জুবায়ের আহমেদ

  ২৭ অক্টোবর, ২০২১

মুক্তমত

শৈশব থেকেই শুরু হোক সম্প্রীতির শিক্ষা

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কে কোন ধর্মে, গোত্রে, সমাজে কিংবা দেশে জন্ম নিয়েছে তা ছাপিয়ে একজন মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি মানুষ। পৃথিবীর যে প্রান্ত কিংবা যেখানেই মানুষের জন্ম কিংবা বসবাস হোক না কেন, অপর প্রান্তের, অপর দেশের যেকোনো মানুষের কাছেই অপর একজনের পরিচয় উভয়েই মানুষ, উভয়েই সৃষ্টিকর্তার সেরা সৃষ্টি। কে কালো, কে ফর্সা কিংবা কে খাটো, কে লম্বা, কে গরিব, কে ধনী, কে রাজা বা কে প্রজা, কোনো ধর্মই মানুষের মধ্যে এভাবে শ্রেণি বিভেদ-বিভক্তি তৈরি করেনি। যুগে যুগে মানুষ বিভিন্ন ধর্মে বিভক্ত হয়েছে, সময়ের বিবর্তনে ধর্মে বিশ্বাসী মানুষজন আজ কেউ মুসলিম, কেউ খ্রিস্টান, কেউ বৌদ্ধ, কেউ হিন্দু এবং আরো বিভিন্ন ধর্মে বিভক্ত হওয়ার পাশাপাশি ধর্ম তথা স্রষ্টার অস্তিত্বে অবিশ্বাসীর সংখ্যাও পৃথিবীতে কম নয়। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা, ধর্মের অপব্যাখ্যা করা, ব্যক্তিস্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করা ব্যক্তিদের কারণে ধর্মে অবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন।

উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ঘটনা নতুন কিছু নয়। ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দ্বারা এবং রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টায় থাকা ব্যক্তিদের দ্বারা অসাম্প্রদায়িক চেতনা কিংবা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের ঘটনা অতীতে ঘটেছে বারবার। ব্রিটিশ ভারতে ধর্মীয় দাঙ্গা-হামলা ছিল পরিকল্পিত। সব সময় রাজনীতিই তাকে পরিচালিত করেছে। যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠদের হামলায় আক্রান্ত হতো সংখ্যালঘুরা, সে যেকোনো ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ কিংবা সংখ্যালঘুই হোক না কেন। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ করলেও বহু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়, যা মূলত আবেগের বশে ও গুজবকে পূঁজি করে স্বার্থান্বেষী মহলের দ্বারাই ঘটেছে বেশি। সব ধর্মই সম্প্রীতির কথা বলে, বিশেষ করে পবিত্র ইসলাম ধর্মে অমুসলিম প্রতিবেশীদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য কতটা, তা খেয়াল করলেই বুঝা যায় ধর্মে উগ্রবাদের স্থান নেই, মানুষে মানুষে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করাই একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। পাশাপাশি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মদিনার সনদ ও বিদায় হজের ভাষণই স্পষ্টত সবাই মিলে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রেখে চলার সুস্পষ্ট দলিল। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা ধর্মীয় আবেগের বশে স্বার্থান্বেষী মহলের দ্বারা ব্যবহৃত হওয়ার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের বহু ঘটনা ঘটিয়েছে, এখনো নিয়মিত ঘটছে যা কখনোই কাম্য নয় ও ছিল না।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্টের ঘটনাগুলো হুট করে ঘটলেও এই পরিস্থিতি এক দিনে তৈরি হয়নি। নিজ ধর্ম বড় অন্য ধর্ম তুচ্ছ, এই মানসিকতা নিয়ে যে শিশুরা বড় হচ্ছে, একসময়ে তাদের কারো না কারো দ্বারাই সংখ্যালঘু মানুষের ধর্ম নিয়ে কটূক্তির ঘটনা ঘটে, ধর্মীয় স্থাপনা ও কিংবা তাদের বাড়িঘর জ্বালানো-পুড়ানোর ঘটনা ঘটে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কিংবা প্রভাববিস্তার কিংবা ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে সুবিধাভোগ করতে চাওয়া গোষ্ঠী বা ব্যক্তিরাও সেই ধর্মীয় উগ্রতা মনের মধ্যে লালন করে বেড়ে ওঠা ব্যক্তিদের মাধ্যমেই ধর্মীয় সম্প্রতি বিনষ্টের ঘটনা ঘটায়। যেহেতু বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ, সেহেতু অন্যান্য ধর্মাবলম্বী কারো দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে হোক কিংবা রাজনৈতিক কোনো ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যেই হোক মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনা তৈরি করে দেশব্যাপী মুসলিমদের ক্ষেপিয়ে দিয়ে উগ্র ও ধর্মান্ধ মুসলমানদের দ্বারা সংখ্যালঘু অমুসলিমদের ঘরবাড়ি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের মতো ঘৃণ্য ও অমানবিক ঘটনার সৃষ্টি হয়। অন্য ধর্মের লোকজন দেশব্যাপী মুসলমানদের ওপর কিংবা মসজিদ-মাদ্রাসার ওপর হামলা চালাবে, এমন সাহস কখনোই হবে না।

কাজেই সচেতন হতে হবে মুসলমানদের। এই সচেতনতার অংশ হিসেবে দেশব্যাপী মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুদের দিতে হবে সম্প্রীতির শিক্ষা। মুসলমানদের কাছে অন্য ধর্মের মানুষ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিরাপদ এবং মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন, এই শিক্ষা শিশুদের মননে ও মানসে গেঁথে দিতে হবে। আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা অফিস-আদালতে যেভাবে অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে আন্তরিকতার সম্পর্ক বজায় রেখে চলি, সর্ব ক্ষেত্রে এই শিক্ষার বাস্তবায়ন করতে হবে। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী সবাই আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব এবং মানুষের অনিষ্ট করে কিংবা মানুষকে ঘৃণার চোখে দেখা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। শিশুদের সেই শিক্ষা দিতে হবে। অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর নীতি ও আদর্শ শিশুদের মনে গেঁথে দিতে পারলে বড় হয়ে তারাও নিজ ধর্মের মতো অন্য ধর্মের মানুষ ও ধর্মীয় স্থাপনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে। শিশুদের ধর্মীয় সম্প্রতির পূর্ণ শিক্ষা দিয়ে বড় করতে পারলে দেশ থেকে ধর্ম নিয়ে হানাহানি, কটূক্তি, ধর্ম গ্রন্থের অবমাননারোধ এবং ধর্মীয় সম্প্রতি বিনষ্ট হওয়া থেকে রেহাই পাবে দেশ ও জাতি এবং তাতেই গড়ে উঠবে ঐক্য ও সম্প্রতির বাংলাদেশ।

লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন জার্নালিজম

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড

ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম), ঢাকা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close