ড. মো. শাহ কামাল খান
মুক্তমত
শোকাবহ আগস্ট এবং প্রজন্মের দায়
শুধু বাঙালি জাতির নয়, বরং বিশ্বের ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে। এই মাসেই নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবার। বঙ্গবন্ধু শুধু বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়ক হিসেবেই সীমাবদ্ধ নন, তিনি এই হত্যাকান্ডের আগেই হয়ে উঠেছিলেন সারা বিশ্বের শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কান্ডারি ও মুক্তিদূত। কায়েমী স্বার্থবাদী শোষকশ্রেণির বিরুদ্ধে তার তর্জনী, সংগ্রাম ও দৃঢ় অবস্থান মুক্তিকামী মানুষের জন্য ছিল আলোর দিশা। তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের লালন ও প্রতিষ্ঠার দায় এই প্রজন্মের। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু এখন আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার কর্ম ও সংগ্রাম আমাদের পাথেয়। নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু একটি রোল মডেল। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করা অন্যায়, স্বার্থপরতা, শ্রেণি শোষণ, সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি প্রভৃতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর যে আমরণ লড়াই ছিল, সে লড়াই নিজেদের কাঁদে তোলার দায় এই প্রজন্মের।
পুঁজিবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পুঁজিকারী কায়েমী গোষ্ঠী তার অগ্রযাত্রা ও সাফল্যে ভীত হয়ে উঠেছিল, আর তাদেরই নীলনকশার বলি হতে হয় বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রায় সবাইকে। বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মূল উদ্দেশ্য কেবল ব্যক্তি মুজিবকে হত্যা নয়, বরং তার আদর্শকে হত্যার চেষ্টাও। স্বাধীনতা শব্দটি বঙ্গবন্ধুর মতো করে কেউ বলতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন, স্বপ্ন দেখাতেন। তিনি বাঙালি জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন একটি ঐক্যবদ্ধ, দারিদ্র্যমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। দেশের প্রতি ছিল বঙ্গবন্ধুর সীমাহীন আবেগ, অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা। তথাকথিত পুঁজিবাদী এলিট শ্রেণি, ধর্ম ব্যবসায়ী ও ১৯৭১ সালে পরাজিত শক্তি প্রতিশোধ স্পৃহায় জ্বলতে থাকা গোষ্ঠীর সম্মিলিত চক্রান্তের ঘৃণ্য ফসল বাঙালির প্রাণের স্পন্দন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা। অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় সফল হলেও কায়েমী স্বার্থগোষ্ঠী তার আদর্শ হত্যা করতে সফল হয়নি। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান পাওয়া বঙ্গবন্ধু আরো প্রাসঙ্গিক ও দীপ্তমান হয়েছেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।
বঙ্গবন্ধুর শোষণমুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আঘাত হেনেছে বারবার। যে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন জাতির পিতা দেখিয়েছিলেন, তাতেও কুঠারাঘাত এসেছিল বারবার। এই কায়েমী স্বার্থগোষ্ঠী আজও সরব। দেশে এবং বিদেশ থেকে ষড়যন্ত্রের নানা জাল বুনছে। এসব ষড়যন্ত্রকে সমূলে ধ্বংস করতে এই প্রজন্ম রাখতে পারে অগ্রণী ভূমিকা। জাতির জনকের আদর্শ ধরে রাখতে হলে সততা ও নৈতিকতার আদর্শিক ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন ঘটিয়ে কর্তব্যপরায়ণ ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ নিজ অবস্থানে অবদান রেখে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। এই মুক্তি অর্জনে প্রয়োজন সত্যিকার দেশপ্রেম। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম দায়িত্ববোধ ও দেশপ্রেমের মহান দীক্ষায় এগিয়ে যেতে পারলেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সমুন্নত রাখা হবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই ইতিহাসের প্রতিটি পর্বে তরুণরা ছিল অগ্রসেনানী। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে নির্বাচন, ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা, সবকিছুতেই ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, ছিল তারুণ্যের তেজোদ্বীপ্ত কণ্ঠ, ছিল সাহসী পদচারণা। ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ, এরপরই বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়ে জনগণের সংগঠন হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ। যেখানে তরুণদের ভূমিকা ছিল অনেক। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দীক্ষিত হয়ে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুণাবলি ধারণ করে একটি পরিশীলিত ও পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরিতে রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থে তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সামনে উপস্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করার দায়িত্ব নিতে হবে এই প্রজন্মের তরুণদেরই। পরাজিত ও পথভ্রষ্ট শক্তিকে বাঙালি জাতি যেভাবে পরাজিত করেছিল, তার ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার মহান কাজটি করতে হবে তরুণ প্রজন্মকেই। এখনো একটি শক্তি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির নগ্ন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নানাভাবে। অনেক ক্ষেত্রেই বিভ্রান্তির চেষ্টা করা হচ্ছে, যা রুখে দিতে এই তরুণ প্রজন্মকেই সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ইতিহাস বিকৃতির সব চেষ্টাকেই প্রতিহত করার দৃঢ় সংকল্প রাখতে হবে প্রজন্মের এই প্রতিনিধিদের।
বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা বই দুটি তরুণ প্রজন্মের এগিয়ে যাওয়ার পাথেয়। বইয়ের বিভিন্ন অংশে জাতির জনক লিখে গেছেন তরুণ বয়সের সংগ্রামের কথা, যা এই প্রজন্মের জন্য হতে পারে পাথেয়। তিনি তরুণদের বলেছেন, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো, অভয় মানো। তরুণদের আরো বলছেন, যেখানে অন্যায়-অবিচার, সেখানে প্রতিবাদ করো; মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ক্ষমতার এবং স্বার্থের ঘর বড় করে, তাদের প্রতিরোধ করো। সত্যিকারার্থে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বঙ্গবন্ধুর জীবনকে বিশ্লেষণ করলেই অনেক সহজ সমাধান পাওয়া যায়। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের বর্তমান তরুণ প্রজন্ম জাতির জনকের আদর্শে মহীয়ান হয়ে আগামী শতকের কান্ডারি হয়ে দেশের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বলীয়ান হয়ে দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক মূলবোধকে জাগ্রত করে তরুণ প্রজন্ম উপহার দিতে পারে একটি শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত সমাজ।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়ার। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যেন দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্ত হয়, এ দেশের প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো যেন নিশ্চিত হয়। সেই লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ অবস্থান থেকে স্বার্থপরতা, বিশ্বাসঘাতকতা, দুর্নীতিপরায়ণতা- এসব নেতিবাচক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে নিজেদের দূরে রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের লালন ও প্রতিষ্ঠার দায় এই প্রজন্মের। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু এখন আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার কর্ম ও সংগ্রাম আমাদের পাথেয়। নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু একটি রোল মডেল। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করা অন্যায়, স্বার্থপরতা, শ্রেণি শোষণ, সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি প্রভৃতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর যে আমরণ লড়াই ছিল, সে লড়াই নিজেদের কাঁধে তোলার দায় এই প্রজন্মের। একটি উন্নত, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন বঙ্গবন্ধু। এমন একটি দেশ গড়তে তরুণরাই হোক বড় শক্তি। শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বলীয়ান হয়ে এই প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কারিগর হয়ে উঠুক- এটুকুই প্রত্যাশা।
লেখক : প্রকল্প পরিচালক
কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা
"