জি এম আবুল কালাম আজাদ

  ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

পর্যবেক্ষণ

মহাপবিত্র গ্রন্থ আল-কোরআন

মানবমনে মুদ্রিত আসমানি কিতাব আল-কোরআন। আল-কোরআনের সব বাণী মহান আল্লাহর। এটি আল্লাহর সর্বশেষ গায়েবি গ্রন্থ, যা ইসলামের সর্বশেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর ৬১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে পরবর্তী ২৩ বছরব্যাপী নাজিল হয়। এ মহাগ্রন্থ প্রধানত এক আল্লাহ, তার সৃষ্টি আসমান-জমিনের সর্বেসর্বা, জন্ম-মৃত্যু, পুনরুত্থান, কেয়ামত- শেষ বিচার ইত্যাদি বিশ্বাস-সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর আলোচনা, নৈতিক নির্দেশ, শরিয়তি বিধিনিষেধ, আহ্বান, আমন্ত্রণ, উপদেশ, সাবধান-বাণী, সমালোচনা, তিরস্কার, ভীতি প্রদর্শন, সুসংবাদ, সান্ত্বনা, যুক্তি প্রমাণ, সাক্ষ্য-উদাহরণ, ঐতিহাসিক ঘটনা ও বিশ্ব-প্রকৃতির নিয়ম নিদর্শনের প্রতি ইঙ্গিত বারবার আবর্তিত হয়েছে।

মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে ছোট-বড় সুরা (speech) আছে মোট ১১৪টি। তবে এত বড় যে গ্রন্থ, তা মুখস্থ করানো বা মনে রাখানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন স্বয়ং আল্লাহ। ওহি গ্রহণের প্রাথমিক পর্যায়ের কথা যখন নবী করিম (সা.) ওহি গ্রহণে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি। ওহি নাজিল হওয়ার কালে তার মনে আশা জাগত যে, ‘আমি এর শব্দ ও ভাষা যেন ভুলে না যাই’। দীর্ঘদিন পর সুরা কিয়ামাহ্ নাজিল এবং সুরা ত্বা-হার ১১৩টি আয়াত যা একসঙ্গে ক্রমাগত নাজিল হয়; যখন নবী করিম (সা.)-এর মানবিক দুর্বলতাও ছিল- এ দুসময়েই নবী (সা.) অবচেতনভাবে ওহির শব্দসমূহ বারবার পড়ে আয়ত্ত ও মুখস্থ করতে লাগলেন। তখন তাকে বলা হলো : ‘হে নবী, এই ওহিকে তাড়াতাড়ি মুখস্থ করার জন্য নিজের মুখ দ্রুত চালিত করিবে না। ইহা মুখস্থ করাইয়া দেওয়া ও পড়াইয়া দেওয়া তো আমাদের কাজ-আমাদের দায়িত্ব। ‘আমরা তোমাকে পড়াইয়া দেব; তাহার পর তুমি ভুলিয়া যাইবে না।’ (সুরা আলা, আয়াত-৬)।

তাহলে নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, মানবমনে মুদ্রিত আসমানি গ্রন্থ আল-কোরআন। এ কিতাব গ্রন্থাবদ্ধভাবে নাজিল হয়নি। মূলত এটি এক একটি ভাষণ/সুরা, দাওয়াত; একটি বিপ্লবী আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই কোরআন নাজিল হতে শুরু করে। এ দাওয়াতের সূচনা হতে তার চূড়ান্ত ও পরিপূর্ণতার অধ্যায় পর্যন্ত- তেইশ বছরের সুদীর্ঘকালে বিভিন্ন প্রকার যথার্থ প্রয়োজনমতো রাসুল (সা.)-এর ওপর নাজিল হয়। নামাজ মুসলমানদের জন্য ফরজ। আর কোরআন পাঠ ছিল নামাজের অপরিহার্য অংশ। এজন্যই কোরআন নাজিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুসলমানরা তাকে কণ্ঠস্থ/মুখস্থ করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। এজন্য কোরআন সংরক্ষণ ব্যাপারটা শুধু খেজুরপাতা, হাড় কঙ্কাল বা পাথর খণ্ডের ওপর ছিল না বরং তা নাজিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শত শত, হাজার হাজার, লাখ লাখ মানবমনের ওপর মুদ্রিত হয়ে যেত।

রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর কাফের/মুরুতাদদের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে অনেক সাহাবি (হাফেজ) শহিদ হন। অতঃপর হজরত ওমর (রা.)-এর প্রস্তাবমতো হজরত আবুবকর সিদ্দীক (রা.)-এর অনুমোদনে রাসুল (সা.)-এর ব্যক্তিগত সেক্রেটারি হজরত জায়েদ ইবনে সাবিত আনসারীকে কোরআন গ্রন্থবদ্ধ করার মহান দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোরআন মজিদ গ্রন্থবদ্ধ করার জন্য একদিকে নবী করিম (সা.) পরিত্যক্ত লিখিত অংশসমূহ, অন্যদিকে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যার কাছে পূর্ণ কোরআন বা তার কিছু অংশ লিখিত পাওয়া যায় তাও সংগ্রহ করা হয় এবং কোরআনের হাফেজদের দ্বারাও এ ব্যাপারে পূর্ণ সাহায্য গ্রহণ করা হয়। নির্ভরযোগ্য বিবরণ হতে জানা যায় যে, বহুসংখ্যক সাহাবি নবী করিম (সা.)-এর জীবনেই পূর্ণ কোরআন কিংবা তার বিভিন্ন অংশ নিজেদের কাছে সুরক্ষিত করে রেখেছিলেন। এ প্রসঙ্গে হজরত ওসমান (রা.), হজরত আলী (রা.), আবদুল্লাহ বিন মসউদ, আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আসসালেম মাওলা হেদাসাইফা, যায়েদ বিন সাইফ, মুয়াস বিন জাবাল, উবাই বিন কাসাব এবং আবু জায়াদ বিন সাকাম- সাহাবিদের নাম বিশেষভাবে উল্লিখিত হয়েছে।

মহাপবিত্র গ্রন্থ আল-কোরআনের বিশুদ্ধতা নিয়ে কিছু তথ্য সন্নিবেশ করা হলো। তবে এর বিশুদ্ধতা নিয়ে ব্যাপক তথ্য-দলিলাদি পেশ করার সুযোগ রয়েছে। সুরা বাকারার আয়াত ২ ও ৩-এ আল্লাহ বলছেন, ‘ইহা আল্লাহতায়ালার কিতাব, ইহাতে কোনো ধরনের সন্দেহ নেই। ইহা জীবনযাপনের ব্যবস্থা, সেই মুত্তাকিদের জন্য ৩ : যাহারা গায়েবে (অদৃশ্যকে) বিশ্বাস করে, নামাজ কায়েম করে, আমরা তাহাদিগকে যে রিজিক দিয়াছি তাহা হইতে ব্যয় করে।’ আল কোরআনের সংরক্ষণ ও খিলাফতে ইলাহিয়া বা আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠার দলিল হিসেবে আল্লাহ বলছেন, বস্তুত আল্লাহ যাহাই চাহেন নিশ্চিহ্ন করিয়া দেন, আর যাহা ইচ্ছা প্রতিষ্ঠিত রাখেন। উম্মুল কিতাব (গ্রন্থের মূল উৎস) তো তাহারই নিকট রক্ষিত (উম্মুল কিতাব থেকে সব আসমানি কিতাব নির্গত হয়েছে)’; সুরা রাদ আয়াত-৩৯। এই কিতাব আল্লাহর তরফ থেকে নাজিল হওয়া, যিনি মহাশক্তিশালী, সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী (সুরা আল ম্ুেমন আয়াত-২), ‘গুনাহ মার্জনাকারী, তওবা কবুলকারী, কঠিন শাস্তি দানকারী এবং অতিবড় অনুগ্রহ দানকারী। তিনি ছাড়া মাবুদ কেহ নাই, সকলকে তাঁহারই নিকট ফিরিয়া যাইতে হইবে।’ (সুরা মুুমেন আয়াত-৩)। ‘তিনিই তোমাদের কল্যাণের জন্য রাত ও দিনকে এবং সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়ন্ত্রিত করিয়া রাখিয়াছেন। ইহাতে বহু নিদর্শন রহিয়াছে তাহাদের জন্য, যাহারা বিবেক বুদ্ধিকে কাজে লাগায় (সুরা নাহল আয়াত-১২)। সুরা ফোরকানের ৫৮ ও ৫৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ৫৮ : ‘হে নবী! সেই খোদার ওপর ভরসা রাখ, যিনি ছয় দিনে জমিন ও আকাশম-লকে এবং সেসব জিনিস যাহা এ দুটির মধ্যে রহিয়াছে, বানাইয়া দিয়াছেন। পরে তিনি নিজেই আরশের ওপর আসীন হইলেন। তিনি মহান দয়াবান, তাহার বিরাট মর্যাদা সম্পর্কে যাহারা জানে তাহাদের নিকটই জিজ্ঞাসা কর। সময়ের বিবর্তনে পৃথিবীতে যত নবী বা রাসুল এসেছেন সবাইই এক আল্লাহ নির্ধারিত ধর্ম ইসলাম প্রচার করেছেন। ‘... তোমরা তোমাদের পিতা ইবরাহিমের মিল্লাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হও। আল্লাহ আগেও তোমাদের নাম মুসলিম রাখিয়াছিলেন, আর এই (কোরআন) ও (তোমাদের এ-ই নাম) যেন রাসুল তোমাদের জন্য সাক্ষী হয়, আর তোমরা সাক্ষী হও সব লোকের জন্য। অতএব নামাজ কায়েম করো, জাকাত দাও এবং আল্লাহকে শক্তভাবে ধারণ করো, তিনিই তোমাদের মওলা-মুনিব। তিনি বড়ই উত্তম মওলা, বড়ই উত্তম সাহায্যকারী।’ (সুরা হজ আয়াত ৭৮)।

আল্লাহর নির্ধারিত ধর্ম ইসলাম মেনে চলার জন্য আল্লাহপাক ব্যাপক তাগিদ প্রদান করেছেন এবং কেউ যদি মেনে না চলে সেই কাফির, মুরতাদের জন্য ইহকাল বিশেষ করে পরকালে ব্যাপক শাস্তির বিধান আল্লাহ প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে আল্লাহর বিধান মেনে চলার মুত্তাকিদের জন্য আল্লাহ ব্যাপক পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। আল-কোরআনের বহু স্থানে আসমান-জমিন, বিশ্ব চরাচরের সব নিয়ামত আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এবং আল্লাহ এর সবকিছুরই মালিক, তিনি মহাবিজ্ঞানী, তিনি সর্বেসর্বা- এ ঘোষণা একমাত্র আল্লাহই দিয়েছেন। ‘আকাশম-ল ও জমিনের রব এবং আসমান-জমিনের মাঝখানে যাহা কিছু আছে সেসব জিনিসের রব।’ (সুরা-দু’খান আয়াত ৭)। ‘তিনি ছাড়া মাবুদ কেহ নাই। তিনি-ই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু দান করেন, তিনি তোমাদের রব। তোমাদের পূর্ব পুরুষদের রব যাহারা পূর্বে চলিয়া গিয়াছে।’ (সুরা দু’খান, আয়াত ৮)।

মহান আল্লাহ মানবজাতিকে তার নির্দেশিত পথে চলার জন্য ব্যাপক আকাক্সক্ষা যেমন রেখেছেন আবার সাবধানও করেছেন অজস্রবার। ‘হে নবী! এই লোকদিগকে বলো : কখনো কি তোমরা এই কথা চিন্তা করিয়াছো যে, এই (আল-কোরআন) যদি সত্যিই খোদার নিকট হইতে আসিয়া থাকে আর তোমরা ইহাকে আস্বীকার করিতে থাকো তাহা হইলে সেই ব্যক্তির অপেক্ষা অধিক ভ্রান্ত আর কে হইবে যে ইহার বিরুদ্ধতায় অনেক দূর অগ্রসর হইয়া গিয়াছে।’ (সুরা আস-সাজদাহ্, আয়াত ৫২)। এ সুরার আয়াত ৫৪তে আল্লাহ বলছেন, ‘হুশিয়ার হইয়া যাও। এই লোকরা নিজেদের খোদার সহিত সাক্ষাতের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে। শুনিয়া রাখো, তিনি প্রত্যেকটি জিনিসেরই পরিবেষ্টনকারী’, সুরা আহকাফের ১০ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলছেন, ‘হে নবী তাহাদিগকে বলো, তোমরা কখনো চিন্তা করিয়া দেখিয়াছো কি যে, এই কালাম যদি আল্লাহর নিকট হইতে আসিয়া থাকে, আর তোমরা উহাকে অমান্য-অগ্রাহ্য করিয়া বসো, তাহা হইলে তোমাদের কি পরিণতি হইবে’? সুরা আল-জাসিয়ার ২ নম্বর ও ১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন ২ নম্বর; ‘এই কিতাব আল্লাহর নিকট হইতে অবতীর্ণ, যিনি মহা পরাক্রমশালী, সুবিজ্ঞানী। ১১ নম্বর; ‘এই কোরআন পুরোপুরি হেদায়েতের কিতাব। আর সেই লোকদের জন্য কঠিন জ্বালাদায়ক আজাব রহিয়াছে যাহারা নিজেদের খোদার আয়াতগুলিকে মানিয়া লইতে অস্বীকার করিয়াছে।’

পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে এ নিয়মের কি কখনো কোনো ব্যত্যয় হয়েছে যে, ‘জীব মরে নাই, জীবের মৃত্যু নেই’; বা অত্যাধুনিক বিশ্বের বাঘা বাঘা পণ্ডিত, বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রনায়ক মৃত্যুকে জয় করেছেন? সুরা আনকাবুত আয়াত ৫৭-তে আল্লাহপাক বলছেন, ‘কুল্লু নাফসিন জা-জয়িকাতুল মাওত। ছুম্মা ই-লাইনা-তুরজা’ অর্থাৎ প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করিতে হইবে’; পরে তোমরা সকলে আমারই দিকে প্রত্যাবর্তিত হইবে। সুরা নিসার ৭৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন, তারপরে মৃত্যু, সে তো তোমরা যেখানেই থাকিবে সকল অবস্থায়ই উহা তোমাদিগকে ধরিবে, তোমরা যত মজবুত দালানের মধ্যেই থাকো না কেন...’। ‘...প্রকৃতপক্ষে মৃত্যু ও জীবনদানকারী হইতেছেন আল্লাহ এবং তোমাদের সকল প্রকার কাজকর্মের ওপর তাঁহার তীব্র দৃষ্টি নিবদ্ধ রহিয়াছে।’ (সুরা আলে-ইমরান আয়াত ১৫৬)। ‘অবশেষে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই মরিতে হইবে। এবং তোমরা সকলে নিজ নিজ প্রতিফল পুরোপরিভাবেই কেয়ামতের দিন পাইবে।’ (আলে-ইমরান আয়াত : ১৮৫)।

‘খোদা তিনিই যিনি ছাড়া আর কেহ খোদা নাই। তিনি তোমাদের সকলকে সেই কেয়ামতের দিন একত্রিত করিবেন যে দিনের আগমনে কোনোই সন্দেহ নাই। বস্তুত খোদার কথা অপেক্ষা অধিক সত্য কথা আর কাহার হইতে পারে?’ (সুরা নিসা আয়াত : ৮৭)।

আল্লাহপাকের ঘোষণা মতে জীবের মৃত্যু যেমন অনিবার্য তেমনি কেয়ামত বা মৃত্যুর পর পুনরুত্থান ও শেষ বিচারও অনিবার্য। ‘অতীব মহান ও শ্রেষ্ঠ তিনি, যাহার মুষ্টির মধ্যে জমিন ও আকাশম-ল এবং জমিন ও আসমানের মধ্যবর্তী সমস্ত জিনিসের বাদশাহী রহিয়াছে। কেয়ামতের সময় তাঁহার-ই জানা আছে। এবং সকলে তাঁহার নিকটই প্রত্যাবর্তিত করা হইবে।’ (সুরা জুখরু’ফ আয়াত ৮৫)। সুরা হা-মিম সাজদাহ্ আয়াত ২০-এ আল্লাহ বলছেন, ‘পরে সকলেই যখন সেখানে উপস্থিত হইবে তখন তাহাদের কান, তাহাদের চক্ষু এবং তাহাদের দেহের চামড়া সাক্ষ্য দেবে তাঁহারা দুনিয়ায় কী কী কাজ করিতেছিল’ আল্লাহ নিরপেক্ষ ও যথাযথ ফয়সালা করিবেন।’ ‘আর (এই মোশরেকরা) খোদাকে বাদ দিয়া যাহাদের ডাকে, উহারা তো কোনো জিনিসেরই ফয়সালা করিবে না। বস্তুত আল্লাহই সবকিছু শোনেন এবং দেখেন।’ (সুরা মুমেন আয়াত : ২০)। সুরা মারিয়ামের আয়াত ৯৫-তে আল্লাহ বলছেন, ‘কেয়ামতের দিন সকলেই তাহার সম্মুখে ব্যক্তি ব্যক্তি (ব্যক্তিগত) হিসেবে হাজির হইতে বাধ্য হইবে’। সুরা মুমেনের আয়াত ১৭-তে আল্লাহ বলছেন, ‘(বলা হইবে) আজ প্রত্যকটি প্রাণীকেই তাহার উপার্জনের প্রতিফল দেওয়া হইবে। আজ কাহারো ওপর জুলুম করা হইবে না। আর হিসাব গ্রহণে আল্লাহ খুবই ক্ষীপ্র’। ‘প্রত্যেক ব্যক্তির মর্যাদা তাহার আমল অনুপাতে হয়। আর তোমাদের খোদা লোকদের আমল সম্পর্কে বে-খবর নহেন।’ (সুরা আন’আম আয়াত-১৩২)।

আল-কোরআন (আল্লাহর বিধান) ও আল-হাদিস (মুহাম্মদ (সা.) রাসুলের বিধান) যথাযথ ও গভীরভাবে পালনকারী মানুষই হলো মুক্তাকী। ‘খোদা এবং তাহার রাসুলের আনুগত্য করো, যদি তোমরা মোমিন হইয়া থাকো।’ (সুরা আনফাল আয়াত-১)। মুমিন ও মুত্তাকির মধ্যে বাস্তবিক কোনো প্রভেদ নেই। তারা জান্নাতপ্রত্যাশী। ‘প্রকৃত কথা এই যে, আল্লাহতায়ালা মোমিনদের নিকট হইতে তাহাদের হৃদয়-মন এবং তাহাদের ধন-সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে খরিদ করিয়া লইয়াছেন। (সুরা তাওবাহ্ আয়াত-১১১)। অন্যদিকে আল- কোরআন ও আল-হাদিস অমান্যকারী হলো কাফের বা আল্লাহর ভাষায় জালেম। আল্লাহপাক স্পষ্টভাষায় বলছেন, মৃত্যু, পুনরুত্থান, কেয়ামত-শেষবিচার কোনো অবস্থানেই মুত্তাকিদের জন্য ভয়ের কোনো কারণই নেই। সুরা আম্বিয়ার ১০০-১০৩ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ১০০ : ‘সেখানে তাহারা (কাফের/পাপিরা) কানফাটা আর্তনাদ করিতে থাকিবে। আর অবস্থা এই হইবে যে, সেখানে কোনো আওয়াজই শুনিতে পাইবে না।’ ১০১ : ‘তাহার পর যাহাদের সম্পর্কে আমাদের নিকট হইতে কল্যাণ লাভ করিবে (মুমিন/মুত্তাকি জান্নাতিরা) বলিয়া পূর্বেই সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে তাহারা তো অবশ্যই ইহা হইতে দূরে অবস্থান করিতে থাকিবে’। ১০২ : ‘উহার সর সর শব্দও তাহারা শুনিতে পাইবে না। তাহারা তো চিরদিন নিজেদের মন মতো দ্রব্য-সামগ্রীর মধ্যে ডুবিয়া থাকিবে।’ ১০৩ : ‘চরম সাংঘাতিক বিপদের সময়ও তাহারা একটুকু কাতর হইবে না এবং ফেরেস্তারা অগ্রসর হইয়া তাহাদের সসম্মানে গ্রহণ করিবে। ইহা তোমাদের সেদিন যাহার ওয়াদা তোমাদের নিকট করা হইতেছিল। শোন! যাহারা আল্লাহর বন্ধু, যাহারা ইমান আনিয়াছে এবং যাহারা তাক্ওয়ার আচরণ অবলম্বন করিয়াছে, তাহাদের জন্য কোনো ভয় ও কষ্টের কারণ নাই। দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনে তাহাদের জন্য কেবল সুসংবাদই সুসংবাদ রহিয়াছে। আল্লাহর কথাসমূহ বদলাইতে পারে না। ইহাই অতিবড় সাফল্য। (সুরা ইউনুস আয়াত : ৬২-৬৩ ও ৬৪)। অবশ্য যে তওবা করিবে, ইমান আনিবে ও নেক আমল অবলম্বন করিবে তাহারা জান্নাতে দাখিল হইবে এবং তাহাদের বিন্দুমাত্র অধিকার বিনষ্ট হইবে না। তাহাদের জন্য চিরস্থায়ী জান্নাত রহিয়াছে রহমান তাহার বান্দাহদের সহিত গোপনে যার ওয়াদা করিয়া রাখিয়াছেন। আর এই ওয়াদা নিঃসন্দেহে পূর্ণ হইবেই হইবে।’ (সুরা মারিয়ম আয়াত : ৬০,৬১)। ‘দুনিয়ার কয়েকদিনের জীবনে মজা ভোগ করুক। পরে আমাদের নিকটই প্রত্যাবর্তন করিতে হইবে। তখন আমরা তাহাদের করা এই কুফরির বদলায় তাহাদিগকে কঠিন আজাবের স্বাদ ভোগ করাইব।’ (সুরা ইউনুস আয়াত-৭০)।

সুরা নামলের ৮৭ থেকে ৯০ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ৮৭ : ‘আর সেদিন কী হইবে যেদিন শিঙ্কায় ফুঁক দেওয়া হইবে এবং ভীত কম্পিত হইয়া পড়িবে সেসব যাহা কিছু আসমান ও জমিনে রহিয়াছে তাহাদের ছাড়া যাহাদের আল্লাহ এই ভীষণ অবস্থায় বাঁচাইতে চাহিবেন এবং যখন সবাই কান চাপিয়া তাহার সমীপে হাজির হইয়া যাইবে!’ ৮৮ : ‘আর তুমি পাহাড় দেখিয়া মনে করিতেছ যে, উহা বুঝি খুব দৃঢ়মূল হইয়া আছে; কিন্তু তখন ইহা মেঘমালার মতোই উড়িতে থাকিবে। ইহা হইবে আল্লাহর কুদরতের বিস্ময়কর কীর্তি, যিনি প্রত্যেকটি জিনিসকেই সুষ্ঠুভাবে মজবুত করিয়া বানাইয়াছেন। তোমরা কি করিতেছ তাহা তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন।’ ৮৯ : ‘যে ব্যক্তি ভালো আমল লইয়া আসিবে সে তদপেক্ষাও উত্তম ফল লাভ করিবে এবং এই ধরনের লোকরা সেদিন ভয় ও আতঙ্ক হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকিবে।’ ৯০ : ‘আর যে ব্যক্তি খারাপ আমল লইয়া আসিবে, এ ধরনের সব লোকই উল্টাভাবে আগুনে নিক্ষিপ্ত হইবে। যেমন কর্ম তেমন ফল- ইহা ছাড়া অপর কোনোা প্রতিফল কি তোমরা পাইতে পারো?’

‘তুমি দেখিতে পাইবে, এই জালেমরা নিজেদের কৃতকর্মের পরিণামকে (আজাব) ভয় করিতে থাকিবে এবং উহা উহাদের ওপর অবশ্যই আসিয়া পড়িবে। পক্ষান্তরে যাহারা ইমান আনিয়াছে এবং যাহারা নেক আমল করিয়াছে। তাহারা জান্নাতের গুলবাগিচায় অবস্থান করিবে। যাহা কিছুই তাহারা চাহিবে তাহারা তা খোদার নিকটই লাভ করিবে। ইহাই অতিবড় অনুগ্রহ।’ (সুরা আস-শুরা আয়াত ২২)। আল-কোরআন ও আল-হাদিস মোতাবেক জীবন পরিচালনা করে আমরা মুত্তাকির বেশে জান্নাতি হবো। মানব জীবন ধন্য ও সফল হবে- এটাই আমাদের সর্বজনীন প্রার্থনা।

লেখক : জিএম, ডিপার্টমেন্ট অব কমিউনিকেশনস

অ্যান্ড পাবলিকেশনস, বাংলাদেশ ব্যাংক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close