স্বপ্না রেজা

  ২৬ অক্টোবর, ২০২১

মুক্তমত

আত্মহত্যা রোধ করার জন্য কাউন্সিলিংয়ের প্রয়োজন

জীবন বদলে যাচ্ছে। এই বদলে যাওয়াকে অনেকে পরিবর্তন বলেন। কেমন পরিবর্তন? ভালো থেকে খারাপ হওয়া, নাকি খারাপ থেকে ভালো হওয়া। দুটোই। যখন কোনো আহ্বান আসে, আসুন বদলে যাই, বদলে দিই-তখন কিন্তু আধুনিক যুগের, আধুনিক জীবনযাপনের ছবিই ভেসে ওঠে। জটিল জীবনকে সহজ করার চেষ্টার কথাই থাকে সেই আহ্বানে। থাকে সত্য প্রতিষ্ঠার, সত্যের প্রতি আনুগত্যের ইঙ্গিত। জগতের অপসংস্কৃতি, অসংগতি থেকে বের হওয়ার ইতিবাচক আহ্বান। আর আধুনিক জীবন মানেই যেন প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রযুক্তির ভেতর জীবন সর্বস্ব প্রয়োজনকে ঠাঁই দেওয়া। আর প্রয়োজনের তাগিদে ধীরে ধীরে মানুষ যেন তার আবেগ, সম্পর্ককেও প্রযুক্তির ভেতর ঢুকিয়ে ফেলছে, ব্যক্তিসত্তার আধুনিকীকরণ করছে। কী হচ্ছে তাতে? লাভের চেয়ে ক্ষতি হচ্ছে বেশি, অনেকেই সেটা মনে করেন। একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। ল্যান্ডফোনের একটা নির্দিষ্ট জায়গা থাকতে হয় লাইন সংযোজনের মাধ্যমে। মোবাইল ফোনের ওইসব দরকার পড়ে না। ব্যবহারে অতি সহজ যোগাযোগের মাধ্যম এই মোবাইল হাতের মুঠোয় থাকলেই চলে। ফলে আলাপচারিতায় সত্য বলার পাশাপাশি মিথ্যা কথা বলার অনেক সুযোগ তাতে। বলছেও তাই। মিথ্যা বলার প্রবণতা এই ডিভাইস ব্যবহারে বেড়েছে। এতে দুর্ঘটনা বেড়েছে। আবার এই মোবাইল সারা দুনিয়াকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। প্রয়োজন পূরণে অতি সহজ ভূমিকা রাখছে। দূরকে কাছে এনে দিচ্ছে সহজে। আবার ভালোর পাশাপাশি সস্তা বিনোদন থেকে শুরু করে বড় বড় অপরাধ সংঘটনের উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই প্রযুক্তি। তবে কি জীবনযাপনে আধুনিকতার প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে এবং তা প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারে এবং নিয়মণ্ডশৃঙ্খলায়। যা আদতে হচ্ছে না বলে অনেকে মনে করেন। ফলে অনেক আত্মহত্যার মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটছে এবং বাড়ছে।

ইদানীং আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেড়েছে। আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে অনেক তরুণ। আত্মহত্যা কী এটা নতুন করে বলার দরকার নেই। সমাজে প্রচলিত কথায় নিজ হাতে জীবনের পরিসমাপ্তি। নিজ হাতে নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করা। দার্শনিকদের মতে, ব্যক্তির জীবনের সাময়িক সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান হলো আত্মহত্যা। ধর্মীয় দৃষ্টিতে আত্মহত্যাকে পাপ হিসেবে দেখা হয়। ফলে কেউ নির্যাতন, নিপীড়ন ও অবহেলার শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলে ধর্মীয় কারণে তার জানাজাও পড়ানো হয় না। আত্মহত্যার কারণ যতই সংবেদনশীল হোক না কেন এ ক্ষেত্রে। আত্মহত্যার পেছনে অনেক কারণ থাকে। সহজে ব্যক্তি তার নিজ জীবনের পরিসমাপ্তি চান না। যেকোনোভাবে বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষাই প্রবল এবং বড় সত্য মানবজীবনে। অসুস্থতা ছাড়া আত্মহত্যার কারণগুলো খতিয়ে দেখা দরকার। নতুবা রোধ করা সম্ভব হবে না।

গ্রিক দার্শনিক প্লেটো আত্মহত্যার নৈতিকতার বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করেছেন। তিনি মনে করেছেন, যখন কেউ রাষ্ট্রীয় আইনে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত হন অথবা দুর্ভাগ্যবশত জীবন ধারণে অপারগ হন অথবা অপ্রত্যাশিত অপমানে জর্জরিত হন তখন তার আত্মহত্যা করা অনৈতিক নয়। অনৈতিক হয় না। পাশাপাশি নিষ্ক্রিয়তা বা কাপুরুষতার জন্য আত্মহত্যা করাকে তিনি নৈতিকতার দৃষ্টিতে দেখেননি। সমর্থন করেননি। প্লেটোর ধারণা সহজ করলে দাঁড়ায় যে, সামাজিক অসমতা, অসঙ্গতি, অন্যায্যতার ও অবহেলা-লাঞ্ছনার কারণে আত্মহত্যা করাটা অনেকটাই যুক্তিযুক্ত হয়ে ওঠে এবং তাতে নৈতিকতার বিষয়টি স্পষ্টত করে। সোজা কথায়, আত্মহত্যাকারী বেঁচে থাকার ন্যূনতম সমর্থন, সুযোগ, সম্মান ও নিরাপত্তা সমাজ থেকে পায় না বিধায় আত্মহননের পথ বেছে নেন। অর্থাৎ সমাজে প্রচলিত অনৈতিক আচরণই ব্যক্তিকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দেয় বিধায় আত্মহত্যার পেছনে প্লেটো যুক্তিসংগত নৈতিকতার বিষয়টি বিবেচনায় এনেছেন।

একটি সূত্র মতে, বিশ্বে বছরে আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন। তার মানে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন করে আত্মহননের পথ বেছে নেন। তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপ মতে, গত এক বছরে বাংলাদেশে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেছেন। এমনকি ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে আত্মহত্যা ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়েছে, যার মধ্যে নারীদের সংখ্যাই বেশি। পাশ্চাত্যে মধ্য ও শেষ বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়, কারণ সামাজিক যে কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সেখানে তাতে তারা একাকিত্ব জীবনযাপন করেন। ৪০-৫০ বছর বয়সি একাকী পুরুষের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি পাশ্চাত্যে। অন্য রকম চিত্র বাংলাদেশে। এমনিতেই সুষ্ঠু-সঠিক শিক্ষার অভাব, আর্থসামাজিক অবস্থার অসংগতি, বৈষম্য, নিরাপত্তাহীনতা তরুণ ও যুবসমাজকে আঘাত করে বেশি। করোনা সেই আঘাতকে আরো বেপরোয়া করেছে। গত ১৩ মার্চ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, করোনাকালীন বিশেষ করে গত দুই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার খবর পত্রিকায় বেশি এসেছে। যার মধ্যে ২০-৩৫ বছর বয়সি রয়েছেন ৪৯ শতাংশ। আত্মহননকারীদের মধ্যে অর্ধেক তরুণ। সবচেয়ে কম আত্মহননকারীদের বয়স ৪৬-৮০ এর মধ্যে, যা পাশ্চাত্য দেশের বিপরীত চিত্র। করোনাকালীন তরুণদের আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়লেও কিন্তু মূলত তরুণদের ভেতর আত্মহত্যার প্রবণতা সব সময়ই বেশি দেখা গেছে। যদি প্লেটোর বিবেচনায় দৃষ্টিপাত করা হয় তাহলে যে বিষয়টি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে তা হলো ক্রমেই তরুণ সমাজ বেঁচে থাকার অবলম্বন হারিয়ে ফেলছে কিংবা খুঁজে পাচ্ছে না। ফলে হতাশা-গ্লানি থেকে আত্মহননের কারণ ঘটছে।

আবার মেধাবী শিক্ষার্থী ও ভালো ফলাফল করার পরও কেবলমাত্র রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা রাজনৈতিক যোগসূত্র না থাকার কারণে শিক্ষকতার সুযোগ হয়নি, এমন ঘটনার পেছনেও আত্মহননের বিষয়টি সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিংবা শিক্ষকের একজনার প্রতি পক্ষপাতমূলক দৃষ্টির আচরণটি অন্য একজন সাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া মাদকাসক্তির কারণে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে। শিক্ষাঙ্গনকে মাদকমুক্ত করা সম্ভব না হলে শিক্ষার্থীদের মেধা ভিন্ন পথে প্রভাবিত হতে পারে। হয়েছেও। অরক্ষিত আবাসিক হল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষিত না করা হলে হতাশা, বিষণœতা শিক্ষার্থীদের জীবন গ্রাস করে। অনেকে মনে করেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক তৎপরতাও নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার শিক্ষার্থীদের সামাজিক ও মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। আবার প্রেমঘটিত কারণে তরুণদের ভেতর আত্মহননের প্রবণতা দেখা যায়। বেশি দেখা যায় নারীদের ভেতর। যৌন নিপীড়নের শিকার, ধর্ষণের শিকার, প্রতারণা, পারিবারিক সহিংসতা, লাঞ্ছনা-বঞ্চনায় আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন তরুণ নারীরা। আমি মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহননের কারণ অনুসন্ধান করা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জন্য জরুরি এবং এটা চলমান হতে হবে। পুলিশি দৃষ্টিতে নয় তা। অভিভাবকের দৃষ্টিতে, মমতায় হতে হবে।

শিক্ষার্থীদের সামাজিক নিরাপত্তার মতোই তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখা ও সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন আছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত না হলে ভবিষ্যতের সব স্বপ্ন, পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের যে স্বপ্ন দেখা হচ্ছে তা সুস্থ মানবসম্পদ ছাড়া বিনির্মাণ সম্ভব নয়। ইট, সুরকি, মারবেল, অত্যাধুনিক ডিভাইস, স্থাপনা কোনোই কাজে আসবে না যদি না আগামীর প্রজন্ম এর মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যায়। আত্মহত্যা রোধ করার জন্য কাউন্সিলিংয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই সেবামূলক কাজ নিয়েও ব্যবসা শুরু হয়েছে।

পরিশেষে বলব, একটি দেশে মানবসম্পদের চেয়ে বড় সম্পদ আর হয় না। এই মানবসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই সম্পদ হন না, তাকে সম্পদে পরিণত করতে হয় এবং সেটা পরিচর্যা, সেবা, যত্ন, নিরাপত্তা এবং মর্যাদায়।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close