মো. হাছিবুল বাসার
পর্যালোচনা
মুসলমানরাই অন্ধকারাচ্ছন্ন স্পেনের পথপ্রদর্শক
আধুনিক ইউরোপের দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর-তীরবর্তী মনোরম একটি দেশ স্পেন। দেশটির তিনদিকে জল ও একদিকে স্থল থাকায় এটি আইবেরীয় উপদ্বীপ নামেও পরিচিত। ফুটবল উন্মাদনা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যে ভরা দেশটি একসময় মুসলিম শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানে প্রায় ৮০০ বছর মুসলমানরা গৌরবোজ্জ্বল শাসন পরিচালনা করেছে। গোটা ইউরোপের অন্যান্য দেশ যখন অজ্ঞতা-বর্বরতায় নিমগ্ন; তখন মুসলমানরাই স্পেনে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সভ্যতা ও সংস্কৃতিচর্চার দ্বার উন্মোচন করে। ফলে অন্ধকারাচ্ছন্ন স্পেনে ইউরোপীয় রেনেসাঁর উন্মেষে মুসলমানরা যে অনবদ্য অবদান রেখেছে; তা বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়।
মুসলমানদের স্পেন বিজয়ের পূর্বে স্পেনের সামাজিক অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে ছিল। কারণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতি কর্তৃক দেশটি শাসিত হয়েছিল। বিশেষ করে গথদের ও রডারিকের দুঃশাসন দেশটির সার্বিক অবস্থাকে নাজুক করে দেয়। তখন পুরো স্পেনে অস্তিত্ব ছিল দুটি গোষ্ঠীর। একটি শাসক ও অন্যটি শোষিত শ্রেণি। শোষিত শ্রেণী সব নাগরিক সুবিধা থেকে ছিল বঞ্চিত। সাধারণ প্রজারাও দাস-দাসীর মতো থাকত। শোষিত শ্রেণির ভূমি চলে যেত অত্যাচারীদের হাতে। সমাজের ক্রীতদাস ও ভূমিদাসের অবস্থা ছিল জঘন্য। অনেক ক্রীতদাসকে মানবিক জীবনযাপনে বাধ্য করা হতো। ভূমি মালিক ও ধর্মযাজকদের অত্যাচার স্পেনের ভূমিকে নরকে পরিণত হয়। সাধারণ ভূমি পিশাচ একজন প্রভুর অধীনে প্রায় ৪০০০ থেকে ৮০০০ পর্যন্ত ক্রীতদাস থাকত। যাদের ছিল না কোনো ব্যক্তিস্বাধীনতা। বিয়ে করার অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। যদিও শোষিত শ্রেণির একটা অংশ মনিবের দয়াক্রমে বিয়ের অনুমতি পেত। কিন্তু তার পেছনেও ছিল শাসক শ্রেণির লাভ। কারণ দাসের সন্তানরাও চিরতরে গোলাম হিসেবে মনিবদের মাঝে ভাগ-বণ্টন হয়ে যেত। তাই অত্যাচারিত ও দাস জীবনের মুক্তি খুঁজতে অনেকে পালিয়ে যেত। পরবর্তীতে জড়িয়ে পড়ত দস্যুবৃত্তিতে। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, সরকারের নানা দুর্বলতা স্পেনের জনগণের অধিকার ও মর্যাদাবোধ প্রাপ্তি থেকে দূরে ঠেলে দেয়। তাছাড়া প্রাক-মুসলিম স্পেন যুগে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতা বলে কিছু ছিল না। ফলে সেখানের নাগরিকদের জোরপূর্বক ধর্মে দীক্ষিত করা হতো। ৬১৬ খ্রিস্টাব্দে ৯০ হাজার ইহুদিকে বলপূর্বক খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়।
স্পেনে মুসলমানদের আগমনের আগে সমগ্র ইউরোপ ছিল শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর, হীনম্মন্য জনপদ। জ্ঞান-বুদ্ধিতে ইউরোপবাসী ছিল পিছিয়ে পড়া আড়ষ্ট জাতি। তারা জ্ঞানার্জনকে নিচু চোখে দেখত। আর এই দাম্ভিকতা বহু শতাব্দীজুড়ে ইউরোপে জ্ঞানগর্ভ কোনো গ্রন্থ রচিত হতে দেয়নি। তাছাড়া সপ্তম শতকের পূর্বে গ্রিক এবং রোমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাও নিষিদ্ধ হয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন আন্দালুসিয়ায় গোলাকার পৃথিবীর ধারণায় কেউ বিশ্বাস করলে তাকে কঠোর শাস্তি পেতে হতো। এরূপ কারণে কুসংস্কারগ্রস্ত ইউরোপজুড়ে জ্ঞানচর্চায় বন্ধ্যত্বের সৃষ্টি হয়। আর সেসময়ে স্পেনের রাজা ছিল রডারিক। সিউটার গভর্নর কাউন্ট জুলিয়ান রাজদরবারের প্রথানুযায়ী তার কন্যা ফ্লোরিডাকে রাজকীয় নিয়মকানুন, শিষ্টাচার এবং ভদ্রতা শিক্ষার জন্য রডারিকের দরবারে প্রেরণ করেন। কিন্তু রাজা রডারিক ছিল নিকৃষ্ট চরিত্রের অধিকারী। ফলে রাজদরবারে তার কন্যা ফ্লোরিডা ধর্ষিত হন। এতে অপমানবোধ ও ক্রোধের আগুনে পুড়তে থাকেন কাউন্ট জুলিয়ান। এই চরম অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি মুসলমানদের শরণাপন্ন হন। তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। তবে তৎকালীন উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালিদের গভর্নর মুসা বিন নুসাইর (রহ.) প্রস্তাবে কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিলেন না। কারণ এটা ছিল তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু জুলিয়ান তাকে আখিরাতের দোহাই এবং মজলুম মেয়ের আর্তনাদের কথা স্মরণ করিয়ে সাহায্য চান। মজলুমের পক্ষ নিয়েই মুসা বিন নুসাইর (রহ.) খলিফা আল-ওয়ালিদের অনুমতিক্রমে ৩০০ আরব এবং ৭০০০ বার্বার সৈন্যের সমন্বয়ে একটি দল গঠন করেন; যা স্পেনের গথিক শাসক রডারিককে পরাজিত করতে সর্বদা প্রস্তুত ছিল। অতঃপর নুসাইর স্পেন অভিযানে দলটিকে প্রেরণ করেন। যার সৈন্যসংখ্যা পরবর্তীতে ১০৩০০ বা ১২০০০-এ উন্নীত হয়। তবে এ সংখ্যা ছিল রডারিকের সৈন্যসংখ্যা থেকে নিতান্ত কম। কারণ যুদ্ধের জন্য রডারিকের সৈন্য ছিল ১ লাখের ওপরে। ৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের ছোট বাহিনীর সঙ্গে রডারিকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে গথিক রাজার বিরাট বাহিনী পর্যদুস্ত হয়। অনেক সৈন্য নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করে। জালিম রডারিকও পানিতে নিমজ্জিত হয়ে মারা যায়। এখান থেকেই স্পেনে মুসলমানদের শাসন শুরু।
মুসলমানদের স্পেন বিজয় পরবর্তী সময়ে দাস এবং নিম্নবর্ণের লোকেরা ইসলামের সাম্যে আকৃষ্ট হয়ে সবচেয়ে বেশি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। খ্রিস্টানরা স্বেচ্ছায় দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। সব ধর্ম এবং বর্ণের মানুষ পায় ধর্মপালনের অধিকার। মুক্ত জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার অধিকার। প্রকৃতপক্ষে এ সময় থেকেই ইউরোপে রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়। মুসলমানদের উন্নত ভাবধারা, আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস ও নীতি স্পেনবাসীর মনে বিপুলভাবে সাড়া জাগায়। এতে স্পেনে সামাজিক বিপ্লবের সৃষ্টি হয়।
মুসলমানদের স্পেন বিজয়ের পর জ্ঞানবিজ্ঞানে তৎকালীন স্পেনের অবস্থান ছিল নেতৃত্বদানকারী পর্যায়ে। স্পেনে মুসলমানরা কাগজ, সংখ্যা গণনা পদ্ধতি এবং তৎকালীন মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত সব জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রচলন করে। তাছাড়া স্পেনে সেচব্যবস্থার চালু কৃষিক্ষেত্রে যোগ করে এক নতুন মাত্রা। তখন থেকেই বিশ্বে লেবুজাতীয় ফলের বৃহত্তম উৎপাদক দেশ স্পেন।
ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকে মুসলমানরা অন্যায় এবং অত্যাচারের বিপক্ষে। স্পেনেও মুসলমানদের ইতিহাস রচিত হয়েছিল একজন নির্যাতিতা নারীর সম্ভ্রমহীনতার বিরুদ্ধে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর আফসোস হলো, মজলুমদের ফরিয়াদ শোনার মতো কোনো তারিক, খালিদ, সিদ্দিক আজ নেই। নেই কোনো মুসা বিন নুসাইর (রহ.)। আজ মুসলমানরাই অত্যাচারিত হয়ে পড়ে থাকে সিরিয়া, ফিলিস্তিন, চীন, মিয়ানমারসহ বিশ্বব্যাপী। কিন্তু তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে না কোনো মুসলমান। ক্ষমতার লোভে পাশ্চাত্যের সঙ্গে আঁতাত পাততে ব্যস্ত সবাই। মুসলমানদের বিজিত গ্রানাডা, কর্ডোভা হাতছাড়া হওয়ার ৫২৯ বছর পেরিয়ে গেল। কিন্তু অতীত ইতিহাস উদ্ধারে কারো কোনো মাথাব্যাথা নেই। ক্ষমতার মোহে মুসলিম দেশগুলো আজ পাশ্চাত্যের কূটচালে বন্দি। মুসলমানদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখন অর্থের লোভ ঢুকে গেছে। কাফির সমাজের সঙ্গে এক হয়ে আজ মুসলমানরাই রক্ত ঝরাচ্ছে মুসলমানদের।
আজ আমরা স্পেনের ফুটবল উন্মাদনা নিয়ে ব্যস্ত। মাদ্রিদের সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর মাঠ আজ কর্ডোভার ইমারতকে কি মনে করিয়ে দিতে পারে না? আবার মুসলমানদের হারানো আন্দালুসিয়াকে ফেরাতে অনুপ্রেরণা দেয় না। আমরা কবে ফিরে পাব বায়তুল মুকাদ্দাস। আবার কবে বিজয় হবে। কবে ফিরে পাব মুসলিম জাতির হারানো গৌরব।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও
সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
"