মো. জিল্লুর রহমান
মুক্তমত
প্রতারণার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিই কাম্য
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শুরু হয়েছে ই-কর্মাসের নামে নতুন প্রতারণ। ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকার মতো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। এর আগে ভিন্ন কৌশলে যুবকের মতোই প্রতারণা এবং জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে ডেসটিনি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। মানুষের কাছ থেকে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও জালিয়াতির মামলায় ডেসটিনির শীর্ষ ব্যক্তিরা এখন কারাগারে। এসব প্রতারণার ফাঁদে ফতুর হয়েছে লাখ লাখ গ্রাহক। মামলা হয়েছে, গ্রেপ্তারও হয়েছে মালিক ও প্রতারকরা, কারাগারেও পাঠানো হয়েছে কিন্তু তাদের কোনো শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। অভিযুক্তরা কিছুদিন পর কারাগার থেকে বের হয়ে আবার প্রতারণা শুরু করে নতুন নামে, নতুন কৌশলে। লাভের আশায় টাকা দিয়ে ডেসটিনি, যুবক, আইসিএল, ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, এহসান গ্রুপের লাখ লাখ মানুষ এখন সর্বস্বান্ত, তারা টাকা পাননি, বিচারও পাননি।
সম্প্রতি ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ‘এহসান গ্রুপ পিরোজপুর-বাংলাদেশ’ নামের এক কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং তার এক সহযোগীকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেডসহ কয়েকটি মাদরাসা খুলে ওই কোম্পানি ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান একটি মাদরাসার অধ্যক্ষ এবং এক সময় তিনি মসজিদের ইমাম ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এমএলএম ব্যবসা শুরু করেন এবং ২০১০ সালে এহ্সান রিয়েল এস্টেট নামে একটি কোম্পানি খোলেন। পরে আরো ডজনখানেক কোম্পানি খুলে তিনি নাম দেন ‘এহসান গ্রুপ পিরোজপুর-বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটি নতুন কৌশলে ওয়াজ মাহফিলে প্রচারণা শুরু করে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে। এ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকারী লক্ষাধিক মানুষ এখন পথে বসতে বসেছে। তারাও কোনো টাকা ফেরত পাননি। কবে পাবেন এ গ্যারান্টিও কেউ দিতে পারছেন না।
অতি মুনাফার লোভ দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে সর্বপ্রথম বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি বা যুবক। ১৯৯৬ সালে যুবকের নিবন্ধন দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজসকো)। রাজধানীর শাহবাগে আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেটে কয়েকটি দোকান ভাড়া নিয়ে যাত্রা শুরু করে যুবক। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ সুদের বিনিময়ে আমানত সংগ্রহ ও ঋণদান কর্মসূচি চালু করে। ২০০৫ সালে যুবকের প্রতারণামূলক কার্যক্রম নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তদন্তে নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবৈধ ব্যাংকিংয়ের অভিযোগে তখন যুবকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু গ্রাহকদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব কে নেবে, অর্থ মন্ত্রণালয়, নাকি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, তা নিয়ে কেটে যায় কয়েক বছর। এ দীর্ঘ সময়েও যুবকের ৩ লাখ ৪ হাজার গ্রাহক তাদের পাওনা ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ফেরত পাননি। এদিকে ব্যাংক হিসাব জব্দ না করায় ব্যাংক হিসাবে থাকা টাকা উঠিয়ে নিয়ে গেছেন যুবকের উদ্যোক্তারা। আবার যুবকের সম্পদ বাজেয়াপ্ত না করায় অনেক সম্পদ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে গেছে, আবার অনেক সম্পদ বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, গ্রাহকদের পাওনা, সম্পদের দায়দেনাসহ যুবকের আর্থিক কেলেঙ্কারির পরিমাণ ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
যুবকের প্রতারণার পর মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম-বহু স্তরের বিপণন) কোম্পানির প্রতারণার বিষয়টি গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সময়ে ঘুরেফিরে আলোচনায় এসেছে। ২০১২ সালে ডেসটিনি কেলেঙ্কারিতে সারা দেশে হইচই পড়লেও থেমে থাকেনি তাদের ব্যবসা। প্রতারণার ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে মামলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওইসব কোম্পানির কর্ণধারদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। দায়েরকৃত মামলার বিচার চলমান। কিন্তু ওইসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা লাখ লাখ মানুষ কোনো টাকা ফেরত পাননি।
ডেসটিনি ও যুবক অতি মুনাফার ফাঁদে ফেলে গ্রাহকদের টাকা লুটের সবচেয়ে বড় দুটি উদাহরণ। এ দুটি প্রতিষ্ঠান সাধারণ গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে প্রায় ৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ৪ হাজার ১১৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে বিচার চলছে ডেসটিনি গ্রুপের ২২ জনের বিরুদ্ধে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করে দেখেছে, উচ্চহারে মুনাফার লোভ দেখিয়ে এমএলএম ব্যবসা পদ্ধতিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড এবং ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেডের বিভিন্ন প্যাকেজের শেয়ার দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন গ্রুপের পরিচালকরা। ওইসব অর্থ ৩২টি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের নামে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করেছে।
একইভাবে কথিত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি (এমএলএম) ইউনিপেটুইউতে ১০ মাসে দ্বিগুণ লাভের আশায় ৬ লাখ বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ করা ৬ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। দুদক ২০১১ সালের ইউনিপেটুইউর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে মামলা করে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির ওপর তদন্ত করেও এসব তথ্যের প্রমাণ পায়। এ টাকা ফেরত পেতে বিনিয়োগকারীরা সরকারের সংশ্লিষ্ট অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরে জুতা ক্ষয় করে চলেছে। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেই। টাকা ফেরত দিতে আদালতের নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই। আবার কিছু গ্রাহক এমএলএম প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে টাকা আদায়ের মামলা করলেও তা বছরের পর বছর ঝুলছে।
অন্যদিকে গত কয়েক বছরে ই-কমার্স ব্যবসার নামেও চটকদার ছাড়ের প্রলোভন দিয়ে পণ্য বিক্রির নামে অন্তত ১৫টি কোম্পানি হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এর বাইরেও বর্তমানে অন্তত অর্ধশতাধিক কোম্পানি সক্রিয় প্রতারণার কাজে। যারা গ্রাহকদের লোভের ফাঁদে ফেলে শত শত কোটি টাকার হাতিয়ে নিয়েছে। ই-কমার্সের পাশাপাশি প্রতারক প্রতিষ্ঠানের তালিকায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে অনলাইন এমএলএম কোম্পানি। আলোচিত ই-ভ্যালিসহ আরো বেশ কয়েকটি কোম্পানির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাদের কেউ কেউ গ্রেপ্তারের পর কারাগারে গেছে। কেউবা পালিয়েছে বিদেশে। কিন্তু প্রতারিত গ্রাহকরা একদিকে যেমন ছাড়ের পণ্য পায়নি, তেমনি তাদের দেওয়া কোনো টাকাও ফেরত পাননি। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বিভিন্ন এমএলএম, অনলাইন ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো নানা প্রলোভন দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অন্তত ৪০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এরই মধ্যে। গ্রাহকরা তাদের বিনিয়োগের এই পুঁজি ফেরত পাবেন কিনা তা অনিশ্চিত। এমন প্রেক্ষাপটে প্রতারিত লাখ লাখ মানুষ পথে বসে গেছে। গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের পর প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কেউ কেউ দেশত্যাগ করছেন, বিদেশে পাচার করছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। ই-ভ্যালি ও ই-অরেঞ্জসহ আলোচিত ১৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তদন্ত করে এমন অভিযোগ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এর মধ্যে ধামাকা শপিং গ্রাহকের ৫৯৮ কোটি টাকা নিয়ে পলাতক রয়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ১১৭ কোটি টাকা পাচারের ‘প্রমাণও পেয়েছে’ পুলিশ। এছাড়া, ই-অরেঞ্জ নামের একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ প্রতারণামূলকভাবে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকদের কয়েকজন গ্রেপ্তারের পর এখন কারাগারে। এর মূল হোতা ও পৃষ্ঠপোষক আরেক মালিক পুলিশ কর্মকর্তা ভারতে আটক হয়েছেন। বিভিন্ন ছাড়ে পণ্য কিনতে এ প্রতিষ্ঠানে যারা টাকা দিয়েছিলেন তারা এখন চিন্তায় আছেন আদৌ টাকা ফেরত পাবেন কিনা। আইনজীবীদের মতে, গ্রাহকের প্রতারিত টাকা ফিরে পাওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার। কারণ প্রতারণা করে নেওয়া টাকা তো কোম্পানিগুলোর কাছে নেই। তাদের ফান্ডে একেবারে নগণ্য টাকা রয়েছে। এ জন্য অন্যান্য সম্পদও জব্দ করা হয়েছে। সব সম্পদ ও ফান্ডে থাকা টাকা দিয়েও গ্রহকের পাওনা সম্পূর্ণ টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ পাওনা টাকার পরিমাণ জব্দকৃত সম্পদের চেয়ে অনেক বেশি।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) মতে, উন্নত দেশে ই-কমার্স খাতে নজরদারি ও স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা পর্যবেক্ষণের জন্য ফেয়ার ট্রেড কমিশন থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো কমিশন নেই। আমাদের প্রতিযোগিতা কমিশন রয়েছে। কিন্তু এটির ক্ষেত্র সীমিত। এছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যেও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। তাছাড়া ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে এর জন্য ডিজিটাল কমার্স নীতিমালায় ‘রিস্ক ফ্যাক্টর ম্যানেজমেন্ট কমিটি’র বিষয়টি প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এতদিনেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এ কমিটি থাকলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজর রাখা সহজতর হবে। তা ছাড়া ই-ক্যাবের কাছে কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কত টাকা লেনদেন করছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য থাকে না। তথ্য থাকলে সন্দেহজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর আগে থেকে চিহ্নিত করা যেত। অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে তার সম্পদের ওপর ভিত্তি করে কত টাকা বাকি রেখে লেনদেন করতে পারবে তা বেঁধে দিতে পারে।
আসলে অর্ধেক দামে পণ্য বিক্রি, শতভাগ বা তার বেশি ক্যাশব্যাক, পণ্য ডেলিভারির অনেক আগে টাকা নিয়ে নেওয়া এগুলো প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, একটা পর্যায়ে গ্রাহক ঠকানো এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠান দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত কেউই তাদের বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত পাননি। এখানে আইন প্রয়োগ হয় ঠিকই, তবে সেটা যথা সময়ে নয়। অনেক দেরিতে। ই-কমার্স প্ল্যাটফরমে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো আলোচনায় এসেছে অনেক আগেই। অথচ সঙ্গে সঙ্গে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এত বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের আর্থিক ক্ষতি হতো না। এজন্য অভিযুক্তদের শুধু গ্রেপ্তার নয়, দ্রুত সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার।
লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট
"