মোহাম্মদ আবু নোমান

  ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১

মুক্তমত

দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্তৃপক্ষ ও লোভী গ্রাহক

ইভ্যালি কি এক দিনে তৈরি হয়েছে? মন্ত্রী থেকে আমলা, সেলিব্রিটি থেকে খেলাধুলা, টিভি চ্যানেল থেকে পত্রিকার পাতা, কারা ছিল না সঙ্গে। দুই দিন আগেও বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের স্পন্সর ছিল ইভ্যালি। আমাদের ক্রিকেটাররা ইভ্যালি লেখা জার্সি গায়ে জড়িয়ে যখন মাঠে নামেন, তখন সাধারণ মানুষের কাছে কী বার্তা যায়। অথচ ইভ্যালি ছিল শুভংকরের ফাঁকি। অসম্ভবকে পাওয়ার দুর্নিবিত লোভের ফাঁদ। নতুন গ্রাহকদের ওপর দায় চাপিয়ে পুরোনো গ্রাহকদের আংশিক অর্থ ফেরত অথবা পণ্য ফেরত দিত অনলাইনে পণ্য সরবরাহকারী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি। দায় ট্রান্সফারের দুরভিসন্ধিমূলক অপকৌশল চালিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। প্রতারণার অভিযোগে এক গ্রাহকের করা মামলায় ই-কমার্স প্ল্যাটফরম ইভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে গত ১৬ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার তো করা হলো তাদের, এখন প্রতারিত হাজার হাজার বিনিয়োগকারী তাদের টাকা কবে, কীভাবে ফেরত পাবেন...; আদৌ পাবেন কি না- প্রশ্ন থেকেই যায়।

করোনা মহামারিতে অনেকেরই চাকরি চলে গেছে। রাইড শেয়ারিংয়ে চালানোর জন্য মোটরসাইকেল কিনতে অনেকেই ধার-দেনা করে টাকা দিয়েছিলেন ই-কমার্সে। পণ্য, টাকা কোনোটিই না পেয়ে পথে বসতে হয়েছে অনেককে। সংশ্লিষ্টদের চরম দায়িত্বহীনতার কারণে সাধারণ মানুষের জীবন, স্বপ্ন দুমড়ে-মুচড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। তাতে হয়তো সরকার বা প্রশাসনের কিছুই আসবে যাবে না। নানা ভঙ্গিতে বিজ্ঞাপনের অফারে ভাগ্যাহত মানুষ ‘সোনা’ ভেবে হাত দিয়ে জীবনের সব সম্বল দিয়ে পুঁজি খাঁটিয়ে এখন সব ‘ছাই’ হয়ে গেল! গত এক যুগ ধরে কতবার কতভাবে জনগণের টাকা লোপাট হলো..., ভাবতেও অবাক লাগে। এত কেলেঙ্কারি কি সরকারের অগোচরেই হয়ে গেল? প্রতিটি ক্ষেত্রেই তো আমরা দেখি প্রতারণা চূড়ান্ত হলে, জনগণ নিঃস্ব হলে, গ্রেপ্তারের ‘মহা-দক্ষতা’ দৃশ্যমান...! দিনশেষে গ্রাহকরা শুধু এভাবে ধরা খেতেই থাকবে। এবার হয়তো নতুন নামে আসবে সীভ্যালি...!

প্রতারকরা কেউই কিন্তু লুকিয়ে কিছুই করেনি। অতীতে বড় বড় আর্থিক কোনো কেলেঙ্কারিই লুকিয়ে হয়নি। আজকের ইভ্যালি রীতিমতো জাতীয় ক্রিকেট দলের এক্সক্লুসিভ স্পন্সর হয়ে মার্কেটিং করে গেছে। তাহলে বলতেই হবে ইভ্যালিকে টাকার বিনিময়ে প্রমোট করছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং নাটকের প্রযোজকরা। বাংলাদেশের কতিপয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরুই করে ভেজাল, দুই নাম্বারি ও ধান্দাবাজির বাসনা নিয়ে। অনেকেই কয়েক মাস বা বছরের মধ্যে ধান্দাবাজি, দুই নাম্বারি করে কোটিপতি হতে চায়। বিপরীতে সাধারণ জনগণও কেনো লোভ সামলাতে পারে না। ১০ টাকায় ২০ টাকা পাব বলে লগ্নি করছি। সোজা কথায় জুয়া খেলছি। ইভ্যালির বিভিন্ন লোভনীয় অফারগুলো ছিল- সাইক্লোন অফার (বাজার মূল্যের অর্ধেক মূল্যে পণ্য বিক্রয়); ক্যাশব্যাক অফার (মূল্যের ৫০-১৫০ ভাগ ক্যাশব্যাক অফার); আর্দ্রকুয়েক অফার, প্রায়োরিটি স্টোর, ক্যাশ অন ডেলিভারি। এ ছাড়া বিভিন্ন উৎসবেও ছিল জমজমাট অফার, যেমন- বৈশাখী, ঈদ অফার ইত্যাদি। পরিণতিতে ইভ্যালির সাইক্লোন অফারের গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা বাতাসে উড়ে গেল।

লোভনীয় নানা রকম ডিসকাউন্ট কিংবা ক্যাশব্যাকের অফার দিয়ে দ্রুত ক্রেতা টেনেছে ইভ্যালি। লোভে পড়ে ক্রেতারাও হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন তাদের পণ্য কেনার অর্ডার দিতে। আর এ সুযোগটিই নিয়েছে চতুর রাসেল। শুরুতে দু-একটি অর্ডার দ্রুত ডেলিভারি দিয়ে ক্রেতার আস্থা অর্জন করে কিন্তু পরবর্তী সময়ে শুরু হয় প্রতারণা। লোভে পড়ে একেকজন গ্রাহক কেউ ২০ হাজার, ৫০ হাজার, এক লাখ, পাঁচ লাখ কিংবা ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন। অন্যদিকে যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য নেওয়া হতো ক্রেতা দেওয়ার জন্য সেসব মার্চেন্ট প্রতিষ্ঠানেরও টাকা শোধ করেনি রাসেল। এভাবে এক রকম ‘মাছের তেলে মাছ ভেজে’ শত শত কোটি টাকা লুটেছে প্রতিষ্ঠানটি।

কোনো কোম্পানি বা উদ্যোক্তা প্রচারের উদ্দেশে নিজের উৎপাদিত পণ্য ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ অথবা যত খুশি ডিসকাউন্ট দিতে পারে। কিন্তু কোনো পণ্য উৎপাদিত না করেও কী করে সম্ভব ১০০ থেকে ১৫০ ভাগ ক্যাশ ব্যাক অফার? আসলেই কি দ্বিগুণ লাভ দেওয়া সম্ভব? এক্ষেত্রে গ্রাহককেও ভাবতে হবে এখানে নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা আছে। মানুষের মধ্যে আবেগ থাকাটা স্বাভাবিক কিন্তু আবেগটার সঙ্গে বাস্তবিক চিন্তাটাও করতে হবে। ইভ্যালির ডিসকাউন্ট অফারে নাক-কান বন্ধ করে প্রোডাক্ট কিনতে পেরে খুশিতে আটখানা হয়েছেন অনেকেই। চার লাখ টাকার পণ্য আড়াই-তিন লাখ টাকায় দেওয়া সম্ভব- এসব অফারের প্রচারেও খরচ হয়েছে কোটি টাকা। এরপরও চার লাখ টাকার প্রোডাক্ট দুই লাখ টাকায় কীভাবে দেওয়া সম্ভব? কোনো যুক্তি দেখিয়ে বোঝানো যাবে কি? একমাত্র উপায়, হাওয়া হয়ে যাওয়া। আর হয়েছেও তাই।

বাংলাদেশে ই-কমার্সের কার্যক্রম যেভাবে ধোঁকা ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে গেছে, তাতে অতি শিগগিরই বিদেশি প্রতিষ্ঠান এই সুযোগ নিয়ে নেবে। মূল্য ছাড়ের লোভনীয় অফারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কিছু মানুষ। ১০০ টাকার পণ্য ৯০ টাকায় কেনা যায় কিন্তু ৬০ টাকায় কেনা যাবে না। সর্বসাধারণের বুঝতে হবে এখানে নিশ্চয় কোনো ফাঁকফোকর ও ঝামেলা আছে। যেখানে কম পরিশ্রমে লাভ বেশি সেখানেই ভেজাল বেশি। এটা সাধারণ জ্ঞানের বিষয়। অতীতে ইসলামিক ট্রেড এ কমার্স লিমিটেড (আইটিসিএল), যুবক ও ডেসটিনিসহ বিভিন্ন এমএলএ প্রতিষ্ঠান সেবা ও ব্যবসার নামে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে এসেছে। কিন্তু অতীত ঘটনা থেকে আমরা কোনোভাবেই শিক্ষাগ্রহণ করিনি বরং অস্বাভাবিক, চমকপ্রদ ও লোভনীয় অফারে বারবারই প্রলুব্ধ হয়েছি।

ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জ মূলত জুয়াড়ি প্রতিষ্ঠান। কিছু পাবলিককে লোভ দেখিয়ে লসে ডিসকাউন্ট দিয়ে মাল সময়মতো ডেলিভারির কথা বলে লাখ লাখ গ্রাহক থেকে টাকা ক্যাশ করে ফেলত। ওখান থেকে লসে ২-৩ অংশ গ্রাহককে বিশাল ছাড়ে মাল ডেলিভারি দিত। বাকিরা অর্ডারের প্রোডাক্টের আশায় মাসের পর মাস দিন গুনত। এটা কোনো অবস্থায় ই-কমার্সের ব্যবসা হতে পারে না। ক্রয়-বিক্রয় বলতে আমরা জানি আগে পণ্য তারপর টাকা। আর বিশ্বব্যাপী ই-কমার্সের টার্মস অব কন্ডিশন রয়েছে পণ্য প্রাপকের কাছে পৌঁছার পর পেমেন্ট। অথচ বাংলাদেশের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রতারণা ব্যবসা এ দেশে বড় জাঁকজমক হয়ে থাকে রাজনৈতিক নেতাদের দেখভাল ও সেলিব্রেটিদের কারণে। ডেসটিনি, যুবক, নিউওয়ে, এহসান গ্রুপ, ইউনিপেটু, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জকে অনেক আগেই থামিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল। আইনের তোয়াক্কা না করে অথবা ম্যানেজ করে ওরা নিজের আখের গুছিয়েছে। এখন লাখ লাখ মানুষ তাদের কষ্টের টাকা কীভাবে ফেরত পাবেন- এ দায় কি শুধুই রাসেলের? যেসব সেলিব্রিটি বিশাল অর্থের বিনিময়ে ইভ্যালি, এহেসান গ্রুপ, আর ই-অরেঞ্জের মতো বাটপারি ই-কমার্স ব্যবসার অ্যাম্বাসেডর হয়ে তাদের প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে কন্ট্রিবিউট করেছেন তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনা হোক। কারণ তারা এই নষ্ট সিস্টেমের অন্যতম সহযোগী। তারা তাদের নিজস্ব জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে এসব ব্যবসার মার্কেট সৃষ্টিতে কাজ করেছেন। যা দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে নিঃসন্দেহে প্রতারণা। আমরা মনে করি, ভবিষ্যতে কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হতে সেলিব্রিটিরা ১০ বার ভাবতে হবে।

ই-কমার্সগুলো এই দেশে লুকিয়ে লুকিয়ে বিজনেস করেনি। তারা ঢাক ঢোল পিটিয়ে সব মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজেদের প্রচার করেছে। ক্রিকেট দলের স্পন্সর হয়েছে। ঢাকার প্রতিটি পুলিশ বুথ ইভ্যালির বিজ্ঞাপনে ঢেকে গিয়েছিল। মন্ত্রী-এমপিরা বিভিন্ন সময় তাদের পক্ষে কথা বলেছে। দোষ কি শুধু সাধারণ মানুষের? সাধারণ গ্রাহক সরকারের নিবন্ধিত ই-কমার্স থেকে পণ্য ক্রয় করেছে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ ক্রেতা ভুক্তভোগী হলে সরকারও এই দায় এড়াতে পারে না। এদের মনিটরিং করার দায়িত্ব কিন্তু সরকারের। গত বছর ইভ্যালির ব্যাংক একাউন্ট এক মাসের জন্য জব্দ করে দেওয়া হলো। সরকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এক মাস পর আবার অ্যাকাউন্ট ওপেন করে দিল। এতে প্রমাণিত হয় ইভ্যালির মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। এর মাধ্যমে আল্টিমেটলি সরকার ইভ্যালিকে গ্রিন সার্টিফিকেট দিয়ে দিল। আলেশা মার্ট নামে আরেক ই-কমার্সের উদ্বোধন করলেন মন্ত্রী। মন্ত্রীর এ ছবি আলেশা মার্ট ফলাও করে প্রচার করেছে। মানুষের থেকে টাকা কালেকশন করেছে। তারাও এখন ডেলিভারি দিতে পারছে না। এখানে কি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর দায় নেই? সাধারণ মানুষের কি সাধ্য আছে এত বড় কোম্পানির ভেতরে ঢুকে খোঁজ-খবর নেওয়ার?

‘ডাবল ভাউচার’ অফার দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেয় ই-অরেঞ্জ। অফারের ভাষ্য ছিল, কেউ এক লাখ টাকা জমা দিলে দুই লাখ টাকার ভাউচার পাবেন। ওই ভাউচার দিয়ে আমানতকারী প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে পণ্য কিনতে পারবেন। কিন্তু দ্বিগুণ অর্থের পণ্য কেনা তো দূরের কথা বরং মূল অর্থেই গ্রাহকরা পণ্য বুঝে পাচ্ছেন না। বর্তমানে পৃথিবীটিতে অনলাইন শপিং একটি দারুণ কম্পিটিশন মার্কেট। কোনো কোম্পানি কত দ্রুত প্রোডাক্ট ডেলিভারি ও সেবা দিবে এ প্রতিযোগিতা। বিশ্বে অনলাইন ব্যবসায়ীরা সততা, আস্থা, স্বচ্ছতা ও দ্রুত হস্তান্তরের কম্পিটিশন করে। আর আমরা আছি চুরি আর ফাঁদের কম্পিটিশন নিয়ে। বিশ্বে এমন কোনো ই-কমার্স কোম্পানি আছে যারা দুই মাস বা ছয় মাসে পণ্য ডেলিভারি দেয়? আবার কোনো কেনো ক্ষেত্রে বছর ফুরিয়ে গেলেও পণ্য ডেলিভারি দিতে অপরাগ। তা ছাড়া এমন কোথাও আছে কী, যারা নতুনদের টাকায় পুরোনোদের পণ্য দেয়? আমরা আশা করছি গ্রাহকদের স্বার্থে দেশের সর্বোচ্চ আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে ডেসটিনি, যুবক, নিউওয়ে, এহসান গ্রুপ, ইউনিপেটু, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ ধান্দা ও ধোঁকাবাজ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে। এই মুহূর্তে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ খোয়ানো সাধারণ গ্রাহকদের বাঁচানোর একমাত্র অক্সিজেন হলো হাইকোর্ট। গ্রেপ্তার কোনো সমাধান নয়, গ্রাহক কীভাবে তার লগ্নি করা টাকা ফেরত পাবে সরকারকেই সে ব্যবস্থাই নিতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

www.nobosongbad.com

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close