রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১

নিবন্ধ

মানবিক গুণাবলিকে বিকশিত করে নৈতিকতা

মানুষের সহজাত ও মৌলিক প্রবৃত্তি ও মনোবলই হলো নিয়ম। নিয়ম মেনে চলা বা রক্ষা করা থেকেই নীতি, মূলনীতি বা প্রণালি। অর্থাৎ নিয়মের মূলতত্ত্ব ও উপাদানই হলো নীতি। নীতির প্রতি মূল্যায়ন, সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন থেকেই আসে নীতিবোধ ও আদর্শিক গুণাবলি। আর এই নীতিবোধ থেকেই নৈতিকতা। অর্থাৎ নিয়ম থেকে নীতি, আর নীতি থেকে নৈতিকতা। নৈতিকতা হলো নীতিবোধ ও গুণাবলির দর্শন অর্থাৎ জীবন দর্শন। জীবনকে সুপথে সুকাজে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বৈশল্যকরণী। নীতিনৈতিকতা মূলত একটি প্রশিক্ষণ। এটা শেখার জন্য ব্যবস্থা অনুশীলন ও চর্চার প্রয়োজন জরুরি। মানুষের জীবনের সততা, মহানুভবতা, উদারতা, ন্যায়-পরায়ণতা, সভ্যতা, সাধুতা, অখ-তা, একত্রতা, পূর্ণতা সর্বোপরি স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, চরিত্র, মহত্ত ও আদর্শিক গুণাবলির সংমিশ্রিত আত্মশুদ্ধির স্বর্ণফসল হলো নৈতিকতা। জীবন চেতনার প্রথম সূর্যসিঁড়ি হলো নৈতিকতা। নৈতিকতা মানুষের জীবনের স্বচ্ছতার দিগন্তবিস্তারি প্লাবন ডেকে এনে দেয়। তাই মানুষের বিবেক ও মূল্যবোধের জাগরণকেই নৈতিকতা বলা হয়।

নৈতিকতা আত্মার অস্তিত্বের ও আত্মোপলব্ধির ক্ষেত্রে নিবেদিত ও উৎসর্গীকৃত। দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও প্রধান অবলম্বন হলো নৈতিকতা অর্জন। নৈতিকতা অর্জন ব্যতিরেকে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও নির্মল করা কখনো সম্ভব নয়। নৈতিকতা সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্মমতার আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য এক সাহসী প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। নৈতিকতা হলো আত্মশুদ্ধি, আত্মার মুক্তি ও শান্তির বাতিঘর। মানবিক গুণাবলি বিকশিত হওয়ার একমাত্র পথ নৈতিকতা। মানুষের ক্যারিয়ার গড়ার মাধ্যম হলো নৈতিকতা। জাতির সর্বক্ষেত্রে অবক্ষয় রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই নৈতিকতা। করোনা শুধু শিক্ষার্থীদের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে না, সামগ্রিকভাবে মানুষের মূল্যবোধেও প্রভাব ফেলেছে।

গত বছর করোনাকালে অসহায় ও কর্মহীন মানুষের পাশে সামর্থ্যবান ও বোধসম্পন্ন মানুষ যেভাবে দাঁড়িয়েছিল, এক বছরের ব্যবধানে তা যেন উধাও হয়ে গেছে। এ বছর লকডাউনে সেসব মানুষকে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। এর কারণ কী? বিগত এক বছরে সামর্থ্যবানদের অনেকে সামর্থ্য হারিয়েছেন। তারা এখন আর অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছেন না। আগামীতে অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে পারেন, এ শঙ্কায় তারা কৃচ্ছতা অবলম্বন করছেন। কিংবা অর্থ জমিয়ে রাখছেন। ফলে এবার অসহায় মানুষের সাহায্যার্থে কেউ তেমন এগিয়ে আসেননি। তারা মানবিকতাকে বাক্সবন্দি করে ফেলেছেন। অথচ আমাদের দেশের মানুষের চিরায়ত বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, মায়া-মমতা এবং একের অপরের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা। পরিচিত হোক, অপরিচিত হোক, একের দুঃখে দুঃখিত হওয়া, সহমর্মিতা প্রকাশ করা, পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনা দেওয়া। নিজে যত কষ্টেই থাকুক না কেন, তার মানবিক মূল্যবোধটি খুবই টনটনে থাকে।

গাঁয়ের পথ ধরে কোনো তৃষ্ণার্ত পথিক কোনো বাড়িতে গিয়ে এক গ্লাস পানি চাইলে, দেখা যেত, শুধু পানি নয়, সঙ্গে একবাটি মুড়ি-মিঠাই নিয়ে বাড়ির কর্তা হাজির হতেন। নিজে বসে আপ্যায়ন করতেন। চেনা নেই জানা নেই, এমন ব্যক্তিকে অতিথি ভেবে পরম মমতায় হাত বাড়িয়ে দিতেন। এখন এমন দৃশ্য খুব কম দেখা যায়। গত বছর করোনায় আমাদের চিরায়ত মূল্যবোধের এই দৃশ্য দেখা গেছে। এমন দৃশ্য দেখে অভিভূত না হয়ে পারা যায়নি। এ বছর সেটা দেখা যাচ্ছে না। তার মানে কি আমাদের মূল্যবোধে ধস নেমেছে? নাকি অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কায় মূল্যবোধকে চাপা দেওয়া হয়েছে? এ কথাই বা বলি কী করে? অর্থের টানাপড়েনের মধ্যে আমাদের দেশের মানুষ যুগযুগ ধরেই ছিল, সে সময়ও তারা মানবিক মূল্যবোধ হারায়নি। অভাবের মধ্যেও তার নীতিনৈতিকতা অটুট ছিল। বলাবাহুল্য, জীবনে অর্থের প্রয়োজনীয়তা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।

তবে অর্থ রোজগার করতে গিয়ে নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিসর্জন দেওয়া আমাদের দেশের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়। আমাদের নীতিনৈতিকতার অবক্ষয়ের প্রভাব এখন সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠেছে। এর প্রতিক্রিয়া পড়ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর। এই যে শহর ও গ্রামে, পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে, এর মূল কারণই হচ্ছে, অভিভাবক শ্রেণির উদাসীনতা ও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তা না হলে, একটি বাড়ন্ত কিশোর যার পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, তার মধ্যে কেন খুন, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধপ্রবণতা দেখা দেবে? এর জন্য ওই কিশোর যতটা না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী আমাদের পরিবার ও সমাজের অভিভাবক শ্রেণি। চোখের সামনে এক দল কিশোর ভয়ংকর অপরাধী হয়ে উঠছে অথচ তা নিবৃতকরণে কোনো ধরনের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বরং কেউ কেউ এসব উঠতি বয়সি কিশোরদের অপরাধপ্রবণতাকে কাজে লাগাতে উঠেপড়ে লাগছে।

এই যে অসংখ্য কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে, তা এমনি এমনি গড়ে ওঠেনি। তাদের পেছনে সমাজেরই প্রভাবশালীদের প্রশ্রয় রয়েছে। তারা কিশোরদের বিবেচনাহীন উড়ন্ত-দুরন্ত প্রবণতাকে উসকে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। এই প্রশ্রয়দাতারা যদি কিশোরদের প্রশ্রয় না দিত তাহলে পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার কোনো কারণ থাকতে পারে না। যদি প্রধান নৈতিক গুণটি বিচার করি, সেটি হলো সত্য বলা। আমরা কতটা সত্য কথা বলছি। সব অন্যায়ের মূলে আছে মিথ্যা। যারা ক্ষমতায় আছেন তারা যেমন সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নেই। যারা ক্ষমতার বাইরে তাদেরও একই অবস্থা। সত্য কথা বলার লোকের খুবই অভাব। একনিষ্ঠ সত্যবাদী মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, যারা সমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা নেতৃত্বের যে পর্যায়েই থাকুন না কেন আমরা অনুরোধ করব তারা যেন সত্যবাদী হওয়ার চেষ্টা করেন। মিথ্যা পরিহার করেন। মিথ্যা পরিহার করে সত্যের ওপর অটল থাকতে পারলে আমরা অনেক বেশি সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারব।

গণমাধ্যমে অনেক দুর্নীতির খবর বের হয়। এর প্রধান কারণ সত্য কথা না বলা। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে, কারণ আমরা সবাই আমাদের কৃতকর্ম লুকানোর চেষ্টা করি। আমরা সত্য প্রকাশ করতে ভয় পাই। সত্য প্রকাশ না করা ও মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ আমাদের বহু সমস্যা সৃষ্টির পেছনে অন্যতম কারণ। আমরা জাতি হিসেবে এগিয়ে যেত চাইলে, সমাজকে পরিবর্তন করতে চাইলে, একটি সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশকে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অনেকগুলো উপাদান রয়েছে। আমরা একই ভাষাভাষী, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম এক, মাজহাবও একই- আমাদের ঐক্যের এত জায়গা থাকার পরও আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে না পারা বিস্ময়কর। মনে হয় এর প্রধান কারণ আমরা সত্যনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছি না। আমরা সত্য কথা বলাকে গৌরবের মনে করি না। বরং অবলীলায় মিথ্যা কথা বলছি। মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছি। অন্যের সমালোচনা করছি। অন্যের দোষ খুঁজছি।

দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। অথচ একজন মুসলিম হিসেবে, বিশ্বসী হিসেবে- তারা মনে করেন আল্লাহ তার ভালো কাজের পুরস্কার দেবেন, মন্দ কাজের শাস্তি দেবেন। যারা মুসলমান নন, তারাও স্র্রষ্টায় বিশ্বাস করেন। পৃথিবীর সব ধর্মেই মিথ্যাকে নিন্দনীয় বলা হয়েছে। মুসলিম হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, ইহজগতের পর আমাদের জন্য একটি পরজগৎ রয়েছে। সেখানে আমাদের কৃতকর্মের বিচার হবে। যার ভিত্তিতে পুরস্কার ও শাস্তি দেওয়া হবে। এই বিশ্বাস আমাদের মনে গভীরভাবে প্রোথিত থাকলে মিথ্য বলতে পারি না। মিথ্যা হচ্ছে সব অন্যায়ের মূল। মিথ্যার ঘেরাটোপ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। মিথ্যাকে পরিত্যাগ করতে হবে। সত্যকে আঁকড়ে ধরতে হবে। সত্য কথা যদি আমার বিরুদ্ধে, আমার দলের বিরুদ্ধে, আমার পরিবারের বিরুদ্ধে যায় তার পরও সত্যকে মেনে নিতে হবে। প্রকাশ করতে হবে।

আমাদের সত্যপন্থি হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এটা যদি আমরা করতে পারি তাহলে জাতি হিসেবে আমরা নিজেদের একটি বড় নৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে পারব। তাহলে চার পাশে যে অত্যাচার, অনাচার, দুর্নীতি দেখছি তা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। মিথ্যার ওপরে এসব অনাচার প্রতিষ্ঠিত। এজন্য আমাদের জাতীয় নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের মানুষ অনুসরণ করেন। নবীন প্রজন্ম তাদের দেখে শিখবে। নবীনরা ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দেবে। তাদের সামনে উদাহরণ হতে হবে বর্তমান নেতৃত্বকে। সমাজের সর্বস্তরের সব মানুষ, যারা ক্ষমতায় আছেন, যারা ক্ষমতার বাইরে আছেন, যারা সমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সবাইকে বলব যতটা সম্ভব মিথ্যার মূলোৎপাটন করুন। আমাদের একটি ভুল ধারণা আছে যে, রাজনীতি করতে গেলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা দোষের কিছু নয়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে- মিথ্যা, মিথ্যাই। রাজনীতিক হোক বা সমাজ নেতা, অথবা শিক্ষক- তিনি যে অবস্থান থেকেই মিথ্যা কথা বলুন না কেন সেটি ঠিক নয়।

তাই আমরা সত্যকে ধারণ করার চেষ্টা করি, সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করি। মিথ্যা পরিহার করি। মিথ্যা পরিহার করা হলে দুর্নীতি প্রতিহত হবে। দুর্নীতি না থাকলে দেশ সমৃদ্ধিশালী হবে। এজন্য আমাদের আত্মসমালোচনা করতে হবে। আত্মসমালোচনা মানে আত্মশাসন। তাই আমরা মনে করি, কেউ যদি সত্য কথা বলার মতো মৌলিক গুণটি অর্জন করতে পারে তাহলে অন্য গুণগুলো অর্জন করা তার জন্য সহজ হয়ে যাবে। তখন বিশ্বের মানচিত্রে সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নামটি জ্বলজ্বল করবে। কিন্তু বর্তমান যুগে নীতি ও নৈতিকতার সংকট দেখা দিয়েছে। দিনে দিনে পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পূর্বাপর আমাদের দেশের বর্তমান সময় তুলনা করলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে।

নৈতিকতার উন্নয়নের বিচারে আজ সবার মনে প্রশ্ন- আসলে আমরা কোনদিকে যাচ্ছি? পার্থিব ও বস্তুগত উন্নয়নের বিচারে বাংলাদেশ অনেক উন্নত হয়েছে, এটা স্বীকার করতেই হয়। অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রশংসা করার মতো। যোগাযোগব্যবস্থা অনেক ভালো হয়েছে। এখন দেশের যেকোনো প্রান্তে গাড়ি দিয়ে যাওয়া সম্ভব। পদ্মা সেতু চালু হলে সারা দেশ একটি সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের আওতায় চলে আসবে। বর্তমান সরকারের বিগত ১২ বছরের আমলে যেসব মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে; সেগুলো দেশের বস্তুগত উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- আমরা কি নৈতিক মান উন্নত করতে পারছি? চার পাশে নৈতিকতার অব্যাহত অধঃপতন দেখছি। কোনোভাবেই যেন আমরা কাক্সিক্ষত জায়গায় পৌঁছাতে পারছি না। তাই সর্বক্ষেত্রে সবাইকে নৈতিকতার চর্চার বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ সত্য, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও নৈতিকতার আকাল চলছে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close