আবদুর রশীদ

  ২২ অক্টোবর, ২০২১

ফিরে দেখা

মহানবী (সা.) এর ভূমিকা ভুল সংশোধনে

ইসলাম প্রচার ও প্রসারের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা তথা দাঈদের কৌশলের সঙ্গে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করার জন্য কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর দিকে মানুষকে হিকমাহ ও সুন্দরতম উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান করবে, আর বিতর্ক করবে উত্তম পন্থায়’- (সুরা নাহল : ১২৫)। যাতে মানুষ আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে ভীত হয়ে না পড়ে এবং দূরে সরে না যায় অথবা তা যেন সাময়িক কোনো আবেগের বস্তুতে পরিণত না হয় যে, ক্ষণে ক্ষণে মানুষ তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং ক্ষণে ক্ষণে ফিরে আসে।

কাজেই আল্লাহর পথে সর্বদা মূল লক্ষ্য হবে- মানুষের গুণগত পরিবর্তন। তথা আল্লাহর দিকে মানুষের এমনভাবে ধাবিত হওয়া, যা হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং মৌলিক পরিবর্তন। আর তা যদি না হয়, তাহলে বিষয়টি হবে অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ও হেলাফেলার বিষয় এবং সে জন্য দাঈরা তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না। কাজেই উল্লিখিত কারণে এবং সম্ভাব্য মেকি বা লোকদেখানো পরিবর্তনের বিষয়ে দাঈরা যাতে সর্বদা সতর্ক থাকেন সে জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআনে দাওয়াতি কাজের ক্ষেত্রে হিকমাহর আদেশ করেছেন। আর হিকমাহ হচ্ছে এমন সব উন্নত গুণাবলির সমন্বিত নাম, যা উম্মাহর মেধাবী, চৌকস ও প্রতিশ্রুতিশীল বিবেকবান দাঈরা অর্জন করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের এ মহান কাজে বর্তমানে এমন সব লোকদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, যাদের মধ্যে হিকমাহর গুণ দারুণভাবে অনুপস্থিত। ফলে দাওয়াতের ময়দানে ক্রমাগত বিবাদ-বিশৃঙ্খলা ও হিংসা-বিদ্বেষ বেড়েই চলেছে। এমতাবস্থায় এ বিষয়ে সবার বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।

মহান আল্লাহতায়ালা মানবজাতির সৃষ্টির সূচনা করেন হজরত আদম (আ.)-এর মাধ্যমে পরে আদম (আ.)-এর জীবন সঙ্গিনী হাওয়া (আ.) কে সৃষ্টি করেন পৃথিবীতে সৃষ্টির সেরা জীব হলো মানবজাতি। আর এই মানবজাতির প্রথম ব্যক্তি হজরত আদম (আ.) নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণের ভুল করে বসলেন জান্নাতে আর ভুলের নিমিত্তে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং শুরু হয় দুনিয়ায় মানবজাতির জীবন পরিচালনা। এ ছাড়াও হজরত আদম (আ.)-এর ছেলে কাবিল তার নিজ ভাই হাবিলকে হত্যার মাধ্যমে একটি জঘন্য ভুল করেছিলেন। এই ভুলটিই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম হত্যাকাণ্ড হিসেবে পরিচিত মানব সৃষ্টির সূচনা হতে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন ভুলের সূচনা হয়ে চলছে। কোনোটা সামান্য আবার কোনোটা জঘন্য। ভুল সাধারণত একটি স্বাভাবিক বিষয়। হতে পারে ভুলটি জিনা, হত্যা, চুরি, ডাকাতি অথবা কথাবার্তায় কিংবা আচরণে অন্যকে কষ্ট দেওয়া ইত্যাদি।

ভুল যেমন রয়েছে, তেমনি সংশোধনও রয়েছে। ইসলাম প্রতিটি ভুলের সংশোধন দিয়েছেন নিপুণভাবে। প্রতিদিন আমরা কোনো না কোনো ভুল করে ফেলি। কিন্তু কেউ কোনো একটা ভুল করে বসলে আমরা সাধারণত তাকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে সংশোধন করে দিই না; বরং ধমক দেওয়ার পাশাপাশি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথাও বলে বসি। আজ বড় কিংবা জঘন্য কোনো ভুল নিয়ে কথা বলছি না, বলছি নিত্যনৈমিত্তিক সূচিত হওয়া ছোট ছোট ভুলের কথা। ভুল সংশোধনে প্রিয় রাসুল (সা.)-এর আচরণ ছিল অত্যন্ত হিকমাহ ও আন্তরিকপূর্ণ। একবার রাসুল (সা.) হজরত আনাস (রা.) কে বললেন, ‘আনাস, তুমি কি এ কাজটা করতে পারবে? আনাস (রা.) বললেন, না, আমি পারব না (আনাস (রা.) তখন ছিলেন ছোট)। এ কথা শুনে রাসুল (সা.) মুচকি হাসলেন এবং সেখান থেকে চলে গেলেন। হজরত আনাস (রা.) দীর্ঘ ১০ বছর রাসুল (সা.)-এর খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘ওই দিন রাসুল (সা.)-এর মুচকি হাসিই ছিল আমার জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি। আমার জীবনে আর কোনো এমন ভুল দ্বিতীয়বার হয়নি। এ ছাড়াও যেকোনো ভুল হলে, ‘তুমি এটা কেন করলে?’ এমনটিও তিনি বলতেন না। এমনকি রাসুল (সা.)-এর খেদমতে কাটানো দীর্ঘ ১০ বছরে রাসুল (সা.) আমার প্রতি একটি কটু বাক্যও ব্যবহার করেননি।

এক কুরাইশ সাহাবি (রা.) এসে রাসুল (সা.)-এর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে বললেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ, আপনি আমাকে জিনা করার অনুমতি দিন।’ তখন মজলিসে থাকা অন্য সাহাবিরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু রাসুল (সা.) অত্যন্ত আন্তরিকপূর্ণ হিকমার সঙ্গে যুবককে কাছে এনে বললেন, ‘হে আমার সাহাবি শুনো, এমনটি তোমার মায়ের সঙ্গে হোক তা কি চাও? সে জবাবে বললেন, না। অতঃপর, রাসুল (সা.) বললেন, তোমার কন্যা বা বোনের সঙ্গে হোক এমনটি চাও? সে পুনরায় জবাবে বললেন, না এবং অন্যরাও তা চাইবে না। অবশেষে যুবক সাহাবি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। অতঃপর, রাসুল (সা.) যুবক সাহাবির হাত ধরে দোয়া করে বললেন, ‘আল্লাহ, যুবকের পাপকে ক্ষমা করে দিন, তার অন্তরকে পবিত্র করুন এবং তাকে সহিষ্ণু করুন (তার এমন কামনার বিরুদ্ধে)।’ ওই ঘটনার প্রতি ভালো করে লক্ষ্য করুন, যুবকটি স্বয়ং রাসুল (সা.)-এর কাছে জঘন্য একটি পাপ কাজের অনুমতি চাওয়াতে রাসুল (সা.) রেগে যাননি এবং ধমকও দেননি; বরং অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে কাছে টেনে হিকমার সঙ্গে বুঝিয়েছেন এবং তার ভুলকে সংশোধন করেছেন।

এ ছাড়াও বিভিন্ন হাদিসের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, ভিন্ন ভিন্ন হাদিসে ভিন্ন ভিন্ন উত্তম কাজের কথার উল্লেখ রয়েছে, যা সাধারণত হাদিসের মাঝে বৈপরীত্য আছে বলে মনে হয় কিন্তু প্রকৃত অর্থে কোনো বৈপরীত্য নেই। এর কারণ রাসুল (সা.) সাহাবির চরিত্রের ওপর ভিত্তি করে হিকমার সঙ্গে শিক্ষা দিতেন। অর্থাৎ কোনো সাহাবি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে যদি জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কোন কাজটি সর্বোত্তম?’ তখন রাসুল (সা.) সাহাবির চরিত্রে কোন বৈশিষ্ট্যের অভাব তার প্রতি লক্ষ্য করে বলতেন, অমুক কাজটি উত্তম। ফলে ওই সাহাবি নিজের জীবনে ঘাটতি থাকা আমলকে পূরণ করার প্রচেষ্টা শুরু করে দিতেন। এভাবে রাসুল (সা.) প্রত্যেকের ভুল সংশোধন করতেন অত্যন্ত হিকমার সঙ্গে। তিনি বলতেন না যে তোমার এই সমস্যা, ওই সমস্যা কিংবা তুমি এই ভুলটি করছো বা ওই ভুলটি করছো; বরং হিকমার সঙ্গে বলতেন এই কাজটি করা সবচেয়ে উত্তম এবং ওই কাজটি সবচেয়ে ঘৃণ্য। ফলে সাহাবিরা ভুলের ওপর থেকে অতি সহজে সরে দাঁড়াতে সক্ষম হতেন।

বর্তমান সময়ে দেখা যায়, পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন অফিস-আদালত ও দোকানের কর্মচারীর ভুলে মালিক অত্যন্ত কটু বাক্য ব্যবহার করে থাকে, ধমক দিয়ে থাকে এবং প্রহার করে বসে ইত্যাদি। এমনটা করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। মনে রাখবেন, কাউকে সরাসরি আঘাত দিয়ে কথা বললে কিংবা ভুল সংশোধনের উদ্দেশে বললেও মাঝে মাঝে তা হিতে বিপরীত ঘটে। তাই রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে ভুলকে সংশোধন করার চেষ্টাতে রয়েছে সাফল্য। সুতরাং কারো দ্বারা কোনো ভুল সংঘটিত হলে আমরা যেন তাকে অত্যন্ত আন্তরিকপূর্ণ হিকমার সঙ্গে বুঝিয়ে বলি যে আপনি এমনটি করলে আরো ভালো হতো বা আপনি চাইলে এই পথ অবলম্বন করতে পারতেন কিংবা আপনার কাজে আরো সেন্সিটিভ হওয়া বাঞ্চনীয় ইত্যাদি বিভিন্ন উপায়ে ভুল সংশোধনে হিকমাহ অবলম্বন করা উচিত। এরূপ যদি আমরা প্রতিটি ভুলের সংশোধনে হিকমাহ অবলম্বন করতে পারি, তাহলে অবশ্যই আল্লাহতায়ালা পরিবার, সমাজ ও দেশের মধ্যে আরো বেশি শান্তি ও সম্পৃতি দান করবেন এবং খুব সহজে মানুষ নিজের ভুল থেকেও সরে দাঁড়াতে পারবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের সঠিক বুঝার ও আমল করার তওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : শিক্ষার্থী

সরকারি সিটি কলেজ চট্টগ্রাম

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close