজস্ক্রিয় রশ্মিকে পৃথিবীতে আসতে বাধা দেয়। এই রশ্মির কারণে ত্বকের ক্যানসার থেকে শুরু করে চোখের বড় রকমের ক্ষতি হতে পারে। তবে, দুঃখজনকভাবে আমাদের কার্যক্রমে স্তরটিতে ছিদ্র হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, শিল্প কারখানা ও যানবাহনে ব্যবহার করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণে জ্বালানি। এসব জ্বালানির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তেল, গ্যাস ও কয়লা- সবটাই খনিজ পদার্থ। অনেকের মাঝে খনিজ পদার্থের পরিমাণ অসীম মনে করার এক ভ্রান্ত ধারণা পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতপক্ষে, খনিজ পদার্থের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে। যা প্রতিদিন উত্তোলিত ও নিঃশেষ হচ্ছে। নতুন খনিজ পদার্থ সৃষ্টি হওয়া খুবই জটিল ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের ব্যবহার করা খনিজ সম্পদ ভূগর্ভে সৃষ্টি হতে সময় লেগেছে কয়েক হাজার বছর। এসব প্রয়োজনীয় সম্পদের অবাধ ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছি হুমকির মুখে। সেইসঙ্গে আমাদের এই সুন্দর ধরণী সম্মুখীন হচ্ছে কিছু অপূরণীয় ক্ষতির।

সাধারণের কাছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত এক প্রযুক্তি। এগুলো শুধু যোগাযোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। যোগাযোগ, বিনোদনের গণ্ডি পেরিয়ে এগুলো পৌঁছে গেছে অপসংস্কৃতি ও অপপ্রচারের দ্বারে। মানুষের প্রয়োজন থেকে আসক্তির রূপ নিচ্ছে। টেলিভিশন, ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফরমও অসুস্থ বিনোদনের জনপ্রিয় মাধ্যম। তরুণ সমাজের মাঝে ডিভাইস কেন্দ্রিক হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে নিছক ভার্চুয়াল জগতে। সোশ্যাল মিডিয়া যেমন সচেতন করছে সমাজকে তেমনই সমাজ ও গোষ্ঠী সহজেই গোমড়া হচ্ছে বিভিন্ন গুজবে বিশ্বাস করে। এসব হুজুগে বিশ্বাস প্রায় সময় সহিংসতা ও হানাহানির রূপ ধারণ করে। সম্প্রতি কুমিল্লার মন্দিরে পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননার বিভ্রান্ত খবর দেশজুড়ে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ ও হামলার বিষয়টি সবারই জানা। এ ছাড়া ইলেকট্রনিক ডিভাইসের অত্যাধিক ব্যবহার বিভিন্ন জটিল রোগের কারণ। এসব অনিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে সরকার ও বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

আগের মতো এখন আর খেলার মাঠ নেই। মাঠ থাকলেও খেলোয়াড় নেই। নেই শিশুদের মধ্যে দুরন্তপনা। রাতের লোডশেডিংয়ে দেখা যায় না কানামাছি খেলা। মেয়েদের পুতুল খেলা বা ছেলেদের ডাংগুলি। কুতকুত, কাবাডি, নুনতা খেলা আর কত কী। যেগুলো শিশুদের দৈনিক কাজের তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর এখন এগুলোর নামও বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানা। আধুনিক ডিভাইস, গেমসের কবলে তাদের চঞ্চলতা মৃতপ্রায়। সামাজিক ও মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের মাঝে প্রবেশ করছে কর্মবিমুখতা। মানুষের আবিষ্কার আজ মানুষকে অমানুষে পরিণত, করছেহৃদয়বিহীন এক যন্ত্রে। মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্বের প্রথম জৈবিক চাহিদার স্তর পূরণ করে ছুটছি খ্যাতি ও ব্যাংক ব্যালেন্স বৃদ্ধিতে। মানুষের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে ব্যস্ত হয়ে উঠছি নিষ্প্রাণ কাগজ, যন্ত্রের সঙ্গে। আপনজনদের থেকে ক্রমেই বাড়ছে দূরত্ব। ব্যস্ততার জালে ভুলে যাচ্ছি বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য। প্রবীণ বয়সে সঙ্গী তাদের একাকিত্ব। বাবা-মায়ের কাছে সন্তান অমূল্য, তবে সন্তানের কাছে বাবা-মা আজ মূল্যহীন এক বোঝামাত্র।

বিকৃত আধুনিকতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বলা যায়, পারমাণবিক অস্ত্রকে। এটি বিস্ময়কর এক আবিষ্কার তবে জনহিতকর কোনো কাজেই তার ব্যবহার নেই। আছে শুধু ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর এক বিশাল ক্ষমতা। ছোট আকারের একটি পারমাণবিক বোমা গোটা একটি শহরকে মুহূর্তে বিলীন করে দিতে পারে। শুধু আতঙ্ক ও ক্ষমতার মশাল জ্বালিয়ে রাখতে বেশকিছু দেশ মেতে উঠেছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও ব্যবহারে। পৃথিবী সাক্ষী হিরোশিমা নাগাসাকির ভয়ংকর ইতিহাসের। পারমাণবিক বিস্ফোরণে বাসা বাড়ি, স্কুল-কলেজের মতো প্রাণহীন স্থাপনার সঙ্গে বিলীন হয়ে যায় লাখ লাখ নিষ্পাপ মানুষের প্রাণ। এরপর কোনো পারমাণবিক হামলা না হলেও এর উৎপাদন থেমে থাকেনি। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার মতো দেশের দখলে রয়েছে হাজার হাজার পারমাণবিক অস্ত্র। নিজেদের সামর্থ্য প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করতেও তারা পিছ পা হবে না ভবিষ্যতে। পারমাণবিক অস্ত্র মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। এর ব্যবহার উৎপাদন ও ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে বিশ্ব মোড়লদের একত্রিত হতে হবে।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদ্ভাদন বন্ধ করে দেওয়া হোক, এমন কিছু আমি চাই না। এমন কিছু বলছিও না। বরং বিজ্ঞানকে ব্যবহার করা হোক এখন পর্যন্ত ঘটিত বিজ্ঞানের বিরূপ প্রভাব থেকে বিশ্বকে মুক্ত করার জন্য। উজার করা বন ভূমির বিকল্প কিছু আবিষ্কার হোক। ওজন স্তরের ছিদ্র বন্ধ করার পদক্ষেপ নেওয়া হোক। নতুন আবিষ্কৃত কিছুকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে এর সম্ভাব্য সব ক্ষতিকর দিক পূর্বানুমান ও মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। ক্ষতিকর প্রযুক্তি পরিহার করতে হবে। সেইসঙ্গে এগুলো নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণপূর্বক বাজারজাতকরণ করা আবশ্যক। একইভাবে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে। এভাবেই এক দিন বিশ্ব আধুনিকতার অদৃশ্য বেড়াজাল থেকে মুক্তি পাবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি

ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close