রাশেদুজ্জামান রাশেদ

  ২৮ অক্টোবর, ২০২১

মুক্তমত

শিক্ষা কারিকুলাম হোক সর্বজনীন

জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমের নতুন রূপরেখা অনুমোদন করেছে সরকার। স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমাদের দেশে আটবার শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষানীতির ক্ষেত্রে জাতি কখনোই সর্বজনীন-গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতির মুখ দেখেনি এবং টাকা যার, শিক্ষা তার-এ মূলমন্ত্র ধারণ করে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থায় সর্বক্ষেত্রে শাসক মুনাফা খুঁজে। শিক্ষা কী? শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? কাদের জন্য শিক্ষা, কী হবে শিক্ষার বিষয়বস্তু। এই প্রশ্নগুলো সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া রাষ্ট্রের উচিত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, যারাই ক্ষমতায় এসেছে, তারাই তাদের মতো করে শিক্ষানীতি গঠন করেছে। অর্থাৎ শাসকদের ইচ্ছা যতখানি, শিক্ষা পাবে ততখানি।

চলমান শিক্ষানীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, শিক্ষানীতিতে পঞ্চম শ্রেণির জন্য পিইসি, অষ্টম শ্রেণির জন্য জেএসসি, মাধ্যমিকের জন্য এসএসসি, উচ্চমাধ্যমিকের জন্য এইচএসসি। এই মোট চারটি পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা আছে। কিন্তু নতুন নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের এসএসসির আগে আর কোনো পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে না। এখনকার নিয়ম অনুসারে নবম-দশম শ্রেণিতে মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা নামে যে পৃথক তিনটি বিভাগ আছে, তা আর থাকবে না। জীবনের উদ্দেশ্য ঠিক করে শিক্ষার্থীরা এইচএসসিতে বিভাগভিত্তিক লেখাপড়া করবে। আবার নবম-দশম শ্রেণির পরিবর্তে শুধু দশম শ্রেণির পাঠক্রম অনুসারে এসএসসি পরীক্ষা হবে। এইচএসসি পরীক্ষার বেলায়ও পরিবর্তন আনা হয়েছে। সেখানে একাদশ শ্রেণিতে একটি পরীক্ষা এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে আরেকটি পরীক্ষা হবে। বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত দুটি পরীক্ষার ফল যোগ করে হবে এইচএসসির চূড়ান্ত ফলাফল। শিশুদের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে না। নম্বর বণ্টনেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এসএসসিতে প্রতি বিষয়ে ৫০ নম্বরের পরীক্ষা নেবে স্ব স্ব স্কুল। বাকি ৫০ নম্বরের পরীক্ষা নেবে শিক্ষা বোর্ড। এইচএসসিতে ৩০ নম্বর মূল্যায়ন করবে কলেজগুলো, আর বাকি ৭০ নম্বরের পরীক্ষা নেবে শিক্ষা বোর্ড। বোর্ডের পরীক্ষায় বিষয়গুলোও হবে বর্তমানের চেয়ে অর্ধেক। বাকি বিষয়গুলো মূল্যায়ন করবে কলেজ। নতুন পাঠক্রম অনুযায়ী ২০২৫ সালে এসএসসি এবং ২০২৬ ও ২০২৭ সালে এইচএসসির দুই পর্বের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।

শিক্ষা মানে কেবলমাত্র শুধু কিছু কারিগরি দক্ষতা বোঝায় না। দক্ষতা অর্জন করলেই কেবল একজন মানুষকে শিক্ষিত বলা যায় না। শিক্ষকদের শিক্ষাদান ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণ তথা দেহে-মনে পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠার জন্য শিক্ষাব্যবস্থা করতে হবে। রাষ্ট্র সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে নতুন এই কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে। একটি দেশে শিক্ষানীতি পরিবর্তন করা হবে অথচ বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও ছাত্র প্রতিনিধিসহ কোনো ব্যক্তির মতামত নেওয়া হলো না। এই পদ্ধতির মাধ্যমে এসএসসি পাসের পর যারা ঝরে যাবে, তারা যেন কিছু করে খেতে পারে। এজন্য শিক্ষাকে এখন কারিগরি শিক্ষা গড়ে তোলার আয়োজন করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট বিজ্ঞান না শিখিয়ে প্রযুক্তি শেখানোর মাধ্যমে তাকে প্রযুক্তিবিদ না বানিয়ে টেকনিশিন বানিয়ে রাখবে। যাদের টাকা আছে, তারাই প্রযুক্তিবিদ হতে পারবেন। আর যাদের টাকা নেই, উচ্চতর শিক্ষা নেই। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা আগে যে উচ্চতর গণিত পড়ত, সেটা একদম নেই। আর আগে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা যে আলাদা করে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান পড়ত, এখন নতুন প্রস্তাবিত কারিকুলামে তিনটিকে একত্র করে নাম দেওয়া হয়েছে বিজ্ঞান; যা আগে অষ্টম শ্রেণিতে ছিল। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, যারা বিজ্ঞান শাখা পড়ত বা বিজ্ঞানী হতে চায়, তাদের জন্য রাষ্ট্রের ব্যবস্থা কী? মাধ্যমিকে সংক্ষিপ্ত আকারে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো শেষ করে উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে হঠাৎ বিজ্ঞান বিভাগের পরিসর বেড়ে গেলে শিক্ষার্থীরা চাপের মুখে পড়বে। এতে করে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে যাবে। এই জ্ঞান নিয়ে তারা না হতে পারবে ইঞ্জিনিয়ার, না হতে পারবে ভালো ডাক্তার, না হতে পারবে ভালো পদার্থবিদ, না হতে পারবে ভালো প্রযুক্তিবিদ।

আগে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান ৩টি বিষয়ে মাধ্যমিকে ৩০০ ও উচ্চমাধ্যমিকে ৬০০ নম্বরের জন্য পড়ত। এখন ৩টি বিষয়কে এক করে দিয়ে তার সঙ্গে প্রযুক্তিও যুক্ত করে ১০০ নম্বর করা হয়েছে। বাকি নম্বরগুলো চলে গেল শিক্ষকের হাতে, এতে করে শিক্ষকদের দ্বারাই প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং-মুখী হবে শিক্ষার্থীরা। ফলে আরো শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) হিসাবে দেশে সরকারি, কিন্ডারগার্টেন, এনজিও পরিচালিত মিলিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১ লাখ ২৯ হাজার ২৫৮টি। এগুলোয় মোট শিক্ষার্থী প্রায় ২ কোটি। এরমধ্যে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩৬৬ জন। শিক্ষার্থী ১ কোটি ৪১ লাখ ৪৪৫ জন। এই হিসাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় সারা দেশে গড়ে ১ জন শিক্ষকের বিপরীতে ৩৯ জনের মতো শিক্ষার্থী আছে। ২০ হাজার ৬০০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৩ জন। আর শিক্ষক ২ লাখ ৪৬ হাজার ৮৪৫ জন। অর্থাৎ একজন শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থী প্রায় ৪২ জন। দেশে ৪ হাজার ৫৫১টি কলেজে মোট শিক্ষার্থী ৪৩ লাখ ৮৫ হাজার ২১০। আর শিক্ষক ১ লাখ ২৭ হাজার ৭৬৭ জন। প্রধান সমস্যার মধ্যে শিক্ষক স্বল্পতার চিত্র উঠে এসেছে। একজন শিক্ষক কীভাবে এতগুলো শিক্ষক পাঠদান করাবেন। তা প্রশ্ন থেকেই যায়। এরমধ্যে রয়েছে দক্ষতার ঘাটতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা।

শিক্ষা কোনো পণ্য নয়, শিক্ষা আমাদের অধিকার। ফলে সারা বছর ধরে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের মাধ্যমে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে; কিন্তু তা না করে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো সংকুচিত করে, সেখানে ধর্ম শিক্ষা, ভালো থাকা, জীবন ও জীবিকা এ রকম নতুন কিছু বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। ফলে বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য যুক্তিবাদী শিক্ষা পাঠ্যক্রম গড়ে তোলার বদলে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও উগ্রবাদীদের উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে শিক্ষা পাঠ্যক্রম। অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীর কারিকুলাম হোক সর্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, সেক্যুলার, একই পদ্ধতির গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতি।

লেখক : সংবাদকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close