ফারিহা হোসেন

  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১

দৃষ্টিপাত

করোনায় বাল্যবিয়ে ও ঝরে পড়া প্রসঙ্গে

করোনা অতিমারিতে দেড় বছর ধরে বন্ধ ছিল দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে দেশে শিক্ষার সর্বস্তরে ঝরে পড়েছে বহু শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে মেয়েরা সর্বাধিক বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। একইভাবে সংসারের হাল ধরতে লেখাপড়া ছেড়ে নানা পেশায় যুক্ত হয়েছে ছেলেশিক্ষার্থীদের কেউ কেউ। তবে এই প্রবণতা শহর অপেক্ষা বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। শুধু রাজশাহীতেই ৫ শতাধিক স্কুলছাত্রীর বাল্যবিয়ের খবর প্রকাশিত হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় দেড় শতাধিক ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে শতাধিক শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। কুড়িগ্রামে একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর আট সহপাঠী বান্ধবীর সবার বিয়ে হয়ে গেছে। শ্রীমঙ্গলে পাঁচটি বিদ্যালয়ের প্রায় দুইশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। সিলেটে ঝরে পড়েছে ৩৪-৪০ ভাগ শিক্ষার্থী। এই তথ্য উদ্বেগের।

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫২২ জন। এর মধ্যে করোনাকালীন ছুটিতে ৩৮ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। একই উপজেলার পলাশী ফতেপুর হাইস্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৩৫ জন। এর মধ্যে বিয়ে হয়েছে ১২ জন ছাত্রীর। তানোর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান বলেন, করোনাকালে কত শতাংশ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে, সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ধারণা, অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার ৫০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদরাসায় প্রায় ৩৩ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর কত শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসছে তার কোনো পরিসংখ্যান মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে নেই। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৫ থেকে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে গেছে।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সারডোব উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে নার্গিস নাহার ও তার আট সহপাঠিনী ছিল। কিন্তু নবম শ্রেণিতে আছে শুধু নার্গিস। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে নার্গিসের বাকি আট বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেছে। ময়মনসিংহ শহরের গোলকিবাড়ী সরকারি প্রাইমারি স্কুলে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় দেখা গেছে, ৩০-৪০ জন শিক্ষার্থী। যেখানে স্কুলের মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৯২ জন। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস জানায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি আস্তে আস্তে বাড়ছে। বর্তমানে উপস্থিতি প্রায় ৭৩-৭৬ ভাগ। এ জেলার ধোবাউড়ায় ২১টি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে।

ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির সিলেট বিভাগীয় এক কর্মকর্তা বলেন, ধারণা করছি করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের প্রভাবে ৩৪-৪০ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। সম্প্রতি একটি সংস্থার জরিপেও এ রকম তথ্য পাওয়া গেছে। তারা অনলাইনে ও মোবাইল ফোনে জরিপটি করেছে। পটুয়াখালী শহরের ডোনাভান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বন্ধের ১৭ মাসে ২৫ শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। শ্রীমঙ্গলে ২৮টি উচ্চবিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৫টি বিদ্যালয় পরিদর্শন করে ১৮৭ জন শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার তথ্য পাওয়া গেছে। শহরের উদয়ন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে করোনা-পরবর্তী সময়ে গড় উপস্থিতি ৬১ ভাগ। লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার পাটোয়ারীরহাট মহিলা দাখিল মাদরাসায় দেড় বছরে ৫ম শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শতাধিক ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে।

তথ্য মতে অন্তত ৫ ভাগ শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিতে শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টদের তাগাদা দেওয়া হয়েছে। পড়াশোনার চাপ না থাকায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী অলস সময় কাটিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কিশোর-কিশোরীরা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে অল্পশিক্ষিত অভিভাবকরাও বাল্যবিয়ে দিয়েছেন। বাঘা উপজেলার পদ্মারচরে চকরাজাপুর ইউনিয়নের চকরাজাপুর ও পলাশী ফতেপুর উচ্চবিদ্যালয়ের অর্ধশত ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। পরিবারের সম্মতি না থাকলেও শিক্ষার্থীদের একটি অংশ নিজেরাই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। চকরাজাপুর উচ্চবিদ্যালয়ের ৫২২ জনের মধ্যে ৩৮ ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। অন্যদিকে পলাশী ফতেপুর হাইস্কুলে ২৩৫ জনের মধ্যে বিয়ে হয়েছে ১২ ছাত্রীর।

চকরাজাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জানান, এমনিতে পদ্মারচরের মানুষ দরিদ্র। ছেলেমেয়েরা একটু বড় হলেই অভিভাবকরা সন্তানদের বোঝা মনে করেন। বিশেষ করে মেয়েদের। তাই বাল্যবিয়ের প্রবণতা চরাঞ্চলে অনেক বেশি। চারঘাট এ উপজেলার নিমপাড়া ইউনিয়নের কালুহাটি গ্রামেই বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে ৬টি। এর মধ্যে কালুহাটি উচ্চবিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থীসহ ৫ জন এবং নন্দনগাছী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের এক ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। কালুহাটি উচ্চবিদ্যালয়ে গত দেড় বছরে গোপনে অনেক শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। তানোর উপজেলায় করোনা মহামারিতে এ উপজেলায় সপ্তম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অনেক ছাত্রীর বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে তানোর পৌরসভা উচ্চবিদ্যালয়, চুনিয়াপাড়া একতার আলী উচ্চবিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে।

বেসরকারি সংস্থা প্ল্যান বাংলাদেশের তথ্যানুযায়ী-২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত কুড়িগ্রামে বিয়ে হয়েছে ২২ হাজার ৩৯১টি। এরই মধ্যে নিবন্ধিত বিয়ে ১৯ হাজার ২২১টি এবং অনিবন্ধিত বিয়ে ৩ হাজার ১৭০টি। জেলার ৯ উপজেলায় বাল্যবিয়ে সংগঠিত হয়েছে ৩ হাজার ১৯টি। এরই মধ্যে কুড়িগ্রাম সদর-৭৩০টি, রাজারহাট-৭৪টি, উলিপুর-২৬১টি, চিলমারী-১৪৬টি, রৌমারী-৮৮টি, রাজিবপুর-৫০টি, নাগেশ্বরী-১১৪০টি, ফুলবাড়ী-২৯১টি, ভূরুঙ্গামারীতে-২৩৯টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। এ ছাড়া বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ হয়েছে এক হাজার ১৩৬টি। লক্ষ্মীপুরের রামগতির এক মাদরাসাতেই শতাধিক ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে মর্মে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এদের একটি বড় অংশ বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। কমলনগরের পাটোয়ারীরহাট মহিলা দাখিল মাদরাসার শতাধিক ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। এসব কারণে লক্ষ্মীপুরের উপকূলে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনার কারণে টানা ১৭ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এখানকার নিম্ন আয়ের ও দরিদ্র অভিভাবকরা তাদের ছেলেকে নদীতে মাছ ধরা, দিনমজুর, ইটভাটায় ও দোকান কর্মচারী, হোটেল রেস্তোরাঁয় ও মিস্ত্রি কাজে দিয়েছেন। কেউ কেউ বিদেশেও পাঠিয়েছেন। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সারডোব উচ্চবিদ্যালয়ে। ৯ম শ্রেণিতে তারা ৯ বান্ধবী একসঙ্গে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু করোনা মহামারিতে দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকায় তার ৮ বান্ধবীরই বিয়ে হয়ে গেছে। বান্ধবী ছাড়া তিনি একা ক্লাস করছেন। তিনি ক্লাসের একমাত্র ছাত্রী। ধরলা নদীর বিচ্ছিন্ন চর সারডোব উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। এ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির চিত্রও একই। জেসমিন আক্তার ছাড়া বাকি ৩ ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফজলে রহমান বলেন, আমার বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ২২৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৩ জন ছাত্রী। প্রাথমিক তথ্য মতে, বিয়ে হয়েছে ১৮ জন ছাত্রীর। এর মধ্যে বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির চারজন ছাত্রীর মধ্যে জেসমিন ছাড়া বাকি তিনজনেরই বাল্যবিয়ে হয়ে গেছে। ৯ম শ্রেণিতে ৯ জনের মধ্যে নার্গিস ছাড়া ৮ জনের বিয়ে হয়েছে। এ ছাড়া ষষ্ঠ শ্রেণির একজন, সপ্তম শ্রেণির দুজন, অষ্টম শ্রেণির চারজনের বিয়ে হয়েছে।

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং নারী-শিশু, বায়োকেমেস্ট্রি ও পরিবেশ বিষয়ে অধ্যয়নরত

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close