ড. আবদুল আলীম তালুকদার

  ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

মতামত

সন্ত্রাস দমনে শরয়ী বিধান

শান্তির ধর্ম ইসলাম কখনো সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে তো আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ই না বরং তা সমূলে উৎপাটন করে পৃথিবীময় শান্তির ফল্গুধারা প্রবাহিত করার প্রত্যয়ই ইসলামি শরিয়ার প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কেননা ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে পৃথিবীজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা, মানবকল্যাণ ও মানবতার উৎকর্ষের মানসে। তাই ইসলামের দোহায় দিয়ে যারা অনৈতিক ও অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড (সন্ত্রাসী কর্মকা-) পরিচালনা করে তারা মহানবী (সা.)-এর সুন্নাহ (শিক্ষা ও আদর্শ) অনুসরণ করা থেকে অনেক দূরে রয়েছে। যারা সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত তাদের কোনো আদর্শ নেই, তারা প্রকৃতপক্ষে কোনো ধর্মের অনুসারী নয়। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সমাজ-রাষ্ট্র ও পরিবেশ-পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল ও আতঙ্কগ্রস্ত করে দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিল করা।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনুল কারিমের সুরা রা’দের ২৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যারা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের জন্য রয়েছে লানত এবং নিকৃষ্টতম আবাস।’ এ ছাড়া সুরা মায়িদার ৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যারা আল্লাহ্ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায় তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদের হত্যা করা হবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদের দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। পৃথিবীতে এটা হলো তাদের জন্য লাঞ্ছনা। আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।

এ প্রসঙ্গে রাসুল (স.) বলেছেন, ‘কবিরা গুনাহগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা, বাবা-মায়ের অবাধ্য হওয়া এবং মিথ্যা কথা বলা।’ (বুখারি : ৬৮৭১ ও মুসলিম : ৮৮)। সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীরা বিভ্রান্ত ও বিপথগামী। অন্যায়ভাবে একজন মানুষকে হত্যা করা পৃথিবীর সমগ্র মানবজাতিকে হত্যার শামিল। এ মর্মে সুরা মায়িদার ৩৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষ হত্যার অপরাধ বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজের হেতু ছাড়া কাউকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল।’ এ ছাড়া আল্লাহতায়ালা সুরা নিসার ৯৩ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘যে কেউ কোনো মোমিনকে ইচ্ছাকৃত হত্যা করল, তার শাস্তি জাহান্নাম। তথায় সে থাকবে সুদীর্ঘকাল। আল্লাহ্ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন ভয়ংকর শাস্তি।’

ইসলামে সন্ত্রাসী, জঙ্গি, ফিতনা সৃষ্টিকারী, বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের কঠোর শাস্তি উল্লেখ রয়েছে। সুরা বাকারার ১৯১ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘ফিতনা (অর্থ : দাঙ্গা-হাঙ্গামা, শিরক, অত্যাচার-নিপীড়ন) হত্যার চেয়েও ভয়াবহ।’ এ ছাড়া সুরা রুমের ৪১ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে তাদের কোনো কোনো কৃতকর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’

ইসলাম সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে কখনোই সমর্থন করে না। আল্লাহতায়ালা সুরা বাকারার ২০৫ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেন, আর যখন তারা ফিরে যায়, তখন চেষ্টা করে যেন সেখানে অশান্তি (সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও বিপর্যয়) সৃষ্টি করতে পারে এবং শস্যক্ষেত্রে ধ্বংস ও জীবজন্তুর প্রাণনাশ করতে পারে। মূলত আল্লাহতায়ালা অশান্তি (সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা) পছন্দ করেন না। নবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন তার (মুসলমান) ভাইয়ের প্রতি হাতিয়ার দিয়ে ইঙ্গিতও না করে। কারণ তার অজান্তে শয়তান তার হাতে স্খলন ঘটাতে পারে। আর সে (অন্যায়ভাবে হত্যা করার অপরাধে) জাহান্নামের কূপে গিয়ে পতিত হবে।’ (বুখারি)। নবী করিম (সা.) আরো বলেছেন, ‘সাবধান! যে ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় চুক্তির মাধ্যমে নিরাপত্তা নিয়ে বসবাসকারী কোনো ব্যক্তির ওপর অত্যাচার করবে অথবা তাকে অপমান করবে অথবা তার ক্ষমতার বাইরের কোনো বোঝা চাপিয়ে দেবে কিংবা তার সম্মতি ব্যাতিরেকে তার কাছ থেকে কোনো কিছু ছিনিয়ে নেবে, আমি তার বিরুদ্ধে কেয়ামতের দিন মামলার বাদী হব।’ (আবু দাউদ)।

পৃথিবীবাসীর একের জীবন অন্যের কাছে নিরাপদ হবে এই শিক্ষাই ইসলাম দিয়ে থাকে। তাই তো রাসুল (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের কোনো ভাই যেন অন্য কোনো মুসলিম ভাইকে ছোট না করে অর্থাৎ তার মান ও সম্মান ক্ষুণ্ন না করে। কেননা প্রত্যেক মুসলিমের প্রতি অন্য ভাইয়ের রক্ত, মাল-সম্পদ ও ইজ্জত-আব্রুকে ক্ষুণ্ন করাও হারাম করা হয়েছে।’ (সহিহ মুসলিম : ২৫৬৪)। অন্যায় গোচরীভূত হলেই তা প্রতিরোধ করা ইমানি দায়িত্ব। এ মর্মে রাসুলুল্লাহ্ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কোনো অন্যায় কাজ দেখলে সে যেন হাত তথা শক্তি দ্বারা বাধা প্রয়োগ করে। আর সে যদি এ কাজে সক্ষম না হয় তাহলে যেন মুখ তথা বক্তব্যের মাধ্যমে প্রতিহত করে। আর তাতেও সে সক্ষম না হলে, যেন অন্তরে তা প্রতিহত করার পরিকল্পনা করে। যদিও এটা দুর্বল ইমানের পরিচয়’। নবী (সা.) আরো বলেছেন, কেয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকাদ্দমার ফয়সালা হবে তা হলো রক্তপাত বা হত্যা সম্পর্কিত।’ (বুখারি : ৬৩৫৭)।

পরিশেষে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা যায় যে, উপরোল্লিখিত আয়াতে কারিমা ও হাদিস থেকে সহজেই অনুমিত হয় যে, কোনো মুসলমানের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যা বা জুলুম করার কোনো এখতিয়ার নেই; সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম হোক। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী কায়দায় কাউকে হত্যা করা সম্পূর্ণরূপে হারাম, অমার্জনীয় অপরাধ এবং সুস্পষ্ট কবিরা গুনাহ। অতএব এসব অন্যায়-অপকর্ম থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মোমিন-মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ

শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close