অরিত্র দাস

  ২৫ অক্টোবর, ২০২১

মুক্তমত

কবে অসাম্প্রদায়িক হব আমরা?

গণতন্ত্রের জন্য যে যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িকতার বলয় থেকে মুক্তির জন্য যে যুদ্ধ, বৈষম্যের কষাঘাত থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে যুদ্ধ, সর্বোপরি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতীয়তাবোধের জন্য যে যুদ্ধ আজ সেই যুদ্ধের মহিমা কতটুকু প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে? প্রশ্নটা ব্যক্তি বিশেষের নয়, সমষ্টির।

যুদ্ধের পরক্ষণেই স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে প্রতিটি স্তরে। দেশে গণতন্ত্র নিয়ে বারংবার টানা-হেঁচড়া হয়েছে, দীর্ঘকাল এখানে কোনো গণতন্ত্র ছিল না। কোনো দলই গণতন্ত্রের চর্চা করেনি। গণতন্ত্রের নামে সব সরকারই একনায়কতন্ত্রের চর্চা করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছে। হিন্দু মুসলমানের শ্রেণি বিভাজন কমেনি, বরং বেড়েছে। নিজেদের গদি সামলাতে গিয়ে মৌলবাদিরের সঙ্গে আঁতাত করেছে, মেনে নিয়েছে সংকীর্ণবাদিদের দাবি-দাওয়া। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মৌলিক ও মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক আদর্শের চর্চা কেউ করেনি। যা করেছে তা কেবল মুখে মুখে, রাষ্ট্রীয় কাগজে-কলমে রয়েছে কিন্তু চর্চা হয়নি।

ফলে গত কয়েক দশকে মানবিক তারুণ্য তৈরি হয়নি। যা ছিল ৭১-এর আগেই...। সংখ্যাগত দিক থেকে এখন সুষম, অসাম্প্রদায়িক, সংবেদনশীল ও সচেতন শিক্ষিত বাঙালি মনন জগতের এক বিশাল অংশের মানুষের চিন্তা-ভাবনা খুবই সংকুচিত হয়ে গেছে। ভোগবাদী ও ধর্মের অপব্যবহারকারী হয়ে গেছে। এ দেশে প্রতিক্রিয়াশীল সংকীর্ণমনা ও সাম্প্রদায়িক উগ্ররা যে এখন থিয়েটার করে, সিনেমা করে, গান করে, শিল্প করে, সাংস্কৃতিক সংগঠন করে, অভিনয় করে, সাংবাদিকতা করে, কবিতা লিখে, উপন্যাস লিখে, প্রবন্ধ লিখে, শিক্ষকতা করে, নাচ করে, বাম করে, ডান করে- তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠছে যেন। দেশজুড়ে এত বড় সাম্প্রদায়িক হামলায় যাদের প্রতিবাদ নেই, সহমর্মিতা নেই তারা আর যাই হোক তাদের বাঙালি বলা যায় কি না-ভেবে দেখা প্রয়োজন। সবাই বাঙালি নয়, কেউ কেউ বাঙালি; যারা বাঙালিত্ব ধারণ করে ধর্ম ও কর্মে। বাকিরা উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবোধে বিশ্বাসী এবং সাম্প্রদায়িক। কারণ অধিকাংশ প্রতিবাদ কেবল আক্রান্তের পক্ষ থেকেই দেখা যায়, ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর কাছ থেকে আশানুরূপ দেখা যায় না, প্রায় নিশ্চুপই বলা চলে। তখন আস্থার প্রত্যেকটি খুঁটি ভেঙে পড়তে শুরু করে।

সাম্প্রদায়িকতা করে থাকে তিন শ্রেণি, এক. যারা পর্দার আড়ালে থেকে উসকানি দেয় এবং উদ্বুদ্ধ করে। দুই. মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় থেকে যারা হামলায় অংশ নেয় এবং তিন. যারা মৌন থাকে অর্থাৎ বাড়িতে বসে মনে মনে এ ধরনের হামলায় খুশি হয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়। এ তিন পক্ষ মিলে এদের পাল্লা বিশাল। বিশাল বলতে অত্যাধিক বিশাল। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের একটানা চলমান ১৫ বছরে ১৫টি প্রজন্ম তৈরি করা যেত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, প্রগতিলব্ধ জ্ঞান চর্চায়; যারা হতে পারত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে, সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উদার আধুনিক মননশীলতার অধিকারী। বাস্তবায়ন করা যেত সেই রাষ্ট্রীয় কাঠামো যা ছিল একাত্তরের অঙ্গীকার, যদি ইচ্ছাশক্তি থাকত। কিন্তু হয়নি, হয়েছে ভিন্ন...! রাষ্ট্র দিন দিন রক্ষণশীল তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে ওঠছে, স্বাধীনতার পাঁচ দশকে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক ঈর্ষা, অতঃপর এসব সাম্প্রদায়িক হামলা ও হত্যার বিচারহীনতার সংস্কৃতি তাই যেন বলছে। আইন ও সালিস কেন্দ্র বিগত ৯ বছরের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যাতে দেখা যায়- সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৬৭৯টি। বাড়িঘর ভাঙচুর ১ হাজার ৫৫৯টি। প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দিরে ভাঙচুর, আগুন ১ হাজার ৬৭৮টি। আহত হয়েছে ৮৬২ জন এবং নিহত হয়েছে ১১ জন।

আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যারা আওয়ামী লীগকে আশ্রয় করে সংবিধান এবং রাষ্ট্রের মূলনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই সুযোগটির সৃষ্টি হয়েছে কারণ প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে ক্রমাগত কম্প্রোমাইজ করা হয়েছে, এতে তারা সাহস পেয়েছে। এভাবে যদি চলতে থাকে তবে- আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি রাষ্ট্রের জন্ম, সেই রাষ্ট্রের মৃত্যুও উক্ত দলের হাতে অনিবার্য হয়ে পড়বে। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ৭২-এর সংবিধানে উল্লেখিত যে চেতনার কথা বলা হয়, তা যদি আওয়ামী লীগ এখনো কিংবা আগামীতে প্রতিষ্ঠা না করে, তাহলে আওয়ামী লীগ নিজেই অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। বস্তুত মৌলিক আদর্শের যথার্থ বাস্তব প্রয়োগ ছাড়া এভাবে বেশি দিন থাকা যায় না, থাকা যাবে তখনই যখন তাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করা হয়। এজন্য পরবর্তী পদক্ষেপ কী-আওয়ামী লীগও ৭২ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে আসতে বাধ্য হবে, কেন আসবে? কারণ একটা রাষ্ট্রের সিংহভাগ জনগণ যে আদর্শ লালন করে, প্রাত্যহিক জীবনে ধারণ করতে শুরু করে; তখন দল ক্ষমতা বা অস্তিত্বে থাকতে হলে-সেই আদর্শেই উজ্জীবিত হতে হয় নয়তো উক্ত দল জন-বিচ্ছিন্ন হয়ে হারিয়ে যায়। বিপদে পড়লে বুড়া গরুও পুল পার হয়। কিন্তু একটা সন্দেহ অবশ্য রয়েই যায়-স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ যদি প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলোকে সমর্থন করে, তাদের দাবি-আদর্শ সমীহ করে রাষ্ট্র পচিালনা কিংবা বিনির্মাণ করে: তাহলেও কি আওয়ামী লীগকে তারা মেনে নেবে? মেনে নেবে না। এখানকার রক্ষণশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল দল ও দলের অনুসারীরা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে মেনে নিতে কুণ্ঠিত হয়। কখানো মেনে নেয়নি। শেখ হাসিনাকে মেনে নিতে চায় না- এ কথা তো সর্বজনবিদিত। যত দিন এ দেশ অসাম্প্রদায়িকতা আছে, বহু জাতি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন আছে তত দিন আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব আছে।

আওয়ামী লীগ যদি তা ভুলে গিয়ে থাকে বা ভবিষ্যতে ভুলে যায়, ঠিক তখন থেকেই এই দলটির স্বাতন্ত্র্য বলতে আর কিছু থাকবে না। সে ক্ষেত্রে হয় আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে বসবে নয়তো নব্য আওয়ামী লীগার কর্তৃক তীব্র আওয়ামীবিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগকে বাধ্য করা হবে। খসে পড়ার দ্বারপ্রান্তে ঝুলে থাকবে-আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকায় খচিত চারটি তারকার একটি তারকাণ্ড ধর্মনিরপেক্ষতা, যা বঙ্গবন্ধুর দল তথা আধুনিক বিশ্বের উষালগ্নে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।

অতীতে বাঙালি আচার-আচরণ যা ছিল তা এ সময়ে এসে হারিয়ে যেতে বসেছে। বলা চলে- জোরপূর্বক হারিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সাংস্কৃতিক চর্চা বা প্রগতিশীল বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সংকীর্ণ ধ্যান-ধারণায় পুষ্ঠ প্রতিষ্ঠান বেশি গড়ে ওঠেছে এবং ওঠছে। অসাম্প্রদায়িক বিদ্যাচর্চা বা বিদ্যাচর্চার প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেবল মুখে মুখে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আর একটু স্পষ্ট করে বলি- আপনি গাছ লাগাবেন নিম গাছ, আর ফল চাইবেন পাকা আম, তা কি করে সম্ভব? সারা বছর সাম্প্রদায়িকতার চাষাবাদ করে, বাঙালির উৎসব পার্বণের দিন অসাম্প্রদায়িক আচরণ আশা করা কেবল অপ্রাসঙ্গিক নয়, বোকামিও বটে। এই যে প্রতিক্রিয়াশীল আক্রমণ তা যে শুধু সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে হয়, এমনটি কিন্তু নয়, বাঙালি বর্ষবরণ থেকে শুরু করে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব পালনের বেলাতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের দিন উগ্রপন্থিদের হামলার ঘটনাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এ পরিবেশ এক দিনে তৈরি হয়নি। বহু বছর ধরে বিদ্বেষের চাষাবাদ হয়েছে, তার ফসল এটি। পঁচাত্তরের পরে বিভিন্ন উপায়ে বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে অবাধে সাম্প্রদায়িক আলাপ, সংকীর্ণ বিদ্যা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে অপসংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িক বিদ্যা দানের যত প্রতিষ্ঠান যত সংগঠন রয়েছে এবং নিত্যনতুন গড়ে ওঠছে; সেই তুলনায় কি অসাম্প্রদায়িক আদর্শ চর্চার প্রতিষ্ঠান আছে? উঁহু.. বোধহয় নেই।

এগুলো ভালো লক্ষণ নয়, আওয়ামী লীগের কাছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চাওয়া আছে, একাত্তরের চাওয়া-পাওয়া আছে, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ও মৌলিকত্বের চাওয়া আছে, এ দেশের প্রগতিশীল সচেতন আধুনিক মানুষ এখনো মনে প্রাণে চায়-আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক, আওয়ামী লীগকে তারা ভরসা করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকাবস্থায় যদি কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীসহ দুই ডজন জেলায় সাম্প্রদায়িক হামলা হয়, লোকশিল্পী এবং বাউল শিল্পীর ওপর আঘাত আসে, বিচার না হয় এবং সর্বত্র প্রতিক্রিয়াশীলদের তীব্র আস্ফালন হয় তখন ভরসার জায়গাটা থাকে না, নড়বড়ে হয়ে যায়। যখন বাঙালি কৃষ্টিকালচার, বৈশাখের শোভাযাত্রা, বসন্তবরণ, নৌকাবাইচ বৌদ্ধদের উৎসব, খ্রিস্টানদের বড়দিন, আদিবাসীদের ধর্ম ও সংস্কৃতি, হিন্দুদের পূজা পার্বণ, মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব, গ্রাম্যমেলা, মাসব্যাপী বিজয় মেলা পুলিশি পাহারা ব্যতীত অনুষ্ঠিত হবে, সে দিন এ রাষ্ট্রকে অসাম্প্রদায়িক-শান্তির মানুষের দেশ বলা যেতে পারে, তার আগে বলার কোনো যৌক্তিকতা আছে কি?

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close