মো. রাশেদ আহমেদ

  ০৪ আগস্ট, ২০২১

পর্যালোচনা

সভ্যতার বিষফোঁড়া সন্ত্রাসবাদ

আধুনিক বিশ্বে দারিদ্র্য, ক্ষুধা-অনাহার, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও দুর্যোগ, পরস্পর আস্থার অভাব, আয়-ব্যয়, বৈষম্য, বর্ণবৈষম্য, হিংসা-বিদ্বেষ, অভিবাসী সংকট, অস্ত্র প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির মতো হাজারো সমস্যায় জর্জরিত একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতা। বিশ্বায়নের এ চরম উৎকর্ষ সাধনের সভ্যতায় এসেও বিশ্বে প্রায় ৮০০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৩২০ কোটির অধিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। করোনাকালীন সংকটে দারিদ্র্য সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যার মধ্যে শুধু এশিয়া মহাদেশে ১২ শতাংশ। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে হাজারো সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে সন্ত্রাসবাদ গোটা বিশ্বকে অস্থির করে তুলেছে। এমনকি সাম্প্রতিককালে বিশ্বের হার্ডপাওয়ার নামে খ্যাতি যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসবাদের সহিংসতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিনের উত্তেজনা সন্ত্রাসবাদ দমনে বিশ্বের কাছে আরো কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্বে সন্ত্রাস দমনে ইরান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে আইএস দমনেও ইরানের ভূমিকা ছিল অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ।

মূলত সন্ত্রাসের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞা নেই। বিভিন্ন দেশ, জাতিগোষ্ঠী, ব্যক্তিবর্গ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সন্ত্রাসের নিজস্বভাবে সংজ্ঞায়ন করেছে। তবে ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘ নিম্নরূপ সংজ্ঞা প্রদান করে সন্ত্রাসবাদ হলো এক ধরনের জঘন্য অপরাধ, যার উদ্দেশ্য হলো সাধারণ জনগণের জন্য ভীতি সৃষ্টি করে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলা করা। যার শিকার বেশির ভাগ নিরপরাধ নর-নারী এমনকি হামলার হাত থেকে শেষ রক্ষা পায় না শিশুও। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিশ্ববাসী এই অপকর্মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও কেন থামছে না এর দানবীয় রূপ! কার্যত সন্ত্রাসবাদের উথানের পেছনে পরাশক্তি দেশগুলোর যে পরোক্ষ মদদ আছে, তা অনুমেয়। বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ উথানের পেছনে যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বর্ণবিদ্বেষ, ধর্মীয় উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িক উসকানি, অস্ত্রের ব্যবসা, ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা, চরম দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, নিজ দেশে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব এবং বিশ্বে নিজস্ব ক্ষমতার বলয় তৈরি।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইনটাওয়ারসহ তিনটি স্থাপনায় ভয়াবহ সন্ত্রাসী বিমান হামলায় প্রাণ হারায় ২০০০ মানুষ। এ হামলার জন্য দায়ী করা হয় আল কায়েদাভিত্তিক সন্ত্রাসী জঙ্গি সংগঠনকে। এতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় বিশ্ববাসী। যার ফলে একই বছর ৫ অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঋঞঙ কর্তৃক প্রায় ২৬টি সন্ত্রাসী জঙ্গি সংগঠনের তালিকা প্রকাশ করে। শুরু হয় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধ, যা এখনো চলমান। বিশ্বে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রথম বলি হয় আফগানিস্তান। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আল কায়দা জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালায়। এ অভিযানে হাজার হাজার নিরীহ আফগান প্রাণ হারায়, সেই সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত হয় তালেবান সরকার। আবার সেই তালেবান গোষ্ঠীকে বড় সন্ত্রাসী জঙ্গি সংগঠনের ট্যাগ লাগিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। যদিও বর্তমান কাবুলে যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান সমীকরণ ভিন্ন।

এ কথা সংকোচহীন ভাষায় বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল অভিযান পরিচালনা করলেও আজ সেখানে সন্ত্রাস নির্মূল সম্ভব হয়নি। বরং এখন প্রতিনিয়ত আফগানদের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে। কার্যত মার্কিন কর্তৃক আফগানিস্তানে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অনেকটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত। এরপর ২০০৩ সালে ইরাকের তৎকালীন প্রত্যাপশালী প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে সন্ত্রাসবাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে মার্কিন প্রশাসন চিহ্নিত করলে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে। এতে প্রাণ হারায় হাজার হাজার নিরীহ মানুষ ও শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয় লক্ষাধিক ইরাকি। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের ওই অভিযান ইরাকিদের মুখে হাসি ফোটাতে ব্যর্থ হয়। বরং বিশ্বদরবারে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ইরাক দেশ; যা বর্তমান অবস্থা খুবই ভয়াবহ। প্রসঙ্গ যে, ইরাকে শক্তিশালী আইএসসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন জেঁকে বসেছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, ২০০১ সাল থেকে শুরু হওয়া সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানের মাঝেও ২০১৪ সালে ইরাক ও সিরিয়া অঞ্চলে জন্ম নেয় নতুন শক্তিশালী সন্ত্রাসী জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট। ইতোমধ্যে জো বাইডেন প্রশাসন বাগদাদ থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, এতে ইরাকে সন্ত্রাসবাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে। তবে নিকট ভবিষ্যৎ বলে দেবে ইরাকে নিজস্ব বাহিনী অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমনে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান এ জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম কিছুটা নিশ্চল। তার মাঝেও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন দেশে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে এই জঙ্গি সংগঠন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সিরিয়া, লিবিয়া, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে অভিযান পরিচালনা করলেও আপাতদৃষ্টিতে ইতিবাচক ফল নেই। বরং সময়ের পরিক্রমায়, এসব দেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বেড়েছে। যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত লিবিয়া। অপরদিকে, লেবানন ও ইয়েমেনে হুতি সন্ত্রাসী সংগঠনের কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ২০০১ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযানে এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৫ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার। নিহতের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। আর বাস্তুচ্যুত হয়েছে ১ কোটিরও অধিক।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, বিশ্বে সঠিক গণতন্ত্রের চর্চার অভাবেও সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মিসর তার উদাহরণ মাত্র। তবে অবাক করার বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ অভিযান পরিচালনা করে আসছে; যার অধিকাংশ মুসলিম প্রধান দেশগুলোর বিরুদ্ধে, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। অপরদিকে সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা হিসেবে পরিচিত ইসরায়েল দীর্ঘকাল ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী ও নৃশংস কর্মতৎপরতা চালিয়ে গেলেও খোদ যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়গুলোয় বর্ণ ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী ত্বরিত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রে একটি গবেষণার তথ্যমতে, গত ১০ বছরে দেশটিতে ৭১ শতাংশ হামলায় জড়িত শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীরা। অথচ পশ্চিমা মিডিয়া বারবার তার দায়ভার অন্যদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ পরিক্রমায় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে গেলেও সফলতার গল্প খুব বেশি নয়। বরং অনেক দেশে অভিযানের পর সন্ত্রাসী কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে; যা খুবই দুঃখজনক।

নিঃসন্দেহে বর্তমান বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ একটি বড় সমস্যা। এখন সন্ত্রাসীদের কর্মকা- শুধু মধ্যপ্রাচ্য বা মুসলিম দেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নেই। এ তৎপরতা এখন বিশ্বের শান্তিপ্রিয় দেশ কানাডা, ইউরোপ থেকে শুরু করে সব দেশেই কমবেশি প্রতিনিয়ত ঘটছে। মুহূর্তে ঝরে যাচ্ছে অগণিত তাজা তাজা প্রাণ, যার দায়ভাগ বিশ্ব সম্প্রদায় কখনোই এড়িয়ে যেতে পারে না। সুতরাং আগামীর বিশ্ব ভূখ-কে সন্ত্রাসবাদমুক্ত করতে নিজস্ব স্বার্থের ঊর্ধ্বে এসে বিশ্বের পরাশক্তিসহ সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে, যত দিন পর্যন্ত না নতুন প্রজন্ম সন্ত্রাসবাদমুক্ত বিশ্ব পাচ্ছে, ঠিক তত দিন।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close