দিলীপ কুমার আগরওয়ালা
অভিমত
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিই আমাদের ঐতিহ্য
বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ দেশের নানা সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করে আসছে। করোনা মহামারিকালেও সম্প্রীতির উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে এই দেশে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তাতে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে কোরআন অবমাননার অভিযোগে গত ১৩ অক্টোবর ওই নগরীর অন্তত আটটি মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ হয়। তার জের ধরে সে দিনই চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে মন্দিরে হামলা হয়। এরপর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনীতেও সহিংসতা ছড়ায়। ১৭ অক্টোবর রাতে রংপুরের পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ায় হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয় ফেসবুকে এক তরুণের কথিত ধর্ম অবমাননার পোস্টকে কেন্দ্র করে। সেখানে জেলেপল্লীর ২৯টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়; ভাঙচুর করা হয় মন্দির।
কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনায় তৃতীয় পক্ষের প্ররোচনা থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো। প্রচার হওয়া দুটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, এক যুবক রাতে পূজামণ্ডপের কাছের একটি মাজারের মসজিদ থেকে কোরআন শরিফ এনে মণ্ডপে রাখছেন। এ রকম একজনকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এলাকা থেকে আটক করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। এখানে সব ধর্মের মানুষ সম্মানের সঙ্গে যুগের পর যুগ বসবাস করছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে সব ধর্মের মানুষ রক্ত দিয়েছে। পবিত্র কোরআন অবমাননা কেন্দ্র করে কুমিল্লায় যা ঘটেছে তা খুবই দুঃখজনক। এ ঘটনায় অপরাধী যে-ই হোক তার বিচার করা হবে। কুমিল্লা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন। তিনি বলেন, মানবধর্মকে সম্মান করা ইসলাম আমাদের শেখায়। নিজের ধর্ম পালনের অধিকার যেমন সবার আছে, অন্যের ধর্মকেও কেউ হেয় করতে পারে না। অন্যের ধর্মকে হেয় করলে নিজের ধর্মকেই অসম্মান করা হয়। নিজের ধর্মের সম্মান নিজেকেই রক্ষা করতে হবে। মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ধর্মের নামে রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির সাংঘাতিক উগ্রবাদিতার পরিচয় দিয়েছে। তারা ধারাবাহিকভাবে ষড়যন্ত্র করছে।
২০১৩ সালে সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি গ্রুপ ভয়াবহ সহিংসতা চালিয়েছিল। তার কোনো বিচার কিংবা শাস্তি কিছুই হয়নি। কুমিল্লার ঘটনার পর ধারণা করা হচ্ছে তাদের কার্যক্রম থেমে নেই। উগ্রবাদিতা রুখতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অবহেলা আছে কি না খতিয়ে দেখতে হবে। কুমিল্লা, রংপুরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর যে অন্যায় হয়েছে, যারা অন্যায় করেছে তাদের চিহ্নিত করে অনিবার্যভাবে আইনের আওতায় আনতে হবে।
সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর সারা দেশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নতুন করে তৎপর হয়েছে। কুমিল্লার ঘটনায় অভিযুক্ত তরুণকে কক্সবাজার থেকে আটক করা হয়েছে। এর আগে পুলিশ এক বিবৃতিতে জানায়, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় সারা দেশে মোট ৭২টি মামলা হয়েছে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৪৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুর্গাপূজায় সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার কথা আগেই জানিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সব ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবিলায় পর্যাপ্তসংখ্যক সদস্য মোতায়েন এবং গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধির কথাও জানানো হয়েছিল। কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে হামলার পর সারা দেশে পুলিশ ‘সর্বোচ্চ সতর্ক’ ছিল বলে বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও কয়েকটি জেলায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ল কেন? পুলিশ বলছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব-বিভ্রান্তি ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব-বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিট ‘মনিটর’ করছে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে বলে পুলিশের এক বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলার ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতার চেতনাবিরুদ্ধ। অস্বীকার করার উপায় নেই যে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের ব্যবহারের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দেশ। এ দেশে সব ধর্মের নাগরিকদের অন্যের ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। নাগরিকদের যেমন দায়িত্বশীল হতে হবে, তেমনি দেশের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকেও অপশক্তির বিরুদ্ধে হতে হবে তৎপর।
লেখক : পরিচালক, এফবিসিসিআই
"