মো. জিল্লুর রহমান

  ২৪ অক্টোবর, ২০২১

পর্যবেক্ষণ

মোটরসাইকেল সড়কের জন্য হুমকি

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মানুষের কাছে নতুন এক আতঙ্কের নাম বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালনা। গত কয়েক বছরে বিশেষ করে অ্যাপসভিত্তিক রাইড সার্ভিস চালু হওয়ার পর থেকে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন মোটরসাইকেল রাস্তায় নামছে। গ্রামে-গঞ্জেও অহরহ ব্যক্তিগত বা পেশাদার মোটরসাইকেল চালনা চোখে পড়ছে। শহর ও গ্রামে হাজার হাজার মোটরসাইকেলের কারণে এক দিকে যেমন বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা, তেমনি সড়ক এবং ফুটপাতের যাত্রী ও পথচারীরাও বেশির ভাগ সময়ই বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ছেন। মোটরসাইকেলের কারণে রাস্তার চলাচলে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়ছেন নারী, শিশু, রোগী ও বয়োবৃদ্ধরা।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠনের এক প্রতিবেদন বলছে, চলতি ২০২১ সালের জুন মাসে সড়কে ১৪২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫২ জন নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ৩৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ৯৪ জন পথচারী এবং ৬৭ জন যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন। অন্য দিকে যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক তথ্য বলছে, এ বছর লকডাউনের মধ্যে কোরবানি ঈদের ছুটিতে দুর্ঘটনায় অন্তত ২৭৩ জন নিহত হয়েছে। জুলাই মাসের ১৪ তারিখ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত ১৫ দিনের তথ্য সংকলন করেছে সংস্থাটি। এ সময় সারা দেশে লকডাউন জারি ছিল। তা সত্ত্বেও গত ছয় বছরের মধ্যে দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এই সময়ের মধ্যে ২৪০টি সড়কে দুর্ঘটনায় আরো অন্তত ৪৪৭ জন আহত হয়েছে এবং এর প্রায় ৩৬ শতাংশ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে মোটরসাইকেল, ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও অটোরিকশা। প্রায় ২৯ শতাংশ দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল ট্রাক, পিকআপ ও কাভার্ড ভ্যান।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনার খবর সংকলন করে বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) ও নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলন। নিসচার হিসাবে, ২০২০ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ২৩২টি, যার ১ হাজার ১২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এরমধ্যে ২৯ শতাংশ ট্রাক ও ২২ শতাংশ বাস দুর্ঘটনার। বুয়েটের এআরআইয়ের হিসাবে, ২০১৬ সালে ২৮৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩৩৬ জন মারা যান। ২০২০ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা দাঁড়ায় ১০০৮টিতে, মারা যান ১০৯৭ জন।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা গবেষকদের মতে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো মূলত ঘটে বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা, বারবার লেন পরিবর্তন, ট্রাফিক আইন না মানা ও চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলার কারণে। হেলমেট ব্যবহার না করা ও নিম্নমানের হেলমেটের কারণেও দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালের এক তথ্য বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে যাওয়া প্রায় ৩৫ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। এরমধ্যে রাজধানীর বাইরে থেকে রোগীই সবচেয়ে বেশি আসে। তবে সম্প্রতি রাইড শেয়ারিংয়ে থাকা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত মানুষ আসার সংখ্যাও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।

আসলে মোটরসাইকেল চালকরা প্রতিনিয়ত ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করছে। যার ফলে সড়কে ঘটছে নানা ধরনের মারাত্মক দুর্ঘটনা। শহরে সড়কের উল্টো দিক দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা সর্বাধিক। তাই সবার আগে জনসচেতনতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। ফুটপাতে মোটরসাইকেল চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করা দরকার, নির্ধারিত গতিসীমার অতিরিক্ত না চালানো, ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে রাস্তার মোড় পার হওয়া, জোরে হর্ন না বাজানো, সর্বোপরি ট্রাফিক আইন মেনে চলার জন্য জনমত গঠন করা খুবই জরুরি। সেইসঙ্গে জেব্রা ক্রসিং ও ফুট ওভারব্রিজ ছাড়া রাস্তা পারাপারে পথচারীদের নিরুৎসাহিত করা দরকার।

রাজধানীর যানবাহনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আইন ভঙ্গ করছে মোটরসাইকেল। ট্রাফিক পুলিশের মতে, মোটরসাইকেল চালকরা বেশির ভাগ সময় আইন মানতে চান না। সুযোগ পেলেই তারা সিগন্যাল অমান্য করেন। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, রাস্তার কোনো এক অংশে গাড়ি চলাচল বন্ধের জন্য কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ সিগন্যাল দিয়েছেন। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, সিগন্যালের শুরুতে কয়েকটি মোটরসাইকেল জোরে টান দিয়ে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় ট্রাফিক পুলিশ এ ধরনের ক্ষেত্রে সিগন্যাল অমান্যের মামলা দেয়। কিন্তু মোটরসাইকেল সংখ্যা বেশি হওয়ায় তাদেরও হিমশিম খেতে হয়। তবে রাজধানীর কিছু কিছু জায়গায় মোটরসাইকেল চালকদের আইন মানাতে সিগন্যালের সময় রশি ব্যবহার করতেও দেখা যায়।

এসব মোটরসাইকেল সুযোগ পেলেই নিয়মনীতি উপেক্ষা করে সড়ক ছেড়ে ফুটপাতে উঠে আসছে। এ ছাড়া যানজটের মধ্যে দেড় ফুট জায়গা পেলেই বেপরোয়াভাবে ছুটে চলছে এসব মোটরসাইকেল। আসলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি ও সহজ শর্তের বিক্রয় নীতিমালা এবং অ্যাপসভিত্তিক রাইড সেবার কারণে মোটরসাইকেলের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। শুধু সিগন্যালই নয় জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করে পথচারীদের রাস্তা পারাপারের নিয়ম থাকলেও মোটরসাইকেল চালকরা ট্রাফিক সিগন্যালের সময় জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর মোটরসাইকেল থামায়, যেন সবুজ সংকেত দিলে আগেই রাস্তার মোড় পার হতে পারে। এতে পথচারীদের রাস্তা পার হতে পোহাতে হয় বিড়ম্বনা। সামনে থাকা যানবাহনকে ওভারটেকিং করার সুযোগ না থাকলেও মোটরসাইকেল যাওয়ার জায়গা করে দেওয়ার জন্য অযথা হর্ন বাজিয়ে সংকেত দেওয়ার যে মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে, তা ভয়াবহ শব্দদূষণ ঘটাচ্ছে।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পর মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীদের হেলমেট পরার বিষয়ে অনেকের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপরও অনেকেই আইন মানছেন না। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটরসাইকেল চালক হেলমেট পরিধান করলে দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার আশঙ্কা ৪০ শতাংশ হ্রাস পায় এবং মারাত্মক আহত হওয়ার আশঙ্কা ২৫ থেকে ৭৫ শতাংশ হ্রাস পায়। এ কারণে মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীদের নিজেদের জীবন বাঁচাতেই হেলমেট পরিধান আবশ্যক। অনেক সময় চালকরা মোটরসাইকেল চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলেন। এসব কারণেও মনোসংযোগের বিঘœ ঘটে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

তা ছাড়া দেশের বেশির ভাগ মোটরসাইকেল চালকের মধ্যে আইন ভাঙার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। রাস্তাঘাটে মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষমতার দাপট দেখানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ট্রাফিক পুলিশের তথ্য মতে, সারা দিনে যদি ২০টা মোটরসাইকেলকে সিগন্যাল ভঙ্গ বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের জন্য থামানো হয়, তাহলে কমপক্ষে ১০ জন বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা নেতাদের ফোন ধরিয়ে দেন। তখন বাধ্য হয়েই তাদের ছেড়ে দিতে হয় এবং এ ছাড়া তাদের কোন উপায় থাকে না। শুধু ফোনেই ক্ষমতার দাপট শেষ নয়। মোটরসাইকেলের সামনে-পেছনে পুলিশ, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, জরুরি সার্ভিস, বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামও দেখা যায়। তাদের ক্ষমতার দাপটে পুলিশের আইন ও নিয়ম তুচ্ছ হয়ে যায়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩১ লাখের বেশি, যা মোট যানবাহনের ৬৮ শতাংশ। শুধু ঢাকাতেই নিবন্ধিত মোটরসাইকেল আট লাখের মতো। এর বাইরে একটি বড় অংশের মোটরসাইকেল অনিবন্ধিত। তবে, বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় পাঁচ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়। সারা দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সড়কে বাড়ছে বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি। বেপরোয়া মোটরসাইকেলগুলো অধিকাংশ সময় ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা করছে না। সিগন্যাল উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। এমনকি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে অবাধে ফুটপাতেও চলাচল করছে। যানজটের মধ্যে সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা না করে চালকরা দলবেঁধে ফুটপাত দিয়ে চলাচল করছেন। রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে অহরহ ফুটপাত দিয়ে মোটরসাইকেল উঠিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। ফলে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন পথচারী। পথচারীদের কেউ কেউ বিরক্তি বা প্রতিবাদ করলে তাকে হেনস্তাও হতে দেখা যায়।

ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালানো বন্ধে উচ্চ আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। উক্ত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কোনো অবস্থায়ই হাঁটার পথে মোটরবাইক চালানো যাবে না। এ ছাড়া ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালালে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদ- এবং ৩৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮-এ। ভুক্তভোগীরা বলছেন, আইনগুলো বাস্তবায়ন হলে ফুটপাতে মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য অনেকাংশেই কমে যাবে।

ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) মতে, সড়ক নিরাপত্তার জন্য মোটরসাইকেল বড় হুমকি। মানুষ দ্রুত তার গন্তব্যে যেতে চায়। এ কারণেই রাজধানীর গতিহীন সড়কে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ছে। যানজট পরিস্থিতির উন্নতি হলে মোটরসাইকেল নিয়ে এত দুর্ভাবনার কারণ হতো না। মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে আইন মানার প্রবণতা তুলনামূলক কম।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনার জন্য, জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ, সড়ক ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারকারী সবাইকে সংযুক্ত করে দেশব্যাপী নিরাপদ সড়কের জন্য ক্যাম্পেইন চালানো দরকার। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্পিড রাডার বসানোর পাশাপাশি নির্দিষ্ট সীমার তুলনায় অধিক গতিতে মোটরসাইকেলসহ সব যানবাহন চালান নিরুৎসাহিত করা জরুরি। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে বিআরটিএর কর্মকর্তাদের আরো দায়িত্বশীল ও সতর্ক থাকতে হবে, যেন অসদুপায় অবলম্বন করে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া না যায়। ট্রাফিক পুলিশকে আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে আরো কঠোর ও দায়িত্বশীল হতে হবে। এ ক্ষেত্রে শ্রেণি ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে কঠোর আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে, তবে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত হবে।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close