মো. আরাফাত রহমান

  ২৭ অক্টোবর, ২০২১

পর্যালোচনা

কৃষিতে ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট

কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদ-, যা দেশের জিডিপিতে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অবদান রাখে। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৪ শতাংশ তাদের জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের শ্রমশক্তির প্রায় ৬৩ শতাংশ কৃষি ক্ষেত্রে নিযুক্ত রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৫৭ শতাংশই একমাত্র ফসলের উপখাতে নিয়োজিত। ফসল উৎপাদন বাড়ানোর অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক হলো ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ বা পেস্ট। ‘পেস্ট’ শব্দটি দ্বারা পোকামাকড়, প্যাথোজেন, আগাছা, নেমাটোডস, মাইটস, ইঁদুর এবং পাখির মতো জীবকে বোঝায় যা মানুষ, তার প্রাণী, ফসল বা সম্পদের ক্ষতি বা বিরক্তির কারণ হয়ে থাকে।

একটি অনুমিত পরিসংখ্যান অনুসারে, ক্ষতিকর পোকা ও কীটপতঙ্গের আক্রমণের কারণে বার্ষিক ফলন হ্রাস ধানের ক্ষেত্রে ১৬ শতাংশ, গমের জন্য ১১ শতাংশ, আখের ২০ শতাংশ, সবজির জন্য ২৫ শতাংশ, পাটের জন্য ১৫ শতাংশ এবং ডাল ফসলের জন্য ২৫ শতাংশ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে অতীতে রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণই পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক পদ্ধতি ছিল। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সরকার কীটনাশক কৃষকদের বিনামূল্যে বিনা সরবরাহ করে তাদের ব্যবহারের প্রচারণা করত। ১৯৭৪ সালে এই ভর্তুকি হ্রাস করা হয় ৫০ শতাংশে। সরকার ১৯৭৯ সালে সম্পূর্ণ ভর্তুকি প্রত্যাহার করে এবং কীটনাশক ব্যবসা বেসরকারি খাতে স্থানান্তরিত হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে ৩০৪টি নামে প্রায় ৯৬টি কীটনাশক নিবন্ধিত রয়েছে। এসব কীটনাশক প্রতি বছর কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে আমদানি করা হয়। যদিও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে কীটনাশকের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম, বিগত দুই দশক ধরে কীটনাশকের ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতীতে, কীটনাশক কৃষি কীটগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘সর্বরোগ নিবারক ওষুধ’ হিসেবে বিবেচিত হতো। যদিও কীটনাশক অস্থায়ী সমাধান সরবরাহ করতে পারে, তবে এখন এটি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে যে কীটনাশকের নির্বিচার ও অতিরিক্ত ব্যবহার এবং তাদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরতা কৃষিক্ষেত্রের জন্য স্থায়ী হুমকিস্বরূপ। রাসায়নিক কীটনাশকগুলোর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কেবল ব্যয়বহুল নয়, তবে এটি ফসলের উৎপাদনকারী এবং গ্রাহক উভয়েরই স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ানোর পাশাপাশি নেতিবাচক পরিবেশগত প্রভাবের দিকেও নিয়ে যায়।

বিষয়গুলো বিবেচনা করে কেবল কীটনাশকের ওপর নির্ভর করার পরিবর্তে বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট (আইপিএম) বা সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আইপিএম দেশের কৃষক, নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচুর সচেতনতা তৈরি করেছে। ধারা ৭.১ এর অধীনে জাতীয় কৃষি নীতি (ন্যাপ) নির্ধারণ করেছে যে কীট এবং রোগ নিয়ন্ত্রণে আইপিএমই হবে মূলনীতি।

বর্তমানে বাস্তুসংস্থানীয় অনুকূলতার ওপর ভিত্তি করে ফসল উৎপাদনে আইপিএমের একটি দৃঢ় ও বিস্তৃত পদ্ধতি রয়েছে। এমনকি এটি উৎপাদন ছাড়িয়ে যায় কারণ এতে সর্বস্তরের ফসলের সঞ্চয়ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আইপিএম কৃষকদের একটি স্বাস্থ্যকর ফসল উৎপাদন করতে এবং একই সঙ্গে পরিবেশ ও মানব সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্যের উন্নতির পাশাপাশি একটি টেকসই ভিত্তিতে তাদের খামার উৎপাদন এবং আয় বৃদ্ধিতে সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে।

আইপিএম মাটি, পানি, সার, কীটপতঙ্গ ইত্যাদির যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার এড়ানো বা হ্রাস করে, জৈবিক নিয়ন্ত্রণ এজেন্ট সংরক্ষণ করে, জৈবিক নিয়ন্ত্রণ এজেন্টদের বৃদ্ধি ঘটায়, কীট সহনকারী ফসলের জাতের ব্যবহারের মাধ্যমে একটি স্বাস্থ্যকর ফসল উৎপাদনের পক্ষে ধানের জমিতে কীটপতঙ্গ জনসংখ্যা হ্রাস করতে পারে, কীটপতঙ্গের যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ করে, কৃষকদের তাদের নিজস্ব খেতের বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফসল পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আয়-বর্ধন কার্যক্রম যেমন ‘আইল’ ফসলের চাষ এবং মাছ ও চিংড়ির চাষ বৃদ্ধির মতো কৃষি কাজ পদ্ধতি তৈরিতে সাহায্য করে।

আইপিএম গ্রহণের ফলে উপকারী পোকামাকড়, মাছ, ব্যাঙ, পশু, পাখি ও গুইসাপ প্রভৃতি সংরক্ষণ করা যায়, ক্ষতিকারক কীটনাশকের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় এবং যথেচ্ছ ব্যবহার না হওয়ায় উৎপাদন খরচ কমে। এ ছাড়া বালাইনাশকের পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রোধ করা সম্ভব হয়। এতে করে বালাইনাশকজনিত দুর্ঘটনা সহজেই এড়ানো যায়। ক্ষতিকারক পোকামাকড় বালাইনাশক আইপিএম প্রক্রিয়ায় সহনশীলতা অর্জন করার সুযোগ পায় না। বালাইয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনা কম থাকে। সর্বোপরি পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে এবং দূষণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়।

বিশ্ব খাদ্য সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত আইপিএমের সংজ্ঞাটি হলো-‘একটি কীটপতঙ্গ পরিচালন ব্যবস্থা, যা পরিবেশ সম্পর্কিত ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ এবং কীট প্রজাতির জনসংখ্যার গতিশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে, যথাযথভাবে উপযুক্ত উপায়ে সব উপযুক্ত কৌশল এবং পদ্ধতি ব্যবহার করে পোকার জনসংখ্যা এমন পরিমাণ বজায় রাখে যেন তারা অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ না হয়’। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আইপিএম পদ্ধতি কেবল কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এরমধ্যে কার্যকর, নিরাপদ, টেকসই এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ফসল সুরক্ষা ব্যবস্থায় অবদান রাখার উপাদানগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বাংলাদেশে আইপিএম কার্যক্রম ১৯৮১ সালে ধানের ফসলে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা কর্তৃক আইপিএমের আন্তদেশীয় প্রোগ্রাম (আইসিপি) প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রথম শুরু হয়। এর ফলে আইপিএমের কার্যক্রমগুলো প্রসারিত হতে শুরু করে এবং সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে একটি জনপ্রিয় বিষয় হয়ে ওঠে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) প্রশিক্ষণের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আইপিএম প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণের জন্য কৃষক বিদ্যালয় চালু করা হয়েছে। বেসরকারি সংস্থার অনেক ব্যক্তিকেও আইপিএম সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এই কর্মসূচির সাফল্যের ফলস্বরূপ এবং বাংলাদেশে আইপিএমের প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে, ধান ও শাকসবজিতে বেশ কয়েকটি আইপিএম প্রকল্প প্রকাশ্যে এসেছে যা বিভিন্ন সরকারি দপ্তর এবং এনজিও কর্তৃক সম্পাদিত হচ্ছে।

এ জাতীয় প্রকল্পের কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রচুর আইপিএম প্রশিক্ষক তৈরি করা হয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়নের এই কার্যক্রমগুলো ছাড়াও, আইপিএম প্রকল্পগুলো পুরুষ ও মহিলা কৃষক এবং স্কুল শিশুদের জন্য আইপিএম ফিল্ড স্কুল প্রতিষ্ঠা, আইপিএম কৃষক ক্লাবগুলোর বিকাশ ও প্রচার এবং জৈব-কীটনাশক পরীক্ষা ও বায়োকন্ট্রোল পরীক্ষায় এবং ব্যবহারে সক্রিয় রয়েছে। সুতরাং, সরকারের দৃঢ় সমর্থন নিয়ে এরই মধ্যে বাংলাদেশে কার্যকর আইপিএম নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় এক লাখ কৃষক আইপিএম সম্পর্কিত গভীরতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। অন্য এশীয় দেশগুলোর মতো আইপিএম প্রশিক্ষিত বাংলাদেশি কৃষকরাও কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছেন।

সাধারণভাবে আইপিএমের উদ্দেশ্য হচ্ছে, সুস্থ ও মানসম্পন্ন ফসল উৎপাদনে কৃষকের প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতির পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমানভাবে ফসল উৎপাদন ও কৃষকের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি সামগ্রিক পরিবেশ তথা জনস্বাস্থ্যের উন্নতি। অনেকের ধারণা যে, আইপিএম পদ্ধতিতে আদৌ কোনো বালাইনাশক ব্যবহার চলবে না। আসলে তা নয়। পোকা-মাকড় ও রোগবালাই যদি অন্যান্য দমন পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, শুধু তখন শেষ ব্যবস্থা হিসেবে বালাইনাশক ব্যবহার করা যাবে। তবে তার ব্যবহার করতে হবে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ও যুক্তিসঙ্গতভাবে। এরমধ্যে আছে নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন, কৃষি পরিবেশ বিশ্লেষণ ও নিয়মিত বালাই জরিপ নিশ্চিত করা; খেতে ক্ষতিকর ও উপকারী পোকামাকড়ের ভারসাম্য বজায় রাখা; শুধু বালাইনাশকের ওপর নির্ভরশীল না হওয়া ও বালাইনাশকের এলোপাতাড়ি ব্যবহার বন্ধ করা এবং আইপিএম ধারণায় কৃষককে দক্ষ করে গড়ে তোলা, যাতে করে নিজের ফসলের বালাই ব্যবস্থাপনার সঠিক সিদ্ধান্ত তারা নিজেরাই গ্রহণ করতে পারেন।

তবে, জাতীয় পর্যায়ে আইপিএমের একটি উল্লেখযোগ্য এবং ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চিত করার জন্য এখনো বিপুলসংখ্যক কৃষককে আইপিএম প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং নিয়মিত তাদের জমিতে আইপিএম অনুশীলন করা উচিত। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে একটি টেকসই আইপিএম প্রোগ্রামের সম্প্রসারণ ও সমন্বয় নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। আইপিএমের বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন ও সংরক্ষণের বিষয়ে একটি বিস্তৃত পদ্ধতি রয়েছে যার কারণে এখনকার দিনগুলোতে আইপিএমকে বিশ্বব্যাপী এক্ষেত্রে সেরা পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

আশা করা যায় যে, জাতীয় আইপিএম নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের ফসল উৎপাদন এবং সংরক্ষণ ব্যবস্থাটি অনেক বেশি বিকশিত হবে। একই সঙ্গে আইপিএম প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় তাদের জড়িত হওয়ার মাধ্যমে সম্প্রসারণ কর্মী, কৃষক এবং এনজিও কর্মীদের মধ্যে কাজের সম্পর্ক ও সহযোগিতার বিকাশ হবে। কৃষকরা যদি তাদের জমিতে আইপিএম অনুশীলন করে তবে ক্ষতিকারক কীটনাশকের ব্যবহার অনেক হ্রাস পাবে যার ফলস্বরূপ, উৎপাদন স্তর বৃদ্ধি এবং পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে। আইপিএম খামারের আউটপুট বাড়িয়ে দেবে যা দেশের বিপুলসংখ্যক কৃষকের আয়ের স্তর বাড়িয়ে তুলবে। সুতরাং সামগ্রিক অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক প্রভাব দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি হ্রাস করতে সহায়তা করবে। তবে সময়ের সঙ্গে জাতীয় আইপিএম নীতি পর্যালোচনা করা এবং দেশের পরিবর্তিত কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংশোধন ও যুগোপযোগী করা উচিত।

লেখক : সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল

ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close