এ কে এম এ হামিদ
দৃষ্টিপাত
আমার গ্রাম আমার শহর ও আশ্রয়ণ প্রকল্প
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত শক্ত না হলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ভিত মজবুত হবে না। স্বাধীন দেশে জাতির পিতা সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামের বৈষম্য পর্যায়ক্রমে দূর করার উদ্দেশে কৃষিবিপ্লবের বিকাশ; গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতায়ন; কুটির ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ; শিক্ষা, যোগাযোগ ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার যুক্ত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর গ্রাম উন্নয়ন দর্শনের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে এসেছেন, যা গ্রামীণ অবয়ব উন্নয়নে সত্যিই আশা জাগানিয়া। এই প্রতিপাদ্যের ইতিবাচক দিক হলো- রাষ্ট্রীয় মূল দর্শনে গ্রাম উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আগামী প্রজন্মের জন্য সমৃদ্ধ গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ ও নাগরিক পরিষেবা নিশ্চিত করতে হলে গ্রামীণ মানুষের জনাকাক্সক্ষা, চাহিদা, সম্পদের প্রাপ্যতা ও জোগান, প্রকৃতি প্রতিবেশ, মানুষের আচরণগত বৈশিষ্ট্য মূল্যায়নে গ্রামভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে হবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, যেকোনো পরিকল্পনা টেকসই করতে হলে সেই পরিকল্পনা যে সুবিধাভোগীদের কল্যাণে গৃহীত; বিষয়টি তাদের অনুধাবনে নিয়ে আসতে হবে। তাহলে সমন্বিত প্রক্রিয়ায় উন্নয়ন বেগবান হয় এবং স্থিতিশীলতা পায়। বিষয়টি অনুধাবনে নিয়েই ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ পরিকল্পনায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে- পল্লী উন্নয়নের লক্ষ্য হবে গ্রামাঞ্চলে কর্মসৃজন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধার প্রসার ও গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের হার হ্রাস করা। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রত্যেক ইউনিয়নে পরিকল্পিত আবাসন, শিক্ষা, কৃষিনির্ভর শিল্পের প্রসার, চিকিৎসাসেবা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানীয় জল ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার মাধ্যমে উপজেলা সদর ও বর্ধিষ্ণু শিল্পকেন্দ্রগুলোকে আধুনিক শহর-উপশহর হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে; যা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের সম্পূরক।
জননেত্রী শেখ হাসিনার জননন্দিত পরিকল্পনা ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ গড়তে হলে অবশ্যই শহরের সুযোগ-সুবিধা স্বল্প পরিসরে হলেও গ্রামে নিয়ে যেতে হবে। হ্রাস করতে হবে গ্রাম ও শহরের বৈষম্য। গ্রাম উন্নয়ন পরিকল্পনায় কৃষি, পানি, শক্তি, স্যানিটেশন, আবাসন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিশেষায়িত ক্ষেত্রগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। গ্রামবহুল বাংলাদেশকে পল্লী সমাজ হিসেবে বিবেচিত হলেও এলাকাভেদে প্রত্যেকটি গ্রামের রয়েছে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। সেই নির্দিষ্ট জীবনযাত্রার রূপরেখা বিবেচনায় স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, হাটবাজার, পাঠাগার, ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণের পাশাপাশি গ্রামীণ কৃষি উপকরণের প্রাপ্যতা বিবেচনায় শিল্প কারখানা গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিতে হবে। তবে যে পরিকল্পনাই গ্রহণ হোক কেন, সেখানে অবশ্যই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে ভূমি ব্যবস্থাপনাকে। স্বল্প ভূখ-ের বাংলাদেশের আগামীর খাদ্য নিরাপত্তার দিক অনুধাবন করে কৃষি জমি সাশ্রয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই। সবুজ গাছপালা আমাদের গ্রামগুলোর প্রাণ। আমরা যেন অপরিকল্পিত পরিকল্পনায় গ্রামগুলোকে শহরের রূপ দিতে গিয়ে সেই প্রাণে ছেদ না ধরায়, সে দিকে মনোযোগ দিতে হবে। প্রাকৃতিক জলাধার রক্ষা করে যেন পুষ্টি চাহিদা জোগানোর পাশাপাশি সুপেয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, সে জন্য গ্রামীণ জনপদের সব গভীর-অগভীর জলাধার রক্ষাসহ পাহাড়ি অঞ্চলগুলোয় জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে। গ্রামে ‘ক্লিন এনার্জি’ যেমন : বাতাস, সৌরশক্তি, বায়োগ্যাস, মাইক্রো-হাইড্রো-এর ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্থানীয়ভাবে সঠিক কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ ও স্বল্পমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি এবং আশু করণীয় বিষয়কে স্থান দিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।
১৯৭২ সালের ৩০ জুন সমবায় সম্মেলনে সমবায়ীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে- এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন’। তার এ অভিব্যক্তির মাঝে মানুষের কল্যাণ কেন্দ্রিক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার যে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে, তাতেই অন্তর্নিহিত রয়েছে- একটি সদ্য স্বাধীন দেশের এগিয়ে যাওয়ার পথনির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুর এই আকাক্সক্ষা ধারণ করে যদি সব রাজনীতিবিদ ও সর্বস্তরের সমাজপতিরা দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য ‘খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও উন্নত জীবন’ প্রতিষ্ঠার রাষ্ট্রীয় মূল দর্শন বাস্তবায়নে সচেষ্ট হতো, তাহলে অনেক আগেই জাতি উন্নত ও মানবিক রাষ্ট্র পেত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে পরবর্তী সরকারগুলো এই মৌলিক চাহিদা পূরণে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে দুর্যোগপূর্ণ বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বন্যা ও নদীভাঙন কবলে পড়ে বাস্তুচ্যুত হয় এবং জীবিকার তাগিদে শহরমুখী হয়েছে। কিন্তু জনস্রোতের তুলনায় শহরগুলোও তাদের আবাসন চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে- বাস্তুচ্যুত মানুষগুলো বাধ্য হয়ে রেললাইন, সরকারি খাস জমি, সড়কের পাশে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে আশ্রয়ের ঠিকানা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের ভিত্তিতে যদি গ্রামীণ জনপদ গড়ে তোলা যায়, তাহলে শহরমুখী মানুষের স্রোত কিছুটা হলেও থামানো সম্ভব হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালী বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা গ্রামে ভূমিহীন-গৃহহীন অসহায় ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রমের যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক ঘটনার পর দীর্ঘ ২১ বছর কোনো সরকারই ছিন্নমূল অসহায় মানুষদের পুনর্বাসনে তেমন কর্মসূচি গ্রহণ করেনি। ১৯৯৬ সালে জনরায়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে ১৯৯৭ সালের ১৯ মে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব কক্সবাজার জেলার সেন্টমার্টিনের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্দশা দেখে দেশব্যাপী আশ্রয়ণ প্রকল্প চালু করে। এই প্রকল্পের আওতায় ৩৮৪০ দশমিক ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২ লাখ ৯৮ হাজার ২৪৯টি ভূমিহীন-গৃহহীন-অসহায়-ছিন্নমূল পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। পরবর্তী সময়ে উক্ত প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে আশ্রয়ণ প্রকল্প (ফেজ-২) এ জুলাই ২০০২-ডিসেম্বর ২০১০ মেয়াদে ৬০৮ দশমিক শূন্য কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৮ হাজার ৭০৩টি ভূমিহীন পরিবারকে ব্যারাকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। প্রকল্পের সাফল্য ও ধারাবাহিকতায় জুলাই ২০১০-জুন ২০২২ (সংশোধিত) মেয়াদে ২ দশমিক ৫০ লাখ ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল অসহায় পরিবার পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ২৯৩২ দশমিক ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১ লাখ ৯২ হাজার ৩৩৬টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। আশ্রয়ণের চলমান কার্যক্রমের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে দেশব্যাপী ভূমি ও গৃহহীন ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২ পরিবারকে বাড়ি নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে বলা যায় প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্যোগ টেকসই সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণের পথে ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। তবে যেকোনো প্রকল্পের সুফল নিশ্চিত করতে হলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অত্যন্ত সততা, নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হয়। অথচ চলমান আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে জাতি দুঃখজনকভাবে অনেক অনিয়ম লক্ষ্য করেছে। দেখা যাচ্ছে প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দ করা গৃহ উপকারভোগীদের নিকট হস্তান্তরের আগেই ভেঙে যাচ্ছে। যা দেশবাসীকে হতাশ ও বিক্ষুব্ধ করেছে। এতে শুধু প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে না, বরং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এটি প্রধানমন্ত্রীর নেওয়া জনকল্যাণমূলক আশ্রয়ণ প্রকল্প ব্যর্থ করে দেওয়ার হীন উদ্দেশে স্বার্থান্বেষী চক্রের অপতৎপরতা কি না, সেটি ভেবে দেখা দরকার।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের গৃহ নকশা পর্যালোচনা করলে লক্ষ্য করা যায় যে, গৃহটির বহুমাত্রিক ব্যবহার, প্রাইভেসি, ভেন্টিলেশনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মিতব্য গৃহের ফাউন্ডেশন ইত্যাদি বিষয়ে যথাযথ ইঞ্জিনিয়ারিং দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেনি। দেশের বিভিন্ন স্থানের ভূমি ও পরিবেশের বিষয় বিবেচনায় গৃহ নির্মাণের ভিত ও অন্যান্য বিষয় কিছু পার্থক্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। একই ফাউন্ডেশনে বিভিন্ন স্থানে গৃহনির্মাণ করা হচ্ছে, যা যথার্থ নয়। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা দুর্নীতি ও অনিয়ম, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে, যা জনস্বার্থে বিবেচনায় রাখতে হবে। দেশের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতা ও সরকারি অর্থের অপচয়ের বিষয়টি পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, যার যে কাজ তাকে দিয়ে সে কাজ না করিয়ে, অন্য কাউকে দিয়ে করানো এবং সেসব মন্ত্রক বা দপ্তর সরকারি উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারণী কাজ করার কথা তারাও সরকারি অর্থ ব্যয়ে অংশীদার হতে চায়। এ ধরনের শত শত মিলিয়ন ডলারের কাজ এ দেশে চলছে। হয়তোবা আশ্রয়ণ প্রকল্পের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি এ ধরনের অতি আগ্রহের কারণেই ঘটেছে। কথায় বলে ‘যার কর্ম তারে সাজে, অন্য লোকের লাঠি বাজে’।
হতদরিদ্র জনগণের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ক) অনুচ্ছেদে বিষয়টি সন্নিবেশিত করেন। বর্তমানে জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১.৪নং লক্ষ্যে বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়েছে। সংবিধানের এই মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহহীনদের গৃহ দেওয়ার যে মানবিক উদ্যোগ নিয়েছেন, তা কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। সেই দিক বিবেচনায় আইডিইবি স্টাডি করে প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তিনটি প্রস্তাব প্রণয়ন করেছে। প্রস্তাবগুলো হলো- (১) উঁচু জায়গা ও মাটির ধারণক্ষমতা বিবেচনায় বিভিন্ন স্থানে রান্নাঘর, টয়লেট ও বারান্দাসহ দুই বেডের সেমিপাকা টিনশেডের ঘর নির্মাণ করা যতে পারে। এই প্রস্তাব ঠিকাদার অথবা প্রকল্প কমিটি দ্বারা নির্মাণ করা যাবে। (২) ভাঙনপ্রবণ ও ভরাট মাটির ওপর গৃহ নির্মাণের ক্ষেত্রে টিনের চালা ও টিনের বেড়া দ্বারা স্থানান্তরযোগ্য ঘর নির্মাণ করা যেতে পারে। যেখানে পিন্থ লেভেল বা ফ্লোর লেভেল পর্যন্ত পাকা দেয়াল ও মেঝে পাকা করতে হবে। কখনো গৃহগুলো নদীভাঙনে পড়লেও গৃহগ্রহীতা স্বল্প ব্যয়ে ও সহজে অন্য যেকোনো স্থানে ঘরটি হস্তান্তর করতে পারবে। (৩) যদি সরকার অর্থায়ন করতে পারে তাহলে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ এবং ‘কৃষিজমি রক্ষা কর, পরিকল্পিত গ্রাম গড়’ প্রতিপাদ্য বাস্তবায়নে জমি সাশ্রয়ের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রত্যেক সুবিধাভোগীর অনুকূলে ২ শতাংশ মূল্যবান কৃষিজমি প্রদান না করে বরং ৫ শতাংশ জমিতে ছয়তলা ভিতের ওপর ছয় তলাবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করা অধিকতর যুক্তিযুক্ত হতে পারে। যেখানে নিচতলায় কমন স্পেস (সবাই পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহার করতে পারবেন) এবং অবশিষ্ট প্রতি তলায় চারটি ফ্ল্যাট করে মোট ২০টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা যেতে পারে, যার প্রতিটির আয়তন ৪৮০ বর্গফুট হবে। এতে করে নির্দিষ্ট ৫ শতাংশ জমিতে ২০টি পরিবার টেকসই গৃহে প্রায় শত বছর বসবাস করতে পারবেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, চলমান আশ্রয়ণ প্রকল্পে মোট ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি ঘর নির্মাণ করা হবে। প্রতি পরিবারের জন্য ২ শতাংশ হারে জমি প্রদান করলে ৯৭ লাখ ৭১ হাজার ২৪৪ শতাংশ বা ১৭ হাজার ৭১২ দশমিক ৪৪ একর জমি প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে এ নিবন্ধে উল্লেখিত প্রস্তাবনা অনুযায়ী ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২ ফ্ল্যাটের জন্য ৪৪ হাজার ২৮১টি ভবন প্রয়োজন হবে এবং প্রতিটি ভবনের জন্য পাঁচ কাঠা হারে ২ লাখ ২১ হাজার ৪০৫ কাঠা বা ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৯৫৮ শতাংশ বা ৩৬৫৯ দশমিক ৫৮ একর জমি প্রয়োজন হবে। ফলে জমি সাশ্রয় হবে ১৪ হাজার ৫২ দশমিক ৮৬ একর। এই প্রস্তাব অনুযায়ী ৫ শতাংশ জমিতে ২০টি পরিবারকে গৃহ-ফ্ল্যাট প্রদানের মাধ্যমে একেকটি ক্লাস্টার ভিলেজে যে পরিমাণ জমি রক্ষা হবে, সেই জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করে এসএমই বা কুটিরশিল্প নির্মাণ করে দেওয়া হলে একদিকে যেমন কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হবে, অন্যদিকে বাণিজ্যিক প্লট বরাদ্দের মাধ্যমে নির্মাণকাজের আংশিক ব্যয় উঠে আসবে।
এ ছাড়া সাশ্রয়ী জমিতে সমবায় ভিত্তিতে চাষাবাদ করেও গৃহপ্রাপ্তদের কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। তাই কৃষি জমি রক্ষার স্বার্থে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার প্রস্তাবটি বিশেষভাবে বিবেচনা করতে পারে। প্রসঙ্গত দেশের আবাদযোগ্য কৃষি জমির পরিমাণ ৮৮ লাখ হেক্টর। জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে দেশব্যাপী গ্রামগঞ্জে এলোপাতাড়ি বাড়ি ঘর, রাস্তাঘাট ইত্যাদি নির্মিত হচ্ছে এবং প্রতি বছর এক লাখ হেক্টর আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে। অব্যাহতভাবে শুধু কৃষি জমি সংকুচিত হচ্ছে না, বরং অপরিকল্পিত ও এলোপাতাড়ি বাড়িঘর, রাস্তা ইত্যাদি নির্মিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আগামীতে যেকোনো আধুনিক কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রেও বিশাল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। এখনই যদি জমির অপব্যবহার রোধকল্পে যথার্থ পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সমগ্র বাংলাদেশই শুধু বাড়িঘরে পূর্ণ হবে, থাকবে না কোনো আবাদযোগ্য কৃষিজমি। আগামীতে সৃষ্টি হতে পারে চরম খাদ্য সংকট; যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে। সংশ্লিষ্ট মহল বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিলে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ ও গৃহহীনদের জন্য আশ্রয়ণ কর্মসূচি সফল হবে। চলমান আশ্রয়ণ প্রকল্পের সাফল্য ও সুপরিকল্পিত জনপদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আইডিইবির প্রস্তাবগুলোতে বিবেচিত হবে- মুজিববর্ষে জাতি সেটাই প্রত্যাশা করে।
প্রশ্ন হচ্ছে- এই আশ্রয়ণ প্রকল্প বা ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ কার্যক্রম তত্ত্বাবধায়ন বা নির্মাণ করবে কে বা কারা? শুধু আশ্রয়ণ প্রকল্প বা ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ কার্যক্রমই নয় দেশের সর্বত্র পরিকল্পিত গৃহায়ন ব্যবস্থা গড়ে তোলার সামগ্রিক পরিকল্পনা ও জনগণকে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে টাইপ নকশা-ডিজাইন সরবরাহ করাসহ জনগণের গৃহবিষয়ক সব নির্মাণকাজে সহায়তার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করেছিলেন। অত্যন্ত স্বল্প পরিসরের কাজ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ঢাকায় অবস্থান করছে। তাই আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ ‘গ্রাম হবে শহর’ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব প্রদান করা উচিত। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সামগ্রিক কার্যক্রমকে দুই ভাগে বিভক্ত করে একটি অংশকে সব গ্রামীণ ও অপর ক্ষুদ্র অংশটিকে শহরের আবাসন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের শহর ভিত্তিক কার্যক্রম সীমিত করে (কারণ দেশের প্রায় সব শহরের উন্নয়নে একাধিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে) প্রতিষ্ঠানটির সামগ্রিক কার্যক্রম গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে বিস্তৃত করা মঙ্গলকর হতে পারে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা পর্যায়ে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের উপ-সহকারী প্রকৌশলী দপ্তর বা উপসহকারী স্থপতির দপ্তর প্রতিষ্ঠা করে এ পর্যায়ের কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে এত জনবল একত্রে নিয়োগ দেওয়া না গেলেও অর্ধেক উপজেলায় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের জনবল প্রেরণ করে এবং বাকি অর্ধেক উপজেলায় কর্মরত জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, এলজিইডি, বায়োগ্যাস, পিআইও, কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের উপ-সহকারী প্রকৌশলীদের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নিয়মনীতি অনুযায়ী গ্রামীণ গৃহায়ন কার্যক্রম শুরু করার জন্য সরকারি নির্দেশনা জারি করা যেতে পারে।
পরিকল্পিত গ্রাম গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত নকশা অনুযায়ী ঘরবাড়ি নির্মাণে জনসাধারণকে উৎসাহিতকরণে ঘরবাড়ি নিবন্ধন কার্যক্রম প্রচলন এবং নিবন্ধিত ঘরবাড়ি নির্মাণে স্বল্প সুদে সম্পূর্ণ বা আংশিক গৃহ ঋণ প্রদান করা যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে ঘরবাড়ি নির্মাণে আবাদি জমির ব্যবহার হ্রাসকল্পে গ্রামীণ জনপদে সমবায় ভিত্তিতে অথবা পারিবারিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহুতল ভবন নির্মাণে আগ্রহীদের সরকারিভাবে ঋণ সহায়তা দিয়ে উৎসাহিত করা যেতে পারে। এতে একটি গ্রামের সব মানুষকেই দুই-তিনটি বহুতল ভবনে বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া সম্ভব হবে। আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ তথা দেশের প্রতিটি মানুষকে আবাসন সুবিধা প্রদানের বিশাল কার্যক্রম বাস্তবায়নে যত শিগগিরই সম্ভব গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে প্রথমে গৃহায়ন বিভাগ এবং পরবর্তী সময়ে গৃহায়ন মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। দেশের জনগণের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার আবাসন নিশ্চিতকল্পে পরিকল্পিত গ্রামীণ জনপদ গড়ার বিশাল কর্মযজ্ঞ এই স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই পরিচালিত হবে। সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার কারণেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও সভাপতি
ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স
বাংলাদেশ (আইডিইবি)
"