জাফরুল ইসলাম

  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১

পর্যবেক্ষণ

আফগানিস্তানের অর্থনীতি ও বাস্তবতা

পাহাড়ে ঘেরা এক দেশ, যে দেশ প্রাচীনকাল থেকেই প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। এই লোভনীয় প্রাকৃতিক সম্পদের কারণেই বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর এক আকর্ষণের নাম আফগানিস্তান। তাই তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিপতি দেশগুলোর মধ্যে যখন স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল আফগানিস্তানে। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতা গ্রহণ এবং ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তানে ক্ষমতা ছেড়ে পলায়ন যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। এরপর আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় উত্থান ঘটে তালেবানদের। তারা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে। তাদের ক্ষমতা স্থায়ী হয় ২০০১ সাল পর্যন্ত।

এ সময় যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হয়। আর হামলাকারী হিসেবে আল-কায়েদাকে দায়ী করা হয়, যাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তালেবানদের। সে সূত্র ধরেই ২০০১ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তানে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে। এরই মধ্যে অতীত হয়ে গেল প্রায় ২০ বছর। এই বিশ বছরে তালেবান এবং ন্যাটো বাহিনী কী অর্জন করল বা কী হারালো সেটা নিয়ে আজকের আলোচনা নয়। আজকের আলোচনা ১৫ আগস্ট তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণের পর আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন।

আমরা জানি বিশ্বের নাম্বার ওয়ান অর্থনৈতিক দেশ যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষমতার কারণেই বিশ্ব মোড়ল হিসেবে পরিচিত। এখন এই বৃহৎ অর্থনৈতিক সম্পন্ন দেশ আফগানিস্তান থেকে তার সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার পাশাপাশি যাবতীয় সাহায্য-সহযোগিতাও বন্ধ ঘোষণা করে। তালেবান নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরপরই একে একে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ আন্তর্জাতিক আফগানিস্তানের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়। তালেবানদের যুগ শুরু হওয়া পর এক মাস ধরে আফগানিস্তানের ব্যাংক বন্ধ করে রাখা হয়।

উনবিংশ শতাব্দীতে যখন কোনো দেশ পরাশক্তিগুলোর বিপরীতে অবস্থান নিত তখন সে দেশটিতে সামরিক হামলা চালাত পরাশক্তি নামধারী দেশ। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসেছে এই নীতির পরিবর্তন। এখন শত্রু দেশকে শায়েস্তা করার জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহার না করে এসেছে অর্থনৈতিক অবরোধ কৌশল। আমরা যার প্রত্যক্ষ ফলাফল দেখেছি ইরানের ক্ষেত্রে। যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর দাম আকাশছোঁয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর যখন দেশের বাজারের অবস্থা এমন হবে তখন সাধারণ জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে রাস্তায় নেমে পড়বে।

গত আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের ডব্লিউএফপি পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৯৩ শতাংশ আফগান নাগরিক যথেষ্ট খাবার পাচ্ছে না। আবার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে রাজধানীর চমন ই হজরি এলাকায় সাধারণ মানুষদের ঘরের জিনিসপত্রের ভিড়। কিন্তু ক্রেতা নেই, রয়েছে বিক্রেতা, যা প্রমাণ করে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক বেহাল দশার। বর্তমানে দেশের মাথাপিছু আয় মাত্র ৫১০ ডলারের কাছাকাছি, এক কথায় সাহায্যনির্ভর অর্থনীতি। আফগানিস্তানের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। কারণ আফগানিস্তান বর্তমানে এমন এক দেশে পরিণত হয়েছে যেখানে কোনো বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করছে না। আফগানিস্তানে যারা সরকারি চাকরি করে তারা গত জুলাই মাস থেকে অবৈতনিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণ করার পরপরই এমন চিত্র ফুটে উঠেছে। কারণ তারা যে সরকার গঠন করেছে তাদের কারো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান নেই। এ ছাড়া ৯৪০ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জব্দ করা হয়েছে। যার ফলে জিনিসপত্রের দাম হু-হু করে বেড়েই চলছে। আফগানিস্তানের মুদ্রার মান কমে গেছে।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ২০১১ সালে তালেবানদের বার্ষিক আয় ছিল ৪০ কোটি ডলার। ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী তাদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বছরে প্রায় ১৫০ কোটি ডলার। তাদের আয়ের উৎস হচ্ছে বৈদেশিক সহায়তা, মাদক ব্যবসা, বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও খনিজসম্পদ। এখন এখানে দেখা দিয়েছে অশনিসংকেতের সম্ভাবনা। কারণ বিশ্ববাজার নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্র। তাই সেখানে কিছু বিক্রি করতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও পরোক্ষভাবে আফগানিস্তানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যার প্রভাব এখন আফগানিস্তানের অর্থনীতি এবং ব্যক্তিজীবনে পড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে আফগানিস্তানে দেড় কোটি মানুষ অনাহারে দিনাতিপাত করছে।

গত সপ্তাহে জাতিসংঘের তরফ থেকে বলা হয়, আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে আফগানিস্তানের ৯৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে, যা উদ্বেগজনক। যদিও চীন আফগানিস্তানের সঙ্গে থাকার কথা ব্যক্ত করেছে। কিন্তু এই চীনকে রুখতে যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া কিছুদিন আগে এক চুক্তি সই করে, যার নাম অকটঝ। এখন যদি চীন নিজেই সমস্যায় পতিত হয় তাহলে আফগানিস্তানে কীভাবে সাহায্য করবে। এমন প্রশ্ন থেকে যায়। অন্যদিকে বর্তমানে আফগানিস্তানে যে অবস্থা তাতে করে একটা আগাম কথা বলাই যায়, আফগানিস্তানের জনগণ তালেবানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। যার ফলে তালেবানদের পতন ঘটবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল সফল হবে। আর সেই কৌশলের পথেই হাঁটছে পরাশক্তিধর দেশটি। এখন দেখার পালা তালেবানদের ভূমিকা এবং তাদের পরিকল্পনা।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close