জাকির আজাদ
সংকেত
নতুন আতঙ্কের নাম বজ্রপাত
সম্প্রতি বাংলাদেশে মাত্র দুদিনের ব্যবধানে ৬৫ জনের বেশি নারী, পুরুষ ও শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বজ্রপাতে এত প্রাণহানির খবরে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে সবার। সবং মহলকে করে তুলছে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ-প্রবল দেশ হিসেবেই সুবিদিত। সুদূর অতীতকাল থেকেই বন্যা, ঝড়, ভূমিকম্প, খরা, অতিবৃষ্টি নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের জনজীবনের নিত্যসঙ্গী। তবে এবার যুক্ত হয়েছে আরো একটি নাম।
নতুন এই আতঙ্কের নাম বজ্রপাত। বজ্রপাত প্রকৃতি সৃষ্ট একটি অনাকাক্সিক্ষত দুর্যোগ। যে দুর্যোগ রোধ করা সম্ভব নয়। তবে প্রকৃতির প্রতি মানুষের সহানুভূতি পারে এমন অঘটন থেকে দূরে রাখতে। অর্থাৎ সচেতনতা। বজ্রপাত আসলে কী? কেনইবা এর সৃষ্টি। ঋতু পরিক্রমায় বর্ষকালেই সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত ঘটে থাকে। এলাকাভেদে গ্রামীণ পরিভাষায় এ বজ্রপাতকে ‘বাজ কিংবা ঠাটা বলা হয়ে থাকে। বজ্রপাতের সৃষ্টির তথ্যানুযায়ী বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ পেরিয়ে পরবর্তী মৌসুমে এমনকি শীতের আগ পর্যন্ত তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গেই গরম বাতাসে জলীয়বাষ্প ঊর্ধ্বমুখী হয়ে মেঘের উষ্টায়ন ক্ষমতাও অস্বাভাবিক বেড়ে জ্যামিতিক হারে মেঘের সৃষ্টি হবে। বাতাসের এ প্রক্রিয়া ওপর ও নিচে দুভাবে চলতে থাকে। আপ ড্রাফ হলো মেঘের ওপরের স্তর এবং ডাউন ড্রাফ হলো নিচের। এই মেঘই বজ্রমেঘ। এই দুই মেঘের মধ্যে বৈদ্যুতিক পজিটিভ ও নেগেটিভ বিকিরণে প্রাকৃতিক নিয়মে ব্যালান্স (ভারসাম্য) আনার চেষ্টা হয়। পজিটিভ ও নেগেটিভ মেঘ একত্র হয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন শুরু হলে বজ্রপাত হতে থাকে। তাছাড়া যখন কিউমুলোনিস্বাস মেঘ তৈরি হয়, তখনই বজ্রঝড় হয়ে থাকে। কিউমুলোনিস্বাস মেঘ হচ্ছে খাড়াভাবে সৃষ্টি হওয়া বিশাল আকৃতির পরিচালন মেঘ, যা থেকে কেবল বিদ্যুৎ চমকানো নয়, বজ্রপাত-ভারী বর্ষণ, শিলাবৃষ্টি, দমকা ঝড়োহাওয়া এমনকি টর্নেডো সৃষ্টি হতে পারে।
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে পর্যন্ত গত আড়াই মাসে দেশে বজ্রপাতে ১৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে জুনের প্রথম সপ্তাহে মারা গেছেন ৬৫ জন। তাদের মধ্যে ১২২ জন ফসলের খেতে কর্মরত ছিলেন। ১৭৭ জন বজ্রপাতে মৃত্যু সংখ্যার মধ্যে ১৪৯ জন পুরুষ ও ২৮ জন নারী। বয়সি শ্রেণির হিসাবে নিহতদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ১৩ জন, এরমধ্যে কিশোর ছয়জন ও কিশোরী তিনজন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, দুর্যোগ ফোরাম, গণমাধ্যমের তথ্য ও একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে সারা দেশে বজ্রপাতে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা সর্বাধিক। ২০২০ থেকে ২০২১ সালের জুন অনুযায়ী সারা দেশে ৫ হাজার ৭৭২টি বজ্রপাত হয়। এরমধ্যে ২০১১ সালে ৯৭৮, ২০১২ সালে ১২১০, ২০১৩ সালে ১৪১৫, ২০১৪ সালে ৯৫১, ২০১৫ সালে ১২১৮ বজ্রাঘাত হেনেছে বাংলাদেশে আর বজ্রাঘাতে নিহত হয়েছেন ২১৬ সালে ৩৬ জন (এপ্রিল পর্যন্ত), ২০১৫ সালে ১৮৬ জন, ২০১৪ সালে ২১০ জন, ২১৩ সালে ২৮৫, ২০১২ সালে ৩০১ জন এবং ২০১১ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ১৭৯ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে দেশে বজ্রপাতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত এপ্রিলে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি ছিল। গড় তাপমাত্রা বাড়ার আনুপাতিক হারে ১৫ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি বজ্রপাত হওয়ার পাশাপাশি আগামীতে বাংলাদেশে এর পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশ বজ্রপাত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের কয়েক বছরের বজ্রপাতের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে ঢাকা, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর অঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চলে বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া ও খুলনা অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটেছে।
তথ্য মতে, বজ্রপাতজনিত কারণে বিশ্বের চার ভাগের এক ভাগ মারা যায় বাংলাদেশে। তবে এর বেশির ভাগই নারী ও শিশু। শুধু অসতর্কতা ও সচেতনতার অভাবে এই মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার আরেকটি কারণ। তাছাড়া বড় গাছের অভাব বজ্রপাতে মৃত্যুর অন্যতম একটি কারণ হতে পারে। অন্যদিকে শহরাঞ্চলে ঘরবাড়ি বেশি হলেও সেখানে বজ্রনিরোধক থাকায় বজ্রপাতের ঘটনা কম। কিন্তু গ্রামে এই নিরোধকের কাজ করত বড় বড় গাছ। সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। আর এতেই বাড়ছে বজ্রপাতের সংখ্যা এবং প্রাণহানি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বজ্রপাত যে হারে বাড়ছে, তাতে এটিকে দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করার সময় এসেছে।
বজ্রপাতে বছর বছর ক্রমশ মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। এটি থামানো দরকার। যদিও এ মুহূর্তে সচেতনতা ও সতর্কতা বৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তবে আগামী প্রজন্মকে নিরাপদ রাখার কথা মাথায় রেখে প্রত্যেকে অন্তত একটি করে গাছ রোপণ করি। এই একটি গাছ কেবলই বজ্রপাতের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করবে না, জীবনকেও নান্দনিক করবে।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
"