মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

  ০৬ আগস্ট, ২০২১

ফিরে দেখা

আশুরার তাৎপর্য ও মর্মবাণী

ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। আর মহররম মাসের ১০ তারিখ আশুরা। অনেক তাৎপর্যমণ্ডিত ঘটনা এ দিনে সংঘটিত হয়েছিল। দিনটি ইসলামের ইতিহাসে অতীব গুরুত্বের দাবিদার। হজরত আদম (আ.)-এর তওবা মহররমের দশম দিন তথা এই আশুরায় কবুল হয়েছে। বর্ণিত আছে, তিনি দীর্ঘ ৩০০ বছর কান্নার পর আশুরার দিন তার তওবা কবুল হয়- (তাযকিরাতুল কুরতুবি)। এ দিনে হজরত নূহ (আ.)-এর জাহাজ মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ে (বর্তমানে আরারাত পর্বত শ্রেণিতে) এসে স্থির হয়- (মুসনাদে আহমদ)। আল্লাহতায়ালা হজরত ইদ্রিস (আ.)-কে আশুরার এ দিনে উঁচু মর্যাদায় আসীন করেন- (তাযকিরাতুল কুরতুবি)। হজরত ইবরাহিম (আ.) আশুরার দিনে জন্মগ্রহণ করেন এবং আল্লাহতায়ালা এ দিনে তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন ও আগুন থেকে মুক্তি দেন- (তাযকিরাতুল কুরতুবি)। হজরত ইউসুফ (আ.) এ দিনে জেল থেকে মুক্তি পান- (তাযকিরাতুল কুরতুবি)। আল্লাহতায়ালা এ দিনে হজরত মুসা (আ.) ও তার উম্মতকে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফেরাউন ও তার বাহিনীকে পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করেছিলেন- (মুসলিম)। এ দিনে হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান- (তাম্বিহুল গাফিলিন)। এই দিনেই হজরত সোলাইমান (আ.)-কে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন বাদশাহী দেওয়া হয়েছিল- (তাযকিরাতুল কুরতুব)। এ দিনে হজরত ঈসা (আ.)- কে আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়- (তাযকিরাতুল কুরতুবি)। আরশ, কুরসি, আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য, তারকা, বেহেশত এ দিনেই সৃষ্টি করা হয়েছে- (তাযকিরাতুল কুরতুবি)। এ দিনেই সর্বপ্রথম আসমান থেকে জমিনে বৃষ্টিপাত হয়েছিল- (তাযকিরাতুল কুরতুবি)। আশুরার দিন পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.)ও রোজা রাখতেন। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে উম্মতে মুহাম্মদির ওপর আশুরার রোজা ফরজ ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা নফল রোজায় পরিণত হয়। এ দিনেই হুজুর (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, বেহেশতি যুবকদের সরদার হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেন।

এভাবে যতগুলো ঘটনা এদিনে অর্থাৎ আশুরার দিনে সংঘটিত হয়েছে, সবগুলোই সমগ্র উম্মাহর জন্য, গোটা মানবজাতির জন্য ছিল রহমত। আর এরই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ছিল সিয়াম পালন। ইহুদিরা কেবল আশুরার দিনেই সিয়াম পালন করত। প্রিয়নবী (সা.) ইহুদিদের ইবাদত-বন্দেগির সঙ্গে ইসলামি ইবাদতের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত করার নিমিত্তে আশুরা দিবসের সঙ্গে নবম দিবসেও সিয়াম পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা নবম ও দশম মহররমের রোজা রাখো এবং ইহুদিদের খেলাফ করো অর্থাৎ তাদের মতো কেবল এক দিন সিয়াম পালন করো না।’ মোটকথা, খিলাফতে রাশিদা পর্যন্ত সমগ্র উম্মাহর মধ্যে এ দিনটিকে তাৎপর্য ও মর্মবাণী উল্লিখিত ঘটনাবলির ভেতরই সীমিত ছিল। আর এ কারণেই দিনটিকে মুসলিম জাতি পবিত্র ও বরকতময় মনে করেন। ৬১ হিজরির এ দিনটিতেই এমন একটি ঘটনা সংঘটিত হয়; যা উল্লিখিত সব ঘটনাকে ছাপিয়ে উঠে দিনটিকে একটি অনন্য ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করে। আর তা হলো, এ দিনেই রসুলে আরাবি প্রিয়নবী (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, খাতুনে জান্নাত হজরত ফাতেমা (রা.)-এর কলিজার টুকরা হজরত হুসাইন (রা.) কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে নির্মম ও নৃশংসভাবে শাহাদাতবরণ করেন। কারবালার এই হৃদয়বিদারক ঘটনার সেই দিন থেকে আজ অবধি যত অশ্রু ঝরিয়েছ, পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে আজ পর্যন্ত অন্য কোনো ঘটনা সেই পরিমাণ অশ্রু ঝরাতে পেরেছে কি না সন্দেহ। এ নির্মম ও নৃশংস শাহাদাতে মুসলিম উম্মাহ যেভাবে শোকাতুর হয়েছে এবং যেরূপ নানাভাবে শোক প্রকাশ করছে, মাতম করছে মুসলিম উম্মাহর; অপর কোনো সদস্যের মৃত্যুতে এর খণ্ডংশও দেখা যায় না। কিন্তু কেন এই শাহাদত? কেন এই নৃশংস ও শোকাবহ ঘটনার জন্ম হলো?

হজরত আলী (রা.)-এর শাহাদাতের পর হজরত মুয়াবিয়া (রা.) সমঝোতাক্রমে মুসলিম জাহানের এককভাবে খিলাফত লাভ করেন এবং পরে ২০ বছর একাধিক্রমে খিলাফত পরিচালনা করেন। অতঃপর তিনি তার ছেলে ইয়াজিদকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে যান। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় সবাই এ মনোনয়ন মেনে নিলেও যে কয়েকজন সিংহদিল আল্লাহর বান্দা তা মেনে নিতে পারেননি। তাদের মধ্যে হজরত হুসাইন (রা.)-এর নাম ছিল সর্বাগ্রে। তিনি ইয়াজিদকে স্বেচ্ছাচারী, অযোগ্য ও অপদার্থ হিসেবে খলিফা হওয়ার সর্বাংশে অনুপযুক্ত মনে করেন। তার হাতে বায়াত করতে অস্বীকার করেন। হজরত মুয়াবিয়া (রা.) তার জীবিতকালে এ বিষয়ে হজরত হুসাইন (রা.)- এর ওপর কোনোরূপ পীড়াপীড়ি না করার নীতি মেনে চললেও তার ইন্তেকালের পর তৎপুত্র ইয়াজিদ সে নীতিকে উপেক্ষা করে বায়াতের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। এমনকি যেকোনো মূল্যে ইয়াজিদ হজরত হুসাইন (রা.)-এর বায়াত গ্রহণে কৃতসংকল্প হয়। ওদিকে হজরত হুসাইন (রা.) ও সুবিপুল মর্যাদার অধিকারী মহান সাহাবায় কেরাম এবং বিরাটসংখ্যক মর্যাদাবান তাবিঈর উপস্থিতিতে ইয়াজিদের মতো একজন বিলাসী ও ক্রীড়া-কৌতুকপ্রিয় অনির্ভরযোগ্য স্বভাব চরিত্রের ব্যক্তির হাতে বায়াত করতে এবং তাকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে কীভাবে রাজি হতে পারেন? তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ইয়াজিদের তুলনায় হাজারগুণে গুণান্বিত উত্তম আখলাক বিশিষ্ট যোগ্য লোক উম্মাহর মধ্যে এখনো রয়েছে। তদুপরি তার মনোনয়নের ভেতর মুসলিম উম্মাহর সত্যিকার মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি এবং খুলাফায়ে রাশেদার আমলে মহান খলিফা চতুষ্টয়ের অনুসৃত কোনো নীতি কিংবা আদর্শও অনুসরণ করা হয়নি। অতএব তার দ্বারা মহান খলিফা চতুষ্টয়ের আদর্শ অনুসরণ বা ইসলামি খিলাফতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হাসিল করা আদৌ সম্ভব নয়। ইয়াজিদের জানা ছিল যে, রসুল (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত হুসাইন (রা.) কর্তৃক তার বায়াতকে অস্বীকারের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সাধারণের ওপর কী হতে পারে। ফলে সে পীড়াপীড়ি মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং যেকোনো মূল্যে বায়াত নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়।

এ অবস্থায় হজরত হুসাইন (রা.) ইয়াজিদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার আশায় মক্কায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে ইরাক থেকে হজরত হুসাইন (রা.)-কে কুফায় আগমনের আহ্বান ও তার প্রতি সর্বপ্রকার সাহায্য-সমর্থনের দৃঢ় আশ্বাসসূচক অসংখ্য চিঠি হাজির হয়। তাদের আহ্বান ও সাহায্য-সমর্থনের আশ্বাস কতটা আন্তরিক তা সরেজমিন দেখার জন্য তিনি আপন চাচাতো ভাই হজরত মুসলিম বিন আকিল (রা.)-কে কুফায় পাঠান। হজরত মুসলিম (রা.) কুফায় অনুকূল পরিবেশ লক্ষ্য করে হজরত হুসাইন (রা.)-কে কুফায় আগমনের সবুজ সংকেত প্রদান করেন।

ইয়াজিদ পরিস্থিতি মোকাবিলার উদ্দেশ্যে কুফার গভর্নর নুমান ইবনে বশীরের স্থলে উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে নিযুক্ত করেন। এদিকে হজরত হুসাইন (রা.)-কে কুফার পথে অবরোধপূর্বক যেকোনো মূল্যে বায়াত গ্রহণের নির্দেশ দেন। উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ কুফায় ক্ষমতার বাগডোর হাতে নিয়েই হজরত মুসলিম বিন আকিল (রা.)-কে হত্যা করে এবং একদল সৈন্য নিয়ে প্রেরণপূর্বক হজরত হুসাইন (রা.)-এর আগমনে বাধা দেয়। একপর্যায়ে উভয় কাফেলা কারবালা নামক স্থানে উপনীত হয় এবং সামনাসামনি অবস্থান গ্রহণ করে। হজরত মুসলিম বিন আকিল (রা.) শাহাদতের আগেই হজরত হুসাইন (রা.)-কে বিশ্বস্ত লোক মারফত কুফার লোকদের বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে অবহিত করে পেছনে ফেরার অনুরোধ জানিয়ে যান। কিন্তু হজরত হুসাইন (রা.) ‘তাকদিরের লিখন অখণ্ডনীয়’ এই বলে হাসিমুখে সব অবস্থা ও প্রতিকূলতা মোকাবিলায় দৃঢ়সংকল্প হন। তার কুফা গমনে বাধাদানকারীদের মধ্যে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.), হজরত আবু সাইদ আল খুদরী (রা.), হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.), হজরত সাইদ ইবনুল মুসায়্যাব (রা.)-এর ন্যায় প্রমুখ সাহাবি ও তাবিঈ ছিলেন।

অবশেষে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। ইয়াজিদ বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রথম তীর নিক্ষিপ্ত হলে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। প্রথমে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ শুরু হয়। এতে হুসাইন (রা.) পক্ষের পাল্লা ভারী হওয়ায় আমর ইবনে সাদ একযোগে ব্যাপক আক্রমণের নির্দেশ দেয়। আসলে এ ছিল যুদ্ধের নামে এক অসম যুদ্ধ। সুসজ্জিত চার হাজার বাহিনীর বিরুদ্ধে পদাতিক ও অশ্বারোহী মিলিয়ে নারী-শিশু বাদে মাত্র ৭২ জনের একটি ক্ষুদ্র দলের এ যুদ্ধকে যুদ্ধ বলা যায় না। হজরত হুসাইন (রা.) ও তার আত্মীয়-বান্ধবরা কোনো অবস্থাতেই অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে ন্যায়ের জন্য নীতির কাছে একটি পরম ও প্রিয় সত্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করে আল্লাহর পিয়ারা হতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীতে বংশধরদের জন্য একটি অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় মহত্তম নজির সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, যা উম্মাহকে এমনিভাবে মহত্তর আদর্শ ও লক্ষ্যের জন্য কোরবানি পেশ করতে অনুপ্রাণিত করবে। আর এখানেই তাদের সাফল্য। যুদ্ধে হজরত হুসাইন (রা.) ও তার আত্মীয় সবাই শাহাদাতবরণ করেন। সেনানায়ক শিমারের নির্দেশে হুসায়ন ইবনে নুমায়ের হজরত হুসাইন (রা.)-কে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে। তীর তার কণ্ঠে বিদ্ধ হয়। যুরআ ইবনে শুরায়ক তামিমি তরবারি দ্বারা তার কাঁধে আঘাত করে। অবশেষে সানান ইবনে আনাস নামক চরম হতভাগা নেজার আঘাত হানলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। অতঃপর সে তার তলোয়ার দিয়ে হজরত হুসাইন (রা.)-এর পবিত্র মস্তক, যেই মস্তক বিশ্বস্রষ্টা মহান রাব্বুল আলামিনের সামনে ছাড়া আর কখনো নত হয়নি, পবিত্র দেহ মোবারক থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

ইয়াজিদ মারা গেছে সেই কবে। কিন্তু তার প্রেতাত্মারা বেঁচে আছে আজও। দেশে বিশ্বের নানা প্রান্তে আজও তারা নিত্য কারবালার জন্ম দিয়ে চলছে। তাই বলে হজরত হুসাইন (রা.) মারা যাননি। তার কোরবানি, তার আত্মদান দিয়ে চলেছে শতসহস্র লক্ষাধিক হুসাইন, যারা তারই দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত হয়ে আত্মদান করে চলেছে কাশ্মীর, আরকান, ফিলিস্তিন, মিসর, আলজেরিয়া, বসনিয়া, চেচনিয়াসহ পৃথিবীর নানা অঞ্চল ও প্রান্তে। তারা শহীদ হন, কিন্তু মরেন না। বুলেট, বেয়নেট, জেল, টর্চার কেন্দ্রের অসহনীয় নির্যাতন তাদের স্তব্ধ করে দিতে পারে না। হাসিমুখে সব সয়ে যান তারা। কারবালা তাদের পথ দেখায়, যেভাবে দেখিয়েছে যুগে যুগে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close