আবদুর রউফ

  ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

পর্যালোচনা

অসামাজিকতার দায় ও তার প্রতিকার

মানুষ সামাজিক জীব। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে অভ্যস্ত। সমাজ ছাড়া যেমন মানুষ কল্পনা করা যায় না, তেমনি মানুষ ছাড়া সমাজের অস্তিত্ব অকল্পনীয়। তাই বলা হয়ে থাকে সমাজ ছাড়া মানুষ হয় পশু, নয় তো দেবতা। কারণ মানুষের সব আশা-আকাক্সক্ষা সমাজকে ঘিরে আবর্তিত হয়। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, মানুষ প্রকৃতিকভাবেই প্রথমত পারিবারিক, দ্বিতীয়ত সামাজিক ও তৃতীয়ত রাজনৈতিক জীব। তাই প্রতিটি মানুষের জীবনে সমাজের গুরুত্ব অপরিসীম। এই সমাজে মানুষ জন্মগ্রহণ করে বেড়ে ওঠে ও মৃত্যুবরণ করে। এই সমাজকে ঘিরেই আবর্তিত হয় মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনযাপনের যাবতীয় কার্যকলাপ। তাই সহজ ভাষায় বলা যায় সমাজ হচ্ছে এমন একটি উপাদান যেখানে বিভিন্ন চরিত্রের মানুষ একত্রে বসবাস করে। তারা নিজেদের প্রয়োজনে লিখিত বা অলিখিত কিছু নিয়মনীতি মধ্য দিয়ে সমাজে বসবাস করে। এই পরিবর্তনশীল সমাজের একাধিক চরিত্রের মানুষ বসবাস করার কারণে কিছু সামাজিক পরিবর্তন ঘটে। আজ থেকে কয়েকশ বছর আগেও মানুষের মধ্যে যে সামাজিক মূল্যবোধ, সহমর্মিতা, ভাতৃত্ববোধ ও সহযোগী মনোভাব ছিল তা এই আধুনিক সমাজে এসে প্রায় বিলুপ্তির পথে। প্রতিনিয়ত আমাদের সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে চলছে। কিছুদিন আগেও এই সমাজে যে সামাজিকতায় পরিপূর্ণ ছিল আজকে সেখানে অসামাজিকতা ভরে গেছে। প্রতিনিয়ত পত্রিকার পাতা বা টেলিভিশনের পর্দায় বর্তমান সমাজের অবক্ষয়, অস্থিরতা ও অসামাজিকতা চিত্র ফুটে উঠেছে।

মানব সমাজের ইতিহাস পরিবর্তনশীল। পৃথিবীর কোনো সমাজ স্থির নয় বরং গতিশীল। সব সামাজিক পরিবর্তনের গতি আবার এক রূপ নয়। স্থান-কাল ভেদে এই পরিবর্তন নানাভাবে হয়ে থাকে। যেমন আদিম সমাজ থেকে বর্তমান উন্নত সমাজে পরিবর্তনের গতিতে রয়েছে ব্যাপক ব্যবধান। যদিও পরিবর্তনশীলতাই হচ্ছে প্রতিটি সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দীর্ঘদিন ধরে পর্যায়ক্রমে এই পৃথিবীর সামজিক পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ করে মানুষ যখন একটি অর্থনীতি ব্যবস্থা থেকে অন্য একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করেছে তখনই সামাজিক পরিবর্তন বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। তাদের রীতিনীতি, সামাজিক আচরণ, চিন্তা ধারা ও জীবন ধারা এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তাই সহজ ভাষায় বলা যায় একটি সামাজিক রূপ থেকে অন্য একটি রূপ ধারণ করাকে সামাজিক পরিবর্তন বলা হয়। এই সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে অন্যতম সমাজে অসামাজিকতা বৃদ্ধি। সমাজে অসামাজিকতা বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে নানা কারণ। তথাকথিত আধুনিকতার নামে আমাদের সামাজিক রীতিনীতি ও মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে যেতে বসেছে। একটি সময় ছিল যখন একজন মানুষ বিপদে পড়লে তার পাশে এসে সম্মিলিতভাবে দাঁড়াত। আর এখন কেউ যদি বিপদে পড়ে তাহলে আমাদের তরুণ প্রজন্ম মোবাইল ফোনে একটি ছবি ধারণ করে সেখান থেকে সরে পড়ে। অন্যের বিপদে গিয়ে আসা এখন আমরা ঝামেলা মনে করি। একটি সময় অন্যের বিপদে সহযোগিতা করা ছিল একটি সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। বর্তমান সমাজে এই সহযোগী মনোভাব প্রায় অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমান প্রান্তিক অঞ্চল পর্যায়ে এমন কিছু অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে যে অপরাধগুলোর সঙ্গে গ্রামের সহজ সরল মানুষ পরিচিত ছিল না। তাই বলা যায় শহরের অপরাধগুলো অনেকাংশেই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সংগঠিত হচ্ছে। এটি সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম একটি উদাহরণ।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে পরিবার, পরিবেশ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা অনেকাংশেই দায়ী। আমরা বর্তমান যে ধরনের সমাজ ব্যবস্থায় বিদ্যমান রয়েছি তা দিনে দিনে আরো অবনতির পথেই হাঁটছে। আধুনিকতার নামে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার বিষবাষ্প। সেই স্রোতে বর্তমান প্রজন্ম অবলীলায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেন অভিভাবকরা নির্বিকার। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সন্তানদের এরকম উচ্ছৃঙ্খল জীবনাচরণের পেছনে অভিভাবকরা দায়ী। অনেক অভিভাবক সন্তানদের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে গর্ববোধ করেন। সেই সন্তান কোনো অন্যায় করলে অপরাধের শাস্তি না দিয়ে বাহবা দেওয়া হয়। ফলে কোনো এক দিন সেই উচ্ছৃঙ্খল সন্তানের হাতে বাবা-মাকে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়। এমন ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ইং তারিখে রাজশাহী নগরীর রাজপাড়া থানার অচিনতলা এলাকায় নিজ সন্তানের হাতে জুয়েল হোসেন (৫০) নামের বাবা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। তার ছেলে মুমিনুল ইসলাম পিয়াস মাত্র ১৭ বছরে নানা ধরনের মাদকদ্রব্যের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। প্রতিনিয়ত মাদকের টাকার জন্য বাবা-মাকে প্রায়ই অত্যাচার করত। ওইদিন মাদকের টাকা না পেয়ে নিজ বাবাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। এই ঘটনাটি একবার গভীরভাবে পর্যালোচনা করলেই বুঝতে পারবেন বর্তমান প্রজন্ম কতটা বিপথে চলে গেছে। এরকম ঘটনা বাংলাদেশ হরহামেশাই ঘটছে। আমাদের চোখের সামনে সন্তানদের আচার-আচরণ দ্রুতগতিতে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। অথচ এই পরিবর্তন আমাদের চোখের সামনেই হচ্ছে। আজকে বিভিন্ন জায়গায় যারা মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে ও বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত করছে তারা আমাদের সমাজের। আমাদেরই কারো সন্তান, না হয় ভাই অথবা পাড়া-প্রতিবেশী। একজন সন্তান যখন মাদক বা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে অবশ্যই সেটি পরিবারের নজরে আসছে। তবে সঠিক সময়ের সন্তানের সেই অপরাধগুলোর বিশেষ ব্যবস্থা না নেওয়ায় সমাজে অসামাজিকতা বেড়েই চলছে। সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, অপরাধীদের অপরাধ সংগঠিত করার পরে যথাযোগ্য স্বার্থের মুখোমুখি না করায় সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকেই অপরাধ করে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যাচ্ছে। যে কারণে নতুন প্রজন্মের মাঝে অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলছে। এটি একটি সমাজ ব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত বটে।

বর্তমান সমাজে অসামাজিকতা বৃদ্ধির পেছনে সমাজ বিজ্ঞানীরা কিছু কারণ দাঁড় করেছে। যেমন- মৌলিক ও মানবিক চাহিদা অপূরণ, সম্পদের অসম বণ্টন, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বেকারত্ব ও দরিদ্রতা, সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব, সুশিক্ষার অভাব, রাজনৈতিক প্রতি হিংসা ও অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক চক্রের কুটকৌশল, ভিনদেশি অপসংস্কৃতি প্রভাব, সামাজিক কুসংস্কার, সম্পদের অপব্যবহার, পারিবারিক অশান্তি ইত্যাদি। এর প্রতিটি কারণ বর্তমান সমাজে বিদ্যমান। বিশেষ করে ভিলেজ পলিটিক্সের প্রভাবে সামাজিক বন্ধন নেই বললেই চলে। বর্তমান সমাজে মানুষের মধ্যে বিভক্তি এত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে যে, একে অপরের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। সমাজের ভালো মানুষগুলো একলা চলো নীতিতে চলছে। অথচ অপরাধীরা সংঘবদ্ধভাবে অপরাধ সংঘটিত করেই চলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের সমাজের ভালো মানুষের অসামাজিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। সামাজিক অপরাধ রুখতে পরিবারের অভিভাবক ও সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠদের এগিয়ে আসতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্র রয়েছে যেগুলোতে কঠোর আইন প্রয়োগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে উচ্ছৃঙ্খল নেশাগ্রস্ত সন্তানদের যখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না তখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হতে হবে। কোনোভাবেই সন্তানের ছোট ছোট অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। পারিবারিক অনুশাসন, সামাজিক রীতিনীতি ও ধর্মীয় শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে অসামাজিকতা বৃদ্ধির পেছনে দায় যেমন আমাদের পরিবার ও রাষ্ট্রের। তেমনিভাবে তার প্রতিকারের জন্য পরিবারও রাষ্ট্রকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সচেতন জনসমাজকে সামাজিক দায়বদ্ধতা জায়গা থেকে দৃশ্যমান সব ধরনের অপরাধকে রুখে দিতে হবে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সম্প্রীতি, ভালোবাসা, সহমর্মিতা, পরমতসহিষ্ণুতার বাণী ছড়িয়ে দিতে হবে।

যুব সমাজের অধিকাংশের মধ্যেই অতিচঞ্চলতা কাজ করে। মন্দ জিনিসের প্রতি প্রবল আকর্ষণ থাকে। সেইসঙ্গে তরুণ প্রজন্মের লাগামহীন প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েই চলছে। প্রযুক্তির অপব্যবহারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর সামাজিক নেই। ভার্চুয়াল জগতেও সংঘটিত হচ্ছে নানা ধরনের অপরাধ। তাই তা প্রতিকারে পারিবারিক, সামাজিক রাষ্ট্রীয়ভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেসব কারণে সমাজে অসামাজিকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাদের মৌলিক অধিকার, কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও জৈবিক চাহিদাসহ অন্যান্য বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে হবে। ভিনদেশি অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ রুখে দিতে হবে। আমাদের নিজস্ব শিল্পসাহিত্য সামাজিক কৃষ্টি-কালচার সন্তানদের শিক্ষা দিতে হবে। আমরা চাই এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা যেখানে কোনো সামাজিক অস্থিরতা থাকবে না। কোনো রকম অসামাজিকতা থাকবে না। সমাজের প্রতিটি মানুষ তাদের মৌলিক অধিকারগুলো সঠিক মতো ভোগ করতে পারবে। সমাজে অসামাজিকতা দূরীকরণে আমরা সবাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করব এমনটিই প্রত্যাশা রইল।

লেখক : শিক্ষার্থী, আরবি ভাষা ও

সাহিত্য বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close