মো. তোফায়েল আহমেদ

  ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১

জিজ্ঞাসা

ট্রাফিক জ্যামের শেষ কোথায়

এ যেন এক ট্রাফিক জ্যামের শহর। বিশাল জনগোষ্ঠীর এই শহরে যানজটের ফলে জনজীবন যেমন অতিষ্ঠ ঠিক তেমনি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। ঢাকা শহরের যানজট নিয়ে বিস্তর আলোচনা প্রতিনিয়ত আমাদের চোখে পড়ে। যানজট নিরসনে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও টেকসইভাবে নগরবাসী এখনো কোনো সুবিধার সম্মুখীন হতে পারেনি। একটি আধুনিক নগরীতে মোট আয়তনের ২০ থেকে ২৫ ভাগ রাস্তা বা সড়ক থাকা দরকার। কিন্তু ঢাকায় রয়েছে মাত্র সাত থেকে আট ভাগ যা প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র এক-তৃতীয়াংশ।

অন্যদিকে ট্রাফিক বিভাগের পাওয়া তথ্য মতে, সেই সড়কের কম করে হলেও ৩০ ভাগ বা তারও বেশি দখল করেছে অবৈধ পার্কিং এবং এর সঙ্গে রয়েছে নানা ধরনের দখলদারিত্ব। অন্যদিকে স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানের (এসটিপি) হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় কমবেশি ১৫ ভাগ যাত্রী প্রাইভেট গাড়িতে যাতায়াত করেন। এই প্রাইভেট কারের দখলে থাকে ৭০ ভাগেরও বেশি রাস্তা। বাকি ৮৫ ভাগ যাত্রী অন্য কোনো ধরনের গণপরিবহন ব্যবহার করেন। অর্থাৎ তারা গণপরিবহন সড়কের মাত্র ৩০ ভাগ এলাকা ব্যবহারের সুযোগ পান। তা ছাড়াও অফিস ও এবং ব্যবসা বাণিজ্য চলাকালীন ৮০ ভাগ গাড়ি রাস্তায় যততত্র পার্কিং করার ফলে যানজট দ্বিগুণ মাত্রায় বেড়ে যায়।

শহরের মধ্য দিয়ে লেভেল ক্রসিং এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ ১৭টিরও বেশি পয়েন্টে দিনে কমপক্ষে ১০ বার যানচলাচল বন্ধ রাখা হয়। শহরের একই রাস্তায় বাস, মিনিবাস, রিকশা, ভ্যান ইত্যাদি চলাচলের ফলে দ্রুতগামী যানবাহনের গতি হ্রাস পায়। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে যানবাহন ও পথচারী কেউই আইন মানে না। সুযোগ পেলেই ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে। রং সাইড দিয়ে যানবাহন, ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, ফুটপাত দিয়ে যানবাহন চালান ঢাকার একটি পরিচিত চিত্র। সড়কের মাঝেই যানবাহনের যুদ্ধ লেগে যায় কার আগে কে যাবে এই নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমে যায় বাসচালকরা। তাদের লক্ষ্য যেভাবেই হোক আগে যেতে হবে। শহরে যথেষ্ট ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও পথচারীরা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে সড়কের মাঝে দিয়ে রাস্তা পারাপার হয়ে যানবাহনের গতি কমিয়ে দেয়। যানজট ঢাকাবাসীর জীবনের গতিই শুধু শ্লথ করেনি। অর্থনৈতিকভাবে বছরে ৪৩ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা কর্ম ঘণ্টা নষ্ট করেছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটে যার ফলে স্বাস্থ্য খাতে ২১ হাজার ৯১৮ কোটি টাকার ক্ষতি। সব মিলিয়ে বছরে যানজটের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৯৭ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা।

ঢাকাবাসীর ভোগান্তি কমাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগ নেন মেট্রোরেল চালু করার। নগরবাসীর আশা ২০২২ সালের মধ্য সম্পূর্ণ কাজ শেষ হলে রাজধানীর যোগাযোগে বিরাট ভূমিকা রাখবে। মেট্রোরেল যানজট নিরসনে অনেকাংশে ভূমিকা রাখলেও তার পাশাপাশি আমাদের আরো দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত। বস্তুত রাজধানীর মেট্রোরেল সব রুট চালু না হলে রাজধানীর যানজট বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে না, এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। উত্তরা থেকে মতিঝিল রুটের মেট্রোরেল চালু হলে এর মাধ্যমে রাজধানীর পূর্ব ও পশ্চিম এলাকার মানুষ সেভাবে উপকৃত হবে না।

যানজট নিরসনে টেকসই উন্নয়নে সরকারের নীতি নির্ধারক, বিআরটিএ, ঢাকা নগর পরিষদ, বিদ্যুৎ সঞ্চালন কোম্পানি, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, সব মালিক ও শ্রমিক সমিতিগুলোর যুগপৎ সমন্বিত হারকুলিয়ান প্রচেষ্টা থাকা দরকার। যৌথ নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে ঢাকার দুই নগর পিতাকেই, ফুটপাত চলাচল যোগ্য করতে হবে পাশাপাশি পথচারীদের সড়কের নির্দিষ্ট পয়েন্টে ও ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে বা ওভারব্রিজ ব্যবহার করে রাস্তা অতিক্রম করতে বাধ্য করতে হবে। টেম্পু, লেগুনা টাইপের গাড়ি চলায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাসরুটে মিনিবাস সার্ভিস রিকশাগুলোর প্রধান সড়কে চলাচল বন্ধ করতে হবে। প্রধান সড়কগুলোতে পার্কিং নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি সড়কের ফুটপাত সিসিটিভির আওতায় এনে অবৈধ পার্কিং রেকর্ড করে ও জরিমানা আদায় করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশকে ট্রাফিক বিধি অমান্য/ভঙ্গকারীদের আইনি প্রক্রিয়ায় আনার কাজে আরো কঠোর হতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো সড়ক হতে অপসারণের কাজটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুলিশকে করতে দিতে হবে। স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ঢাকার চারপাশ ঘিরে যে নদী রয়েছে, তা ব্যবহার করা হলে রাস্তার ওপর চাপ কমবে। এই জলপথে যদি ওয়াটার লঞ্চ সার্ভিস কার্যকর করা যায়, তাহলে নগরবাসীর বড় একটি অংশ এটা ব্যবহার করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারবে। ঢাকা শহরে কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা, ভালো স্কুল ও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার আকর্ষণে জন আগমন ঘটে। মধ্য মেয়াদে মফস্বলে, বিশেষ করে প্রতি ইউনিয়নে, মডেল স্কুল ও উন্নত চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে বাজেটবরাদ্দ সুপ্রতুল করতে হবে। বিশেষ করে প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা কমানোর ওপর জোর দিতে হবে। প্রত্যেক ব্যাংক এবং কোম্পানিতে কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগতভাবে গাড়ি না দিয়ে বড় কোচ দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। ঢাকার সব বিদ্যালয়কে বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিষ্ঠানকে বাসের অথবা বড় কোচের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে।

বাহনের সংখ্যা কমানোর লক্ষ্যে ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমানোর উদ্দেশ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া নদী পথের দিকে নজর বাড়াতে হবে। ঢাকা শহরে যে পরিমাণ জলাভূমি আছে, তা আরো বাড়িয়ে নৌ-যোগাযোগের দিকে মনোযোগী হওয়া দরকার। বর্ধিত জলাভূমি শহরের সড়কপথের জলাবদ্ধতা দূর করতে ও সৌন্দর্যবর্ধনেও সহায়তা করবে বলেই অনেকের বিশ্বাস।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close