সতীর্থ রহমান

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

মুক্তমত

প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই জীবনমুখী শিক্ষা

প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে জীবনমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা এখন যুগের দাবি। শিক্ষাজীবনের শুরুতে প্রাথমিক স্তর থেকেই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের তত্ত্বীয় শিক্ষার পাশাপাশি ব্যবহারিক তথা হাতে-কলমে শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন। শিশুদের জন্য এমন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে; যা তাদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে স্বনির্ভর হতে সহায়তা করে। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সেই শিক্ষা যেন কাজে লাগে। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের যা শেখানো হচ্ছে তা এক ধরনের গৎবাঁধা তাত্ত্বিক শিক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। শিশু শিক্ষার্থীদের কাছে স্কুল আনন্দদায়ক মনে হয় না। শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় প্রাণের স্পন্দন জাগে না। শিক্ষা আনন্দময়। আনন্দঘন পরিবেশে শিশুদের পাঠদান সুনিশ্চিত করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠ্যক্রম বহুলাংশে শহর ও গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠী আদিবাসী, উপজাতি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ও জীবনমুখী নয়। দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, শিষ্টাচার, নৈতিকতা, জীবনধর্মী বিষয়াদি-সমৃদ্ধ ন্যূনতম পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও চর্চা একান্ত জরুরি।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তর থেকেই কৃষিশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের নিবিড় কৃষিশিক্ষার লক্ষ্যে স্বতন্ত্র পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং কৃষিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করা প্রয়োজন। ব্যবহারিক কৃষি শিক্ষার জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কৃষি প্রদর্শনী প্লট বা বাগান গড়ে তোলা বাধ্যতামূলক আইন জারি করতে হবে। বিদ্যালয় বাগান হবে কৃষিশিক্ষার জীবন্ত বিদ্যাপীঠ। এখানে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে কৃষিভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ পাবে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা প্রকৃতি পাঠ, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং প্রায়োগিক কৃষিশিক্ষার ওপর বাস্তব ধারণা লাভ করবে। বাগানের পরশে শিক্ষার্থীদের কৃষিভিত্তিক মনমানসিকতা গড়ে উঠবে। বিদ্যালয়ের সৌন্দর্যবর্ধন ও উন্নয়নের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম স্বনির্ভরতা অর্জনে সক্ষম হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিশেষত দারিদ্র্যবিমোচন ও টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করতে স্কুলকেন্দ্রিক বাগান কার্যক্রমের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। কৃষি শিক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিলে দেশ স্বনির্ভর হবে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অপুষ্টি, বেকারত্বের মতো বহু জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে। বাগান তৈরির যোগ্যতা অর্জনকে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের একটি প্রান্তিক যোগ্যতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন।

গত ১৩ জানুয়ারি ২০০৯ দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, জাতিসংঘ ২০০৫-২০১৪ সালকে টেকসই উন্নয়নের জন্য শিক্ষার দশক হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ দশকের লক্ষ্য হলো টেকসই উন্নয়নের জন্য মূল্যবোধ, আচরণ আর মানসম্মত জীবন সম্পর্কে শিক্ষাদান। সমাজভিত্তিক শিক্ষা কেন্দ্র কীভাবে টেকসই উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে- এ সম্পর্কে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক এম. এহ্ছানুর রহমান। টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত দারিদ্র্যবিমোচন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত উন্নয়নসহ সামগ্রিক উন্নয়ন। অর্জিত উন্নয়নকে ব্যাহত না করে বর্তমান প্রজন্মের প্রয়োজন মেটানোই হলো টেকসই উন্নয়ন। সম্মিলিত আলোচনার মাধ্যমে সবার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেটা সমাধানের মাধ্যমে উন্নয়ন এগিয়ে নেওয়া যায়। শুধু সরকারই নয়, কমিউনিটি, এনজিও, সিভিল সোসাইটির অংশগ্রহণ নিশ্চিতের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন করা সম্ভব।

জাতীয় অগ্রগতি, টেকসই উন্নয়ন এবং জীবন ঘনিষ্ঠ শিক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে বর্তমানে প্রচলিত পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষার স্থলে আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি সুদৃঢ় করার জন্য ন্যূনতম আট বছর মেয়াদি শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা অত্যাবশ্যক। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে আট হতে ১২ বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষার মেয়াদ চালু রয়েছে। অষ্টম শ্রেণি শিক্ষা শেষে পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট (১৯৭৪) অনুসরণ করা যায়।

মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রাথমিক শিক্ষাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। জীবনধর্মী ও কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করা সম্ভব। প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য হলো শিশুর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক, মানবিক ও নান্দনিক বিকাশ সাধন এবং তাকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করা। এ বিশাল লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। পুঁথিগত মুখস্থবিদ্যার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে হাতে-কলমে দক্ষতা অর্জনের ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে। দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে শিক্ষাই একমাত্র মাধ্যম। আমাদের ন্যায় দরিদ্র ও অনুন্নত দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি জীবনমুখী শিক্ষার মধ্যেই নিহিত রয়েছে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

স্বনির্ভর কৃষি ক্লাবের রূপকার, সদর, দিনাজপুর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close