রেজাউল করিম খান

  ১৪ অক্টোবর, ২০২১

ঐতিহ্য

নাটোরের কাঁচাগোল্লা

যারা নাটোরে আসেন রানি ভবানীর প্রাসাদ ও উত্তরা গণভবন দর্শনের জন্য, ফেরার সময় তারা সাধারণত কাঁচাগোল্লা কিনতে ভুল করেন না। আর যারা সাহিত্যানুরাগী বা কাব্যরসিক বা কবিতাপ্রেমিক, তারা মনের গভীরে লুকিয়ে রাখা স্বপ্নের রানি বনলতা সেনের সন্ধান করেন। আজ শোনাতে চাই কাঁচাগোল্লার গল্প। স্বাদে অতুলনীয় মিষ্টান্ন ‘নাটোরের কাঁচাগোল্ল­া’। নামে কাঁচাগোল্লা হলেও এ মিষ্টান্ন কিন্তু কাঁচা নয়, আবার দেখতে রসগোল্লার মতো গোলও নয়। খাঁটি দুধের তৈরি ছানা আর পরিমাণমতো চিনি দিয়ে তৈরি হয় এই মিষ্টান্ন। কাঁচাগোল্লা তৈরির সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত ছিলেন, সেসব কারিগরের উত্তরসূরিদের অধিকাংশই সাতচল্লি­শে দেশভাগের পর ভারতে চলে যান। অনেকেই এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। কাঁচাগোল্ল­া নিয়ে কোনো গবেষণার কথাও শোনা যায় না। তাই কাঁচাগোল্ল­ার সঠিক ইতিহাস মিলবে না।

কাঁচাগোল্ল­া তৈরি যদিও শুরু হয় নাটোরে, কিন্তু ঠিক কবে, তা নিয়ে নাটোর শহরেই ভিন্ন ভিন্ন জনশ্রুতি রয়েছে। শহরের অনেকে বলেন, নাটোর রাজের বড় তরফের রাজা গোবিন্দ্রনাথের স্ত্রী ব্রজসুন্দরীর দত্তকপুত্র মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় (১৮৬৮-১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ) একটু খেয়ালি প্রকৃতির ছিলেন। এক রাতে মিষ্টি খাওয়ার বায়না ধরেন তিনি। ডাকা হলো রাজার মিষ্টান্ন কারিগরকে। কিন্তু এত রাতে কোথায় পাওয়া যাবে মিষ্টি? কীভাবেই-বা মিষ্টি তৈরি হবে? কারিগর নিজের বুদ্ধিতে গাভির দুধ সংগ্রহ করে ছানা তৈরি করলেন; এরপর কড়াইয়ে জল চিনি মিশিয়ে উনুনে কিছুক্ষণ জ্বাল দিলেন। পরে তাতে ছানা ঢেলে দিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল সুস্বাদু এক নতুন মিষ্টি। মহারাজা তা খেয়ে দারুণ খুশি। এমন স্বাদের মিষ্টির নাম জানতে চাইলেন তিনি। কোনো কিছু না ভেবেই কারিগর বললেন ‘কাঁচাগোল্লা’।

অন্য এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, নিতান্ত দায়ে পড়েই তৈরি হয়েছিল এই মিষ্টি। শহরের নিচাবাজারে মধুসূদন পাল নামে এক ব্যক্তির দোকান ছিল। নাটোরের প্রসিদ্ধ এ মিষ্টির দোকান থেকে প্রতিদিন ট্রেনে করে ৪০-৫০ টিন বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি যেত কলকাতায়। রাজবাড়ীতেও পাঠানো হতো সেই মিষ্টি। মধুসূদন পালের দোকানে দশ-বারোজন দক্ষ কারিগর কাজ করতেন। এক দিন কয়েকজন কারিগর না আসায় বেশ কিছু পরিমাণ ছানা বেঁচে যায়। মধুসূদনের তো মাথায় হাত! এত ছানা এখন কী হবে? এই চিন্তায় তিনি অস্থির। নষ্টের হাত থেকে রক্ষা করতে ছানাতে চিনি ঢেলে জ্বাল দিয়ে নামিয়ে রাখা হয়। দেখা যায়, চিনি মেশানো ছানার দারুণ স্বাদ হয়েছে। আর এই নতুন মিষ্টান্নর নাম দেওয়া হয় কাঁচাগোল্লা।

কাঁচাগ্লোল্লার স্বাদ রসগোল্লা, পানতোয়া, এমনকি অবাক সন্দেশকেও হার মানিয়ে দেয়। এর রয়েছে একটি মিষ্টি কাঁচা ছানার গন্ধ, যা অন্য কোনো মিষ্টিতে পাওয়া যায় না। ধীরে ধীরে মিষ্টি রসিকরা এই মিষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। তখন থেকে মধুসূদন নিয়মিতই এই মিষ্টি তৈরি করতে থাকেন। কাঁচাগোল্ল­ার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এমনই সব গল্প পত্রপত্রিকায় লেখা হয়। তবে এর সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে।

মনে রাখতে হবে, জনশ্রুতি কিন্তু ইতিহাস নয়। রাতে মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়ের মিষ্টি খাওয়ার বায়নাটি নিছক গল্প বলেই মনে হয়। আবার রাজার পাঁচক বা বাবুর্চিদের মধ্যে মধুসূদন পাল নামে কেউ ছিল, এমন তথ্য জানা যায় না। অনেকে বলেন, নাটোরের রানি ভবানীর সময়ে কাঁচাগোল্ল­া তৈরি শুরু হয়। এরও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। সাবেক সচিব ও নাটোরের ইতিহাসপ্রণেতা সমর পাল জানান, ‘বলা হয় রানি ভবানীর সময়ে জনৈক মধুসূদন পাল কাঁচাগোল্ল­ার আবিষ্কারক। আমার পূর্বপুরুষরা মূলত নাটোর শহরের প্রথম মিষ্টি ব্যবসায়ী। লালবাজার ও নিচাবাজারে তাদের স্বজনরাই বিরাট জায়গা জুড়ে ব্যবসা করতেন। রানি ভবানী মারা যান ১৮০২ সালে, আর মধুসূদন পালের জন্ম ১৮৮৫ সালে।’ সুতরাং...

এ কথা মানা যায় না যে, রানি ভবানীর সময়ে কাঁচাগোল্লা আবিষ্কার হয়েছে। তবে শতাধিক বছর আগেই কাঁচাগোল্ল­া সম্পর্কে প্রচারণা শুরু হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই রাজশাহী গেজেটসহ কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি নিয়ে লেখালেখি হয়ে আসছে। কলকাতা ও নাটোর শহর একই সময় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এই দুই শহরের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল; ফলে কলকাতা থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নাটোরের কাঁচাগোল্লার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

কাঁচাগোল্ল­ার উপাদান : খাঁটি দুধের ছানা ও চিনি কাঁচাগোল্ল­া তৈরির প্রধান উপাদান। ১ কেজি কাঁচাগোল্ল­া তৈরি করতে প্রায় ১ কেজি কাঁচা ছানা ও ৪০০ গ্রাম চিনির প্রয়োজন। কড়াইয়ে চিনিগুলো পানিসহ জ্বাল দিতে হয়। চিনি পরিষ্কার করতে সামান্য কাঁচা দুধ দিলে ভালো হয়। কড়াইয়ের গাদণ্ডময়লা পরিষ্কার হয়ে গেলে ছানা ঢেলে দিতে হয়। এরপর জ্বাল এবং একই সঙ্গে কাঠের খড়া খুন্তি দিয়ে নাড়তে হবে। এভাবেই ৩০ থেকে ৪০ মিনিট বিরামহীন নাড়তে নাড়তেই পরিপূর্ণ কাঁচাগোল্লা তৈরি হয়ে যাবে। তবে এই নাড়াচাড়ার মধ্যেই রয়েছে শৈল্পিক কৌশল। মোটামুটি এই হচ্ছে ১ কেজি কাঁচাগোল্ল­া তৈরির হিসাব। একজন প্রবীণ কারিগর জানান, তারা কাঁচাগোল্ল­ায় ছোট এলাচ ব্যবহার করেন না। এর ফলে প্রকৃত কাঁচা ছানার গন্ধ অক্ষুণœ থাকে। বর্তমানে নাটোর শহরে বেশ কিছু দোকানে মানসম্মত কাঁচাগোল্ল­া পাওয়া যায়। প্রতি কেজির দাম পড়বে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।

শীতের মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর পর্যটক নাটোরের উত্তরা গণভবন ও রানি ভবানীর রাজবাড়ী দর্শনে আসেন। এ সময় কাঁচাগোল্ল­া বিক্রির ধুম পড়ে যায়। এ ছাড়া ঈদ ও পূজার আগেও বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close