মু. মেহেদী হাসান

  ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১

মুক্তমত

সুশাসনের জন্য প্রয়োজন জবাবদিহি

রাষ্ট্রগঠনের জন্য চারটি উপাদান প্রয়োজন, তা হলো- নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনগণ, সার্বভৌমত্ব ও সরকার। এই চারটির একটি অনুপস্থিত হলে রাষ্ট্রগঠন করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের এই চারটি অপরিহার্য উপাদান। একটি রাষ্ট্রগঠন করলেই তাতে সুশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয় না। একটি রাষ্ট্রে সুশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে সে রাষ্ট্রের সরকার এবং তাকে সাহায্য করবে সে রাষ্ট্রের বসবাসরত জনগণ। একটি রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে একটি সুশৃঙ্খল সরকার অপরিহার্য। রাষ্ট্রের সুশাসন নির্ভর করে সে রাষ্ট্রের সরকারের দক্ষতার ওপর। কোনো রাষ্ট্রের সরকার যদি অদক্ষ হয় তাহলে সে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। সুশাসন বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো, রাষ্ট্রের সঙ্গে সুশীল সমাজের, সরকারের সঙ্গে শাসিত জনগণের, শাসকের সঙ্গে শাসিতের সম্পর্ককে।

জনগণের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হলে সুশাসনের অভাব দেখা দেবে। দেখা দেবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। একটি রাষ্ট্রের সরকারের কাজ হলো জনগণের কল্যাণে নিজেকে নিয়জিত রাখা। আধুনিক রাষ্ট্রগুলো এখন পুলিশি রাষ্ট্র নেই। এখন তা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি নাগরিকের অধিকার রয়েছে। একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের ইচ্ছার ভিত্তিতেই সরকার নির্বাচিত হয়। তাই একটি রাষ্ট্রের সরকারের প্রথম কাজ রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার আদায় করা। মানুষের মৌলিক কিছু চাহিদা রয়েছে, তাহলো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। প্রতেকটি রাষ্ট্রের সরকারের প্রথম এবং প্রধান কাজ নাগরিকদের এই মৌলিক চাহিদা পূরণ করা।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর যেমন কিছু সুবিধা আছে, ঠিক তেমনি অসুবিধাও রয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বল্পসময়ে ক্ষমতার রদবদল হয়। স্বল্পসময়ে ক্ষমতার রদবদলের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সক্ষম হয় না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমস্যাগুলোর মধ্যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও একটি প্রধান সমস্যা। জবাবদিহির অভাবও লক্ষণীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শক্তিশালীবিরোধী দল একান্ত প্রয়োজন। অন্যথায় ক্ষমতাসীন দল স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে আবির্ভাব হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলকে ছায়া সরকার বলা হয়ে থাকে।

আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বসবাস করি। ক্রমান্বয়ে আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। আমাদের অর্জন আমাদের ভাবমূর্তি ইতিবাচক হিসেবে বিশ্বের দরবারে জায়গা করে নিচ্ছে। বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেও আমাদের কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে, যেগুলোর জন্য আমাদের ভাবমূর্তি প্রতিনিয়ত ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আমাদের জাতীয় জীবনে প্রধান সমস্যাগুলোর একটি হলো দুর্নীতি। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি চালু করলেও বছর শেষে ঘুরেফিরে সে আগের স্থানেই চলে আসে দুর্নীতি। কিছুতেই যেন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না দুর্নীতিকে। সরকারের সৎ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না।

দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার জন্য প্রশাসনের প্রত্যেক স্তরের জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে যে দুর্নীতির চিত্র আমরা দেখতে পাই মূলত তা জবাবদিহির অভাবের জন্য। টেকসই উন্নয়নের জন্য জবাবদিহি আবশ্যক। অন্যথায় এই উন্নয়ন ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সুশাসন আবশ্যক এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দল সরকার গঠনের চেষ্টা করে এবং ক্ষমতাসীনদের ভুলত্রুটি জনগণের সামনে তুলে ধরে এবং জনগণের মন অর্জন করার চেষ্টা চালাতে থাকে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল তাদের ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা নেয় এবং সামনের দিকে এগোতে থাকে।

উন্নতবিশ্ব এবং তৃতীয় বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর চিত্র ভিন্ন। তৃতীয় বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে বিরোধী দল তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। ক্ষমতাসীন দল সব কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে এবং বিরোধী দল কোণঠাসা হয়ে পড়ে। আর এজন্য তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতে জবাবদিহির অভাব লক্ষণীয়ভাবে দেখা যায়। ক্রমান্বয়ে দুর্নীতি মহামারি আকারে ধারণ করছে। আমাদের মূল্যবোধ নৈতিকতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে দুর্নীতি। করোনাভাইরাসে বিশ্ব যখন স্তব্ধ। মানুষ যখন বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলছে। মৃত্যুর মিছিল যখন চলছে বিশ্বে, ঠিক তখনো একটি চক্র তাদের স্বার্থের সন্ধানে রয়েছে। তাদের কাছে মানুষের মৃত্যুর আহাজারি যেন পৌঁছায় না।

আমাদের দেশ এর ব্যতিক্রম নয়। মহামারি করোনাভাইরাস দুর্নীতিবাজদের জন্য যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। সবার অর্থনৈতিক অবস্থা যখন নিম্নমুখী, ঠিক তখনো তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ঊর্ধ্বমুখী। গরিবের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার যেন এক নতুন কৌশল এই করোনাভাইরাস। সরকারি হাসপাতাল থেকে বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতেও যেন একই চিত্র। মানুষের দৈনন্দিন কার্যক্রম থেকে শুরু করে সবকিছুর পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন হয়নি দুর্নীতির। সমন্বয় হীনতার অভাব ও জবাবদিহির অভাব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে করোনাকালীন মহামারির। মহামারি এখনো সম্পূর্নভাবে বিদায় না নিলেও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। করোনাকালীন প্রশাসনিক কার্যক্রম স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। ধীরে ধীরে তাও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। সমন্বয়হীনতা এখন দূর করা না গেলে তা আরো ভয়াবহ রূপ নেবে। সরকারের ভালো পদক্ষেপগুলো মলিন করে দেয় কিছু দুষ্কৃতিকারী। বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করে। দুর্নীতিকে রুখে দেওয়ার জন্য প্রশাসনিক সর্বস্তরে জাবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সমন্বয়হীনতা দূর করতে হবে। দুর্নীতিকারিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

এ ছাড়া দেশের জনগণকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে হবে। অদক্ষ জনশক্তি একটি রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। রাষ্ট্রের নাগরিকদের মূল্যবোধ জাগ্রত করা এবং জনগণকে জনসম্পদে রূপান্তর করা ক্ষমতাসীনদের অন্যতম কাজ। রাষ্ট্রের নাগরিকদের জনসম্পদে রূপান্তর করা না গেলে এবং মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত করতে না পারলে বিশৃঙ্খলা এড়ানো সম্ভব নয়। একমাত্র মূল্যবোধ জাগ্রত করা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমেই সমাজ ও দেশ থেকে হত্যা, গুম, খুন, দুর্নীতি রাহাজানি হ্রাস করা সম্ভব।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close