অলোক আচার্য

  ২৩ অক্টোবর, ২০২১

পর্যবেক্ষণ

বাজার ও সাধারণ ক্রেতাপক্ষের জীবন

চাহিদা ও ভোগ দুটিই আর্থিক সক্ষমতার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। যার যেমন আয় তার তেমন ব্যয়। আবার কথায় বলে আয় বুঝে ব্যয় করো। কিন্তু পণ্যের দাম যদি হরহামেশাই বাড়তে থাকে তাহলে ব্যয়ের লাগাম ধরার চেষ্টা বৃথা। একটি পণ্যের দাম বৃদ্ধি নানাভাবে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব বিস্তার করে। তার জীবনযাপনের ধরন বদলাতে বাধ্য করে। প্রতিদিন আমাদের সকালে ব্রাশ করার টুথপেস্ট থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া, সন্তানের লেখাপড়া, পরিবহন খরচ, চিকিৎসা খরচ ও ঘুমাতে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যে ব্যয় রয়েছে তা যদি ক্রমেই বৃদ্ধি পায় তাহলে তা সরাসরি জীবন মানের ওপর প্রভাব ফেলে। কারণ বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে জনগণের জীবনমান ঘনিষ্টভাবে সম্পৃক্ত থাকে। দ্রব্যমূল্য ওঠানামা করলে জনগণের জীবন মানও ওঠানামা করে। জনগণের জীবন মান নিয়ন্ত্রণের বড় নিয়ামক হলো সে দেশের বাজার ব্যবস্থা। গড় আয় বৃদ্ধি পেলেও অস্থির বাজার কোনো দেশের অভ্যন্তরের জন্য স্বস্তির হতে পারে না। দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের প্রধান টেনশনের কারণ থাকে বাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য।

দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকলে এবং সেইসঙ্গে আয় বৃদ্ধি না পেলে বাধ্য হয়ে সংসারের খরচে লাগাম দিতে ভোগের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয় এবং জীবনযাপন পরিবর্তন করতে হয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বা ভোগ্যপণ্য। প্রতিদিন বাজারে পৌঁছে যে দ্রব্যগুলো না কিনলেই চলে না সেই পণ্যের দাম। বিলাস দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে খুব বেশি পরিবর্তন ঘটে না। কিন্তু মাছ, মাংস, তেল, ডাল, লবণ, মরিচ, আদা, পেঁয়াজসহ প্রতিদিনের আবশ্যকীয় উপকরণগুলোই এসব মানুষের দুশ্চিন্তার বড় কারণ। তিন বেলা খাওয়ার পেছনেই যদি একটি পরিবারের অধিকাংশ অর্থ ব্যয় করতে হয় তখন বাকি মৌলিক চাহিদা পূরণ কঠিন হয়ে পড়ে। এরপরই আয়ের একটি বড় অংশ খরচ করতে হয় চিকিৎসা ব্যয় বাবদ। এমন একটি পরিবার খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে যে পরিবারে প্রতিদিন ওষুধের দরকার হয় না। চিকিৎসার একটি বড় অংশই অনেক পরিবারে ব্যয় করতে হয়। এখানেও বেড়েছে ব্যয়। ওষুধের দাম, চিকিৎসা খরচ সব মিলিয়ে হিমশিম অবস্থা সাধারণ আয়ের মানুষের। এরপর যদি পরিবারের পোশাক এবং সন্তানের পড়ালেখার ব্যয় ধরা হয় তাহলে একটি ছোট পরিবারেরও ব্যয় গত কয়েক বছরে বেড়েছে ব্যাপক হারে। সেই তুলনায় বাড়েনি সেইসব মানুষের আয়। উল্টো করোনা মহামারির প্রভাবে অনেক পরিবারের আয় কমে গেছে। যার নিশ্চিত প্রভাব পরেছে পরিবারের সদস্যদের জীবন যাত্রায়। মাঝে মাধ্যেই বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠছে। তাহলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের দাঁড়ানোর জায়গা কোথায়? যারা দিন আনে দিন খায় তাদের অবস্থা কী হবে? সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় করতেই হিমশিম অবস্থা মানুষের।

খাওয়ার পেছনেই যদি আয়ের বড় একটি অংশ খরচ হয়ে যায় তাহলে বাকি চাহিদাগুলো কীভাবে পূরণ করবে। দেখা যায়, এক দিকে সামাল দিতে অন্য দিকে কাটছাঁট করতে হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে। পরিস্থিতি সামাল দিতে দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে। তাও যেন সংসারের হাল ঠিক রাখা যাচ্ছে না। কারণ খরচ বেড়েই যাচ্ছে। এই করোনাকালীন জীবনযাপন এমনিতেই নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য কষ্টের তারপর বাজারের এই চিত্র তাদের নাকাল করে দিচ্ছে। অথচ সবার জন্য সুযোগ নিশ্চিত করতে হলে বাজার ব্যবস্থা দক্ষ হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও অনেক ক্ষেত্রে বাজারে তার কোনো প্রভাব দেখা যায় না। উদাহরণস্বরূপ চালের বাজার। তাহলে বাজার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকে? করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে মানুষের জীবন যাত্রা পরিবর্তনের যে টানাপড়েন শুরু হয় তার অন্যতম হলো আর্থিক সমস্যা। এখনো বেকার বা অর্ধ বেকার জীবনযাপন করছে বহু মানুষ। এখনো ঘুরে দাঁড়াতে আরো সময় লাগবে। এরই মধ্যে বন্যার প্রকোপ মানুষকে নাজেহাল করে দেয়। অস্থির জীবনে আরো অস্থিরতা নেমে আসে। বাজার অগ্নিমূল্য হয়ে ওঠে। জনগণের জীবনমান আরামদায়ক করতে সবচেয়ে আগে দরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ। একটি সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা সেই দেশের জনগণের জীবনমান উন্নয়নে এবং দেশের উন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবারের চাহিদা পূরণ সম্ভব না হলে অর্থাৎ প্রতিদিনের চাহিদা পূরণ করতে সামর্থ্য না হলে অনেক ক্ষেত্রে অপরাধের পথও বেছে নিতে পারে।

মাঝে মাঝে দু-একটি পণ্যের দাম কমার খবর পেলেও তা স্থায়ী হয় না। প্রতিদিন একটি পরিবারে যে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের দরকার হয় তা একত্র করলে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলানো যেন এক দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ যেন একটি পরিবার সুষ্ঠুভাবে চালাতে পারে সেই কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বাজার অস্থির করে। চার-পাঁচজনের একটি পরিবারে যদি একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি থাকে তাহলে চাল, ডাল, সবজি কিনতেই প্রতিদিনের আয়ের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে। একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হলো, কারো আয় যতটুকুই বৃদ্ধি পাক তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম স্থিতিশীল রাখা। কোনোভাবেই যেন তা হাতের নাগালের বাইরে না যায়। ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই মূল্য বেঁধে রাখা জরুরি। বাজার করতে গিয়েই তার দৈনিক আয়ের বেশির ভাগ অংশই খরচ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে পরিবারের অন্য আবদার সে কীভাবে পূরণ করবে? তারও তো সন্তান আছে। তাদের ইচ্ছা হয় বাবার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার। তারা বাজার বোঝে না। বাবা যদি বলে বাজারে জিনিসপত্রের খুব দাম তাতে তারা খানিকটা অবাকই হয় বটে। সাধারণ ক্রেতারা যাতে তাদের আয়ের মধ্যেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা পূরণ করতে পারে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।

করোনা অতিমারি এখন কমতে শুরু করেছে। কিন্তু গত প্রায় দুই বছরে বহু লোকের কর্মসংস্থানে পরিবর্তন ঘটেছে। কাজ হারিয়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে ভিন্ন পেশা নিতে বাধ্য হয়েছে। অনেকে ঋণ নিয়েছে এবং তা শোধ করতে হচ্ছে করোনায় জীবন যাত্রায় এই পরিবর্তন এখনো কাটিয়ে ওঠতে পারেনি সাধারণ মানুষ। এই অবস্থা কাটাতে এবং আগের অবস্থানে পৌঁছাতে আরো দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে। এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম যে গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে সংসারের প্রতিদিনের খরচ সামাল দিয়ে অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠেছে। কেন দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে একজন সাধারণ মানুষের সে কথা বোঝার ক্ষমতা নেই। কারণ দাম বৃদ্ধি আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গেও প্রভাবিত হয়ে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্রয়ক্ষমতার ভেতর না থাকলে তা নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ভোগান্তির কারণ ছাড়া আর কিছুই হবে না।

ব্রয়লার মুরগির দাম যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে একসময় যারা মাংসের চাহিদা ব্রয়লার মুরগির মাধ্যমে পূরণ করত তারা এখন সেটাও কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। আর এর চেয়ে কম মূল্যের মাংসের বিকল্পও নেই। দেশি মাছের কেনার ক্ষমতা তো সবার হয় না। কারণ ওই মূল্য। এলপিজি গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু একজন ব্যক্তি মাস শেষে যে টাকা আয় করত সেই আয় কি হুট করেই এর সঙ্গে সংগতি রেখে বৃদ্ধি পেয়েছে? পায়নি। তাহলে এই অতিরিক্ত খরচ মেটাতে তাকে দিনান্ত পরিশ্রম করতে হচ্ছে, কখনো তা পূরণ করতেই পারছে না, চাহিদা বাধ্য করেই কমিয়ে দিতে হয়েছে। হয়তো সন্তানকে যে ভালো স্কুলে পড়াত সেখানে বেতন বেশি। ফলে বাধ্য হয়ে সেখান থেকে তাকে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পোশাক ও রুচির পরিবর্তন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে খুঁজতে হবে সস্তার বাজার। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করাতেও হিমশিম খেতে হবে। অর্থাৎ পুরো জীবনযাত্রার ধরনেই পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ সবার ওপরে প্রতিদিনের খাওয়া। তারপর তো বাকি সব। সেখানেই যদি টান পরে তাহলে নিশ্চিতভাবেই বাকি চাহিদাগুলোতে টান পরবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close