লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান

  ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

দৃষ্টিপাত

কিশোর শিক্ষার্থীর কোভিড ভ্যাকসিন

বৈশ্বিক অতিমারি কোভিড-১৯ বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার প্রথম থেকেই সতর্ক ছিল বাংলাদেশ। দেশের অর্থনীতি, জনসংখ্যা ও সম্পদের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণে কোয়ারেন্টাইন, শনাক্তকরণ, আইসোলেশন, কন্ট্রাক্ট ট্র্যাসিং, লকডাউন থেকে শুরু করে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সব কার্যক্রম গ্রহণ করে বাংলাদেশ।

করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে জনগণকে সচেতন ও উদ্ধুদ্ধকরণ, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানো, দেশের মানুষের জীবনযাত্রাকে সচল রাখা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মতো চ্যালেঞ্জিং কার্যক্রমগুলো সফলভাবে চলছে। কোভিড-১৯ প্রতিষেধক ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পরপরই সম্ভাব্য সব উৎস থেকে দেশের মানুষের জন্য ভ্যাকসিন সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই মধ্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত ফাইজার, মডার্না, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও সিনোফার্মের চারটি ভ্যাকসিন প্রয়োগ চলছে।

এ পর্যন্ত পৌনে ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। শতকরা হারে এর পরিমাণ ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২২ সালের মধ্যে জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্বের দুই শতাধিক দেশের মতো কোভিড-১৯ প্রতিরোধে প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন ধাপে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনার প্রক্রিয়াও চলছে। যেসব শিক্ষার্থীর বয়স ১৮ বছর বা তদূর্ধ্বে তাদের বিষয়ে অনুমোদনবিষয়ক জটিলতা নেই। তবে ১২ থেকে ১৮ এর নিচের বয়সি শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে।

ইউরোপের বেশ কিছু দেশ ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সির (EMA) অনুমোদনের পর ১২-এর ঊর্ধ্বে বয়সিদের ভ্যাকসিন প্রদান এরই মধ্যে শুরু করেছে। ডেনমার্ক ও স্পেনে এ বয়সি কিশোরদের ভ্যাকসিন প্রদান অব্যাহত রেখেছে। ফ্রান্স ৬৬ শতাংশ ছেলেমেয়েকে প্রথম ডোজ এবং ৫২ শতাংশকে পূর্ণ ডোজ সম্পন্ন করেছে। তবে জার্মানি যেসব বাচ্চার শারীরিক ঝুঁকি রয়েছে শুধু তাদের ভ্যাকসিনের আওতায় এনেছে। সুইডেন যাদের ফুসফুসের রোগ, হাঁপানি বা এতদ্সংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে তাদের ভ্যাকসিন প্রদান করছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ও কানাডা ১২ বা তদূর্ধ্ব বয়সি ছেলেমেয়েদের জন্য ফাইজার এবং মডার্না ভ্যাকসিন প্রয়োগের অনুমোদন প্রদান করেছে এবং জুলাই ২০২১ অবধি ৪২ শতাংশকে প্রথম এবং ৩২ শতাংশকে পূর্ণাঙ্গ ডোজ প্রদান করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি তাদের গবেষণা তথ্যে বলা হয়, ভ্যাকসিন গ্রহণকৃত ছেলেমেয়েদের চেয়ে ভ্যাকসিনবিহীনদের দেহে সংক্রমণের পরিমাণ ৩ দশমিক ৫ গুণ বেশি। চীনে তাদের প্রস্তুতকৃত সিনোভ্যাক টিকা ৩ থেকে ১৭ বছরের বাচ্চাদের প্রয়োগ শুরু করেছে। ভারতে এ বয়সিদের অক্টোবর ২০২১ অবধি ভ্যাকসিন প্রদানের আওতায় আনার বিষয়ে প্রাথমিক চিন্তাভাবনায় রয়েছে। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন গাইডলাইন অনুসরণে ১৮ বছরের নিচের বয়সি ছেলেমেয়েদের ভ্যাকসিন প্রদান শুরু করেছে। তারা সারা দেশের ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সি ছেলেমেয়ে এবং শারীরিক ঝুঁকি রয়েছে এমন ১২ থেকে ১৫ বয়সিদের ভ্যাকসিনের আওতায় এনেছে। তবে যুক্তরাজ্যের জয়েন্ট কমিটি অব ভ্যাকসিনেশন অ্যান্ড ইমুনাইজিশন (JCVI) ১২ থেকে ১৫ বছর বয়স্ক ছেলেমেয়েদের ভ্যাকসিন প্রদান না করার পরামর্শ দিয়েছে। তাদের মতে, এ বয়সিদের ভ্যাকসিন প্রদানের স্বপক্ষে কোনো অকাট্য তথ্য-উপাত্ত নেই। তারা আরো বলেছে, তাদের গবেষণায় ১০ লাখের মধ্যে মাত্র দুজন ছেলেমেয়ের করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের ইনটেন্সিভ চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে হয়েছে। সুতরাং এ পরিস্থিতিতে তাদের সর্বজনীন ভ্যাকসিনের আওতায় আনার প্রয়োজন নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) ফাইজার টিকাকে ১২ বছরের ঊর্ধ্বের ছেলেমেয়েদের প্রয়োগের অনুমোদন প্রদান করেছে। ফাইজার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এটি ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সিদের দেহে প্রায় ১০০ ভাগ কার্যকরী এবং ১৬ এবং তদূর্ধ্ব বয়সিদের দেহে সফলতা ৯১ শতাংশ। ২ হাজার ২০০ জন ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটি গবেষণা জরিপে তারা প্রমাণ পান, যে ১ হাজার ৫ জন ছেলেমেয়েকে ফাইজার ভ্যাকসিন প্রদান করা হলে তাদের কারো দেহে করোনা সংক্রমণ হয়নি। অপরপক্ষে ৯৭৮ জন ভ্যাকসিনবিহীনের মধ্যে ১৫ জনের দেহে করোনা সংক্রমিত হয়েছে। তবে তারা গবেষণায় দেখেছেন, এ ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর অন্য বয়স্কদের মতো টিকা প্রদানের স্থানে ব্যথা, মৃদু অবসাদ, মাথাব্যথা, কাঁপুনি, মাংশ পেশিতে ব্যথা, জ্বর ও জয়েন্টে ব্যথা দেখা দিতে পারে। ফাইজার কর্তৃপক্ষের গবেষকরা আরো জানিয়েছেন, এ ভ্যাকসিনের মেসেঞ্জার ধুসঢ়; আরএনএ দেহ কোষের নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করেনা তাই ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত করার সম্ভাবনা নেই। এটি করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অনুরুপ অ্যান্টিবডি প্রস্তুত করে সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।

একসময় অভিযোগ ওঠে যে, এ ভ্যাকসিন হৃৎপিন্ডে প্রদাহ সৃষ্টি করে। যদিও সিডিসির গবেষণায় এর সত্যতা মিলেনি। ফাইজার ও মডার্না ৫ থেকে ১১ বছরের ছেলেমেয়েদেরও এ ভ্যাকসিন প্রয়োগের গবেষণা তথ্য শিগগিরই প্রকাশ করতে যাচ্ছে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর তাদের দেশের ৩ থেকে ১৭ বছরের ছেলেমেয়েদের প্রদানের জন্য চীনে তৈরি সিনোফার্ম ভ্যাকসিন অনুমোদন প্রদান করেছে।

অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন কর্তৃপক্ষ 12> < ১৮ বছর বয়সিদের দেহে ব্যবহারের পক্ষে যথেষ্ট তথ্য উপাত্তের জন্য গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৯ বছর বয়সি জনসংখ্যার পরিমাণ শতকরা প্রায় ৪৪ শতাংশ, এর মধ্যে ১২ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত প্রায় ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হিসেবে দেশের ৩০ হাজার মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় দেড় কোটি ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত। দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি চালু করার জন্য সব শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনার ভাবনা সময়োপযোগী। কিছু ভ্যাকসিন এ বয়সি ছেলেমেয়েদের ভ্যাকসিন প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে বিজ্ঞানসম্মত গাইডলাইন প্রস্তুতের মাধ্যমে প্রয়োগও করেছে অনেক দেশ, যাতে এ পর্যন্ত তেমন তীব্র পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার প্রমাণ মেলেনি। শিগগিরই অনুমোদিত অন্যান্য ভ্যাকসিনগুলোও স্কুলগামীদের ভ্যাকসিন প্রদানের সপক্ষে তাদের তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও দেশের সংশ্লিষ্টদের মতামত ও অনুমোদন সাপেক্ষে শিগগিরই আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদেরও ভ্যাকসিনের আওতায় আনা যাবে বলে আমরা আশাবাদী। তবে মনে রাখতে হবে, কোনো ভ্যক্সিনই সব ধরনের করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সমভাবে কার্যকর নয়। তাই ভ্যাকসিন গ্রহণের পরও এ বয়সি শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এ বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সক্রিয় ও সচেতন থাকতে হবে।

লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সহকারী পরিচালক

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, ঢাকা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close