আসাদুল্লাহ আল-গালিব

  ০৬ আগস্ট, ২০২১

দৃষ্টিপাত

আমানতদারিতায় ইসলামি নির্দেশনা

আমানতদারিতা এমন এক মহৎ গুণ, যার ওপর জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধি নির্ভরশীল। যতগুলো গুণের অধিকারী হলে আল্লাহর কাছে প্রিয় বান্দা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া যায় তার মধ্যে এটি অন্যতম। লেনদেনে সততা, স্বচ্ছতা ও আমানতদারিতা রক্ষা করা ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষার অন্তর্গত। আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ আমানতদার। তার জাতি খুব অল্প বয়সেই তাকে ‘আল-আমিন’ তথা অতিবিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করে। তার সাহাবিরাও ছিলেন আমানতদারিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বকে তারা আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) রাষ্ট্রের অর্থ-সম্পদকে এক বিরাট আমানতরূপে গণ্য করতেন। হজরত উমর (রা.) অর্ধ পৃথিবীর খলিফা হয়েও তালি দেওয়া জামা পরিধান করতেন। তারা সবাই আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতাকে আমানত মনে করতেন। এ কারণেই নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে রাষ্ট্রের কল্যাণে তারা কাজ করেছেন।

আমানত শব্দটি আবরি। এর অর্থ বিশ্বস্ততা, নিরাপত্তা, গচ্ছিত রাখা, জমা রাখা ইত্যাদি। পরিভাষায় কারো কাছে কোনো অর্থ-সম্পদ, বস্তুসামগ্রী গচ্ছিত রাখাকে আমানত বলা হয়। যিনি গচ্ছিত বস্তুকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে সংরক্ষণ করেন, যথাযথভাবে হেফাজত করেন এবং মালিক চাওয়ামাত্রই কোনো টালবাহানা ছাড়া ফেরত দেন, তাকে আমানতদার বলা হয়। আমানত শুধু অর্থ-সম্পদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর বিষয়বস্তু ব্যাপক। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতসহ শরিয়তের সব ফরজ কাজ আমানতের পর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, সরকারি-বেসরকারি দাপ্তরি কাজকর্ম, শিক্ষকতা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দায়িত্ব, দিনমজুরি ইত্যাদি সবই আমানতের অন্তর্ভুক্ত।

আমানতদারিতা আল্লাহর কাছে খুবই পছন্দনীয় একটি গুণ। এই গুণের অধিকারী হলে, সেই ব্যক্তিকে পরকালে সফলতা দানের পাশাপাশি আল্লাহ দুনিয়ায়ও তাকে পরম মর্যাদায় ভূষিত করেন। নবীজিও এই গুণের অধিকারী হওয়ায় সর্বদা সম্মানিত হয়েছেন। নবুয়ত প্রাপ্তির কয়েক বছর আগের ঘটনা। কোরাইশরা নতুন করে কাবাঘর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময় কাবাঘরে হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে কুরাইশদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলো। কোরাইশদের গোত্রপ্রধান আবু উমাইয়া বিন মুগীরা বললেন, সবার আগে যে মসজিদের দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে সে-ই প্রথমে হাজরে আসওয়াদ ওঠাবে। আর সেসময় দরজা দিয়ে প্রথমে প্রবেশ করেছিলেন প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। সবাই দেখে একবাক্যে বলে উঠলেন, আমরা এই বিশ্বস্ত ব্যক্তি মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যস্থতায় তা নিরসন করতে চাই। (উমদাতুলকারী ৯/২১৭)

আমানত কাকে দেওয়া হবে, কে এর আসল হকদার সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়ে থাকে। এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য, তা বোঝাতে একটি ঘটনা উল্লেখ করো হলো। ইরাকের বাগদাদ শহরের এক জগদ্বিখ্যাত আল্লাহর ওলি হজরত সওবান (রা.)। যাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর আল্লাহ এক ছেলেসন্তান দান করেছিলেন। একবার বিশেষ কাজে হজরত সওবান (রা.) বাইরের শহরে গেলেন। দীর্ঘ চার-পাঁচ মাস পর উনি বাড়িতে আসেন। তার স্ত্রী খাওয়াদাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। খাওয়ার শেষে হঠাৎ স্ত্রী মাইমুনা (রা.) বলেন, অনুমতি দিলে একটি প্রশ্ন করতে পারি? হজরত সওবান (রা.) বললেন, জি। স্ত্রী বললেন, আচ্ছা মনে করুন কেউ একজন আমাদের কিছু দামি জিনিস আমানত রাখতে দিলেন, যত দিন মন চাইল রাখলেন, এরপর মূল্যবান সম্পদের মালিক তা আবার নিয়ে গেলেন নিজের কাছে। তাহলে তাতে কি আমাদের কষ্ট পাওয়া, কান্না করা বা মন খারাপ করা উচিত? হজরত সওবান (রা.) এমন আজব প্রশ্ন শুনে কিছুটা অবাক হয়ে উত্তর দিলেন, না। তিনি বললেন, কেন মন খারাপ করব আমরা? যিনি রাখতে দিয়েছেন তিনিই তো নিয়ে গেছেন। আসল মালিক তো আর আমরা না। সুতরাং মন খারাপ কান্নাকাটির কোনো দরকার আছে বলে তো মনে হয় না। এই উত্তর শুনে, মাইমুনা (রা.) বললেন, আমাদের আল্লাহপাক অনেক কষ্ট সাধনার পর যে সন্তানটি আমানত দিয়েছিলেন, আপনি বাইরে থাকা কালীন এক দুর্ঘটনাই সে আমানতকে আল্লাহ আবার নিয়ে নিয়েছেন। এই উত্তর শুনে হজরত সওবান (রা.) সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর দরবারে সিজদাই পড়ে বলতে লাগলেন, ‘আল্লাহ তোমার দেওয়া আমানতের যদি কোনো প্রকার সামান্যতম অবমূল্যায়ন আমাদের দ্বারা হয়ে থাকে, আমাদের ক্ষমা করে দাও। সর্বাবস্থায় তোমার খুশিতে নিজেদের খুশি রাখার সে তওফিক দান করো এবং মাইমুনাকে কবুল করে নাও, তাকে এই ধৈর্যের উত্তম প্রতিদান দান করো’- (তাজকিরাতুল আউলিয়া-সিরাতুল মুহিব্বিন : ৭২৯)।

আমানতের খিয়ানত তথা আমানত ভঙ্গ করা কবিরা গুনাহ এবং এটা মুনাফিকের পরিচায়ক। অপরদিকে আমানত রক্ষা করা ইমানদারের পরিচায়ক। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যার মধ্যে আমানতদারিতা নেই, তার ঈমান নেই, আর যে অঙ্গীকার রক্ষা করে না, তার দ্বীন নেই’ (বায়হাকি)। আমানতের হিফাজতকারী ব্যক্তি হাশরের ময়দানে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত হবেন। হাশরের ময়দানে উপস্থিত অন্যান্য লোক দুনিয়ায় আমানতের হিফাজতকারী ব্যক্তিদের দিকে তাকাতে থাকবে। একে অপরের কাছে আমানতকারী ব্যক্তিকে নিয়ে বলাবলি করতে থাকবে তারা কে, তারা তো আমাদের সঙ্গেই ছিল। আজ তারা আমাদের চেয়ে ভিন্ন স্থানে ও ভিন্ন মর্যাদার অধিকারী। হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘একজন সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী আখেরাতে নবী-সিদ্দিক এবং শহীদগণের সঙ্গে থাকবে’- (তিরমিজি : ৩/১২০৯)।

আমানতদারিতার সুফল আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে সামাজিক জীবন, এমনকি রাষ্ট্রীয় জীবনেও ব্যাপ্ত। আমানতদারিতা থাকলে প্রতিটি রাষ্ট্র সঠিকভাবে চলবে এবং সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে রাষ্ট্রের জনগণ। আমাদের জীবনটাও আল্লাহর পক্ষ থেকে এক প্রকার আমানত। এই জীবনে কে কত আমল করল, কে কত সুন্দরভাবে ইসলামি পদ্ধতিতে জীবন পরিচালনা করল এই বিষয়গুলো লক্ষ করে আল্লাহ আমাদের ব্যাপারে ফয়সালা দেবেন। একজন মুসলমান হিসেবে, শেষ নবীর উম্মত হিসেবে আমাদের সবার একান্ত নৈতিক দায়িত্ব হলো, কোরআন-সুন্নাহর আলোকে নিজেদের জীবন গঠন করা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমানতদারিতার চর্চা করা। আল্লাহ আমাদের তওফিক দান করুন।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close