মো. আরাফাত রহমান

  ১৪ অক্টোবর, ২০২১

দৃষ্টিপাত

বিশ্বকে চমকে দিয়েছে প্যান্ডোরা পেপারস

বিশ্বব্যাপী অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জোট ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) গত ৩ অক্টোবর প্রায় ১১ দশমিক ৯ মিলিয়ন গোপন নথি প্রকাশ করেছে যা প্যান্ডোরা পেপারস নামে সমগ্র বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ১১৭টি দেশের ৬০০ জনের বেশি সাংবাদিক ১৪টি উৎস থেকে নথি বিশ্লেষণ করে বিশ্বের ১৪০টিরও বেশি প্রভাবশালীর নাম প্রকাশ করেছে। এর আগেও নথি ফাঁসের ঘটনা বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলেছে। রিয়েল এস্টেট, শিল্প এবং গহনার মতো অ-আর্থিক মূল্যবান জিনিসপত্র বাদেই আনুমানিক ৩২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার কর ফাঁকি দেওয়া এ সম্পদের তথ্য ফাঁস হয়েছে।

প্যান্ডোরা শব্দের আভিধানিক অর্থ শামুক শ্রেণির এক ধরনের প্রাণী, যার খোলস অনেকটাই ভঙ্গুর। বিশ্বজুড়ে আর্থিক কেলেঙ্কারির ফাঁস করা ঘটনাটির তাই নাম দেওয়া হয়েছে প্যান্ডোরা পেপারস। এসব কেলেঙ্কারি প্রকাশ করতে নেতৃত্ব দেয় ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস। পানামা পেপারস ফাঁসের চার বছর পর প্যান্ডোরা পেপারস প্রকাশ পেল। ফাঁস হওয়া তথ্যে বর্তমান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপ্রধান এবং ১০০ জনেরও বেশি বিলিয়নিয়ার, সেলিব্রিটি ও ব্যবসায়ী নেতাসহ ৩৫ বিশ্বনেতাদের গোপন অফশোর অ্যাকাউন্ট উন্মোচিত হয়েছে।

আইসিআইজে ৭০টির বেশি দেশে ২০০ জনেরও বেশি অনুসন্ধানী সাংবাদিক এবং ১০০টি মিডিয়া সংস্থার ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক। সেন্টার ফর পাবলিক ইন্টিগ্রিটি দ্বারা ১৯৯৭ সালে চালু হয়ে আইসিআইজে ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সালে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন সংগঠনে পরিণত হয় যা সীমান্তের অপরাধ, দুর্নীতি এবং ক্ষমতার জবাবদিহির মতো ইস্যুতে কাজ করে। আইসিআইজে বহুজাতিক তামাক কোম্পানি দ্বারা সংগঠিত অপরাধ, সিন্ডিকেট দ্বারা চোরাচালান ও কর ফাঁকি উন্মোচন করেছে, বেসরকারি সামরিক কার্টেল, অ্যাসবেস্টস কোম্পানি এবং জলবায়ু পরিবর্তন লবিস্টদের ওপর অনুসন্ধান করেছে এবং ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ চুক্তির বিবরণ প্রচার করে নতুন ভিত্তি রচনা করেছে।

সেন্টার ফর পাবলিক ইন্টিগ্রিটি ১৯৯৭ সালে বিশ্বের প্রথম প্রিমিয়ার ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টারদের ওয়ার্কিং নেটওয়ার্ককে একত্রিত করা শুরু করে। ২০০০ সালের মধ্যে আইসিআইজে ৩৯ টি দেশে ৭৫ জন বিশ্বমানের অনুসন্ধানী সাংবাদিকের সংস্থায় পরিণত হয়। ২০১৪ সালের নভেম্বরের শুরুর দিকে আইসিআইজের লুক্সেমবার্গ লিকস তদন্তে জানা যায় যে, প্রধানমন্ত্রী জিন-ক্লড জাঙ্কারের অধীনে লুক্সেমবার্গ কর্পোরেট কর পরিহারের একটি প্রধান ইউরোপীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইসিআইজে ওয়েবসাইট সুইস লিকস শিরোনামে সুইজারল্যান্ডে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করে।

আইসিআইজে এখন তিনটি কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়- একটি গতানুগতিক পরিচালনা পর্ষদ, সমর্থকদের নিয়ে গঠিত একটি উপদেষ্টা কমিটি এবং আইসিআইজে নেটওয়ার্ক কমিটি। আইসিআইজে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে মার্কিন কর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অলাভজনক মর্যাদা লাভ করে। ২০১৭ সালে, আইসিআইজে, ম্যাকক্লাচি কোম্পানি এবং মিয়ামি হেরাল্ড পানামা পেপারসের ব্যাখ্যামূলক প্রতিবেদনের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করে। আইসিআইজে পানামা পেপারসের জন্য মোট ২০টিরও বেশি পুরস্কার জিতেছে।

আইসিআইজের সংবাদ সংস্থাগুলো ডকুমেন্ট ফাঁসকে তাদের আর্থিক গোপনীয়তার সবচেয়ে বিস্তৃত এক্সপোজ হিসেবে বর্ণনা করেছে যার মধ্যে পানামা, সুইজারল্যান্ড এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ১৪টি আর্থিক পরিষেবা সংস্থার নথি, ছবি, ই-মেইল এবং স্প্রেডশিট রয়েছে যা ২০১৬ সালে পানামা পেপারসের আগের রিলিজকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। পানামা পেপারসের গোপন নথি ছিল ১১ দশমিক ৫ মিলিয়ন। কাগজপত্র প্রকাশের সময় আইসিআইজে বলেছিল যে, তারা নথির জন্য তার উৎস চিহ্নিত করছে না।

রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, আজারবাইজান, জর্ডান, চেক, কেনিয়া, ভারত, পাকিস্তান, কাতার, প্যারাগুয়ে, পেরু, কলম্বিয়া, লেবানন, ইতালি, স্পেন, ব্রাজিল, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, নেদারল্যান্ডস, ইসরায়েল, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, জেরুজালেমসহ বিশ্বের ৯০টি দেশের রাজনীতিবিদ, ধনকুবের, ব্যবসায়ী, অভিনেতা, খেলোয়াড় ও জনপ্রিয় তারকাদের আর্থিক ৬৪ লাখ নথি, ৩০ লাখ ছবি, ১০ লাখের বেশি ই-মেইল এবং প্রায় পাঁচ লাখ হিসাবের স্প্রেডশিট উন্মোচিত হয়েছে। এতে বিশ্বব্যপী আলোচনা ও সমালোচনা উঠেছে।

জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ, চেক প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেই বাবিস, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা, চিলির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরা, কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল-থানি, প্যারাগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোরাসিও কার্টেস, কলম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট সিজার গাভিরিয়া, পেরুর সাবেক প্রেসিডেন্ট পেদ্রো পাবলো কুকজিনস্কি, পানামার সাবেক প্রেসিডেন্ট রিকার্ডো মার্টিনেলি, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী ও দুবাইয়ের আমির শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম, লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি, ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি, হংকংয়ের সাবেক প্রধান নির্বাহী তুং চি-ওয়া, আর্জেন্টিনার সাবেক ফার্স্ট লেডি ও সাবেক প্রেসিডেন্ট কার্লোস মেনেমের মেয়ে জুলেমা মারিয়া ইভা মেনেম, ইসরায়েলের সাবেক ভাইস প্রধানমন্ত্রী ও নেসেটের সাবেক সদস্য হাইম রামন, শ্রীলঙ্কার পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনবিষয়ক সাবেক উপমন্ত্রী নিরুপমা রাজাপাকসে, ভারতীয় ক্রিকেট কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার, স্ত্রী অঞ্জলি টেন্ডুলকার ও শ্বশুর আনন্দ মেহতাসহ এমন আরো অনেকের গোপন সম্পদের তথ্য এতে প্রকাশ পেয়েছে।

মোট ৩৫ জন বর্তমান এবং সাবেক জাতীয় নেতা প্রায় ১০০টি দেশের ৪০০ জন কর্মকর্তা এবং ১০০-এরও বেশি ধনকুবেরের নাম ফাঁস করা নথিতে উপস্থাপিত হয়েছে। জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ কাগজপত্রে উল্লেখ করা অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। নথিতে দেখা যাচ্ছে যে, তিনি যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছেন যার মধ্যে আছে ক্লিফসাইড ড্রাইভ, মালিবু, ওয়াশিংটন ডিসি, লন্ডন এবং যুক্তরাজ্যের অ্যাসকটে বাড়ি। চেরি ব্লেয়ার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি ইউকে কোম্পানি ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের রোমানস্টোন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি কিনে ৬ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন পাউন্ড অর্জন করেছে। যদি সম্পত্তি সরাসরি অধিগ্রহণ করা হতো তাহলে ৩১ হাজার ২০০ পাউন্ড স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হতো। সংশ্লিষ্ট বন্ধকীর জন্য যৌথ আয়ের বিবৃতিতে টনি ব্লেয়ারের নাম প্রদর্শিত হয়েছে।

কাগজপত্রে আরো জানা যায়, কীভাবে আজারবাইজানের শাসক আলিয়েভ পরিবারের মালিকানাধীন একটি অফিস ব্লক ক্রাউন এস্টেটের কাছে ২০১৮ সালে ৬৬ মিলিয়ন পাউন্ডে বিক্রি হয়েছিল। এতে করে আলিয়েভ পরিবার ৩১ মিলিয়ন পাউন্ড মুনাফা লাভ করে। এ ছাড়া ৩৩ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের আরেকটি অফিস ব্লক ২০০৯ সালে আলিয়েভ পরিবারের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল এবং আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভের ছেলে হায়দার আলিয়েভকে উপহার দেওয়া হয়েছিল। লাস ভেগাস সানের মতে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কাছের সদস্যদের বিরুদ্ধে গোপন কোম্পানি বা ট্রাস্টে লাখ লাখ ডলারের সম্পদ লুকিয়ে রাখার অভিযোগ রয়েছে।

ভøাদিমির পুতিনের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীর মোনাকোতে গোপন সম্পদ আছে বলে জানা গেছে। চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ বাবিচ, যিনি দুর্নীতি ও কর ফাঁকি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছিলেন, তিনি ফরাসি রিভিয়ার মৌগিন্সে দুটি ভিলাসহ আটটি সম্পত্তি ১২ মিলিয়ন পাউন্ডে কেনার ক্ষেত্রে অফশোর বিনিয়োগ কোম্পানির ব্যবহারের কথা স্বীকার করেননি। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াতাকেও এ পেপারসে উল্লেখ করা হয়েছে, যিনি ২০১৮ সালে ঘোষণা করেছিলেন ‘প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীর সম্পদ প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে হবে।’ কেনিয়াতা এবং তার পরিবারের ছয়জন সদস্য ১৩টি অফশোর কোম্পানির সাথে যুক্ত। ফাঁস হওয়া তালিকায় আন্তর্জাতিক মাদকপাচারের জন্য পরিচিত রাফায়েল আমাতো, আমাতো-প্যাগানো গোত্রের প্রধান এবং আন্তর্জাতিক অপরাধী সংগঠনের নেতারাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আমাতো যুক্তরাজ্যে একটি শেল কোম্পানি ব্যবহার করে স্পেনে জমি এবং রিয়েল এস্টেট কিনত।

উল্লিখিত অন্যান্য বৈশ্বিক নামগুলোর মধ্যে রয়েছে শাকিরা, যিনি কর ফাঁকির জন্য বিচার চলাকালীন নতুন অফশোর কোম্পানি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন; মডেল ক্লদিয়া শিফার; ভারতীয় কোটিপতি অনিল আম্বানি, পলাতক ভারতীয় ব্যবসায়ী নীরব মোদির বোন পূর্বী; ডার্ক ওয়েবসাইট আলফাবের প্রতিষ্ঠাতা আলেকজান্দ্রে কেজেস যিনি অবৈধ ওষুধের কারবার করতেন; পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী শওকত ফায়াজ আহমেদ তারিন, পাকিস্তানের শীর্ষ জেনারেলদের পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য এবং চ্যানেল ওয়ান রাশিয়ার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কনস্ট্যান্টিন আর্নস্ট। মিগুয়েল বোস এবং জুলিও ইগলেসিয়াসের নামও রয়েছে। ফাঁস হওয়া ফাইলগুলো ১৪টি অফশোর বিনিয়োগ কোম্পানির কাছ থেকে আসে যা ক্লায়েন্টদের গোপনীয়তার এখতিয়ারে কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।

আইসিআইজে রিপোর্ট আলেমান, কর্ডারো, গ্যালিন্ডো অ্যান্ড লি বা অ্যালকোগাল নামক পানামানিয়ান ল ফার্মের ওপর অনুসন্ধান করে বলেছে যে, এটি লাটিন আমেরিকান অভিজাতদের আইন সংস্থা যা ট্যাক্স হেভেনগুলোতে কমপক্ষে ১৪ হাজার শেল কোম্পানি এবং ট্রাস্ট তৈরি করেছে। ফাঁস হওয়া নথিতে আলকোগালকে অন্য কোনো অফশোর সরবরাহকারীর চেয়ে বেশি উল্লেখ করা হয়েছিল। কাগজপত্র উন্মোচনের জন্য, আইসিআইজে ৯১টি মিডিয়া আউটলেটের সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজ করেছে যাদের অন্যতম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, ল’ এপ্রেসো, লে মন্ডে, এল পায়েস, সোডডুচে জেইটুং, পিবিএস প্রোগ্রাম ফ্রন্টলাইন, অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন, দ্য গার্ডিয়ান এবং বিবিসি প্যানোরামা।

লেখক : সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল

ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close