মাছুম বিল্লাহ

  ০৪ আগস্ট, ২০২১

দৃষ্টিপাত

মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের উপায়

স্ট্রেস বিষয়টি আসলে কী? এটি এক ধরনের অনুভূতি; যা আমাদের অনুভব করায় যে, আমরা অনেক বেশি কিংবা অসম্ভব রকমের চাপের মধ্যে আছি। আমাদের মনের মধ্যে এক অস্থিরতা তাড়া করে বেড়ায়। এটি আমাদের প্রতিদিনকার জীবনের বিভিন্ন বিষয় থেকে আসতে পারে। সেটি হতে পারে বেশি পরিমাণে কাজের চাপ, এক কাজ থেকে অন্য কাজে যাওয়ার মধ্যবর্তী সময় কিংবা নতুন কর্মস্থলে গিয়ে কাজ শুরু, পুরাতন কাজ ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা ও কাজের শেষ সময়, পরিবারের কিংবা সহকর্মীদের কারোর সঙ্গে কথা কাটাকাটি কিংবা যুক্তিতর্ক করা, অর্থনেতিক টানাপড়েন, কাউকে পাওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা অথচ বাহ্যিক কিছু বাধা, সেটি হতে দিচ্ছে না। এই অবস্থা আমাদের ভীতসন্ত্রস্ত করে ফেলে, মনকে অস্থির করে তোলে। মনের এই অস্থিরতায় শরীর এক ধরনের সাড়া দেয় এই বিষয়টিই স্ট্রেস।

এর প্রকাশ হতে পারে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন ধরনের। যেমন আমাদের আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে, আমরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে যেতে পারি। এই ধরনের অবস্থা আমাদের শারীরিক, মানসিক ও আবেগিকভাবে ক্ষতি করে থাকে। বর্তমান সময়ে আমাদের কর্মক্ষেত্র, পরিবার, সমাজ, আকাক্সক্ষা, চারদিকের চাকচিক্য, অর্থবিত্ত পাওয়া ও না পাওয়ার দ্বন্দ্ব, পদোন্নতি না পাওয়া, অন্যের সঙ্গে তুলনা, প্রতিপত্তি, ক্ষমতার মোহ আমাদের এত বেশি ব্যস্ত ও সন্ত্রস্ত রাখে যে, আমরা মানসিকভাবে সর্বদাই চাপের মধ্যে থাকি। প্রত্যেকটি মানুষ এ ধরনের চাপ অনুভব করে। তবে এটি যখন স্বাস্থ্যের জন্য কিংবা জীবনের মঙ্গলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় বিশেষ করে জীবনের ওপর হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তখন এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। মানসিক চাপের একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটা। এটি যদি সপ্তাহে তিন দিন হয় এবং তিন মাস যাবত চলতে থাকে, তাতে ইনসোমনিয়া হতে পারে। যার অর্থ হচ্ছে ঘুমাতে না পারা, মানসিক চাপের চক্র এবং নির্ঘুম অবস্থা। আর ঘুমাতে না পারা মানে আরো মানসিক চাপ বেড়ে যাওয়া।

জীবনকে চালাতে হলে বিশেষ করে ছন্দময়, গতিশীল এবং সুন্দরভাবে সামনে এগিয়ে নিতে হলে এই স্ট্রেসকে, মানসিক চাপকে আমাদের ম্যানেজ করতে জানতে হবে, একে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়, সেটি জানতে হবে। এটি কীভাবে না হয় তার সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। ব্যায়াম একটি চমৎকার স্ট্রেস উপশমকারী বিষয়। ব্যায়াম যা ঘুম আনতে সহায়তা করে। আর সুনিদ্রার অর্থ হচ্ছে চমৎকার মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা। চমৎকার পরিমিত ঘুম ব্রেনের কার্যক্ষমতা বাড়ায়। ব্যায়ামের ফলে এনডরফিন এবং এন্ডোক্যানাবিনয়েড নামক হরমোন নিঃসৃত হয়; যা ব্যথা কমায়, ঘুমের উন্নতি ঘটায় এবং মনের উত্তেজনা কমিয়ে প্রশান্তি আনে। ব্যায়াম করার যদি সেভাবে সময় ও সুযোগ না থাকে; সেক্ষেত্রে যারা গাড়ি চালানোর পরিবর্তে সাইকেল কিংবা হাঁটার পথ হলে হেঁটে কর্মক্ষেত্রে যেতে পারেন। অফিসে লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার করতে হবে। যারা সর্বদাই গাড়িতে চড়েন, তারা বাসা থেকে গাড়ি এমন এক দূরবর্তী স্থানে পার্ক করুন, যেখানে হেঁটে যেতে হবে। গাড়ি নিজে নিজে ধৌত করুন। অফিস থেকে লাঞ্চে যাওয়ার সময় হেঁটে যাওয়া উত্তম।

ব্যায়াম মুড পরিবর্তনে সহায়তা করে। এটি শরীরকে উত্তেজিত করে কয়েক ধরনের হরমোন নিঃসরণের ক্ষেত্রে যেমন এন্ডারফিন এবং এন্ডোক্যানাকিনয়েড। এই হরমোন দুটে ব্যথা অনুভবে বাধা দেয়, সুন্দর ঘুম আনয়ন করে। যারা ব্যায়াম করেন, তাদের উদ্বিগ্নতা কম থাকে এবং নিজেদের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করেন। আর শরীর ভালো থাকলে মন তো ভালো থাকবেই। হাঁটা একটি ব্যায়াম। এটি আমাদের মনকে ভিন্নদিকে চালিত করে। অতএব কাজ থেকে সামান্য একটু বিরতি নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটার অভ্যাস করলে হতোদ্যম মন ভালো হয়ে যায়। আর উন্মুক্ত মাঠ কিংবা পার্কে হাঁটা শরীর ও মনকে সতেজ করে এবং নতুন উদ্যম সৃষ্টি করে। আমাদের মনে রাখতে হবে, শরীর ও মনকে প্রশান্তির মধ্যে রাখার উল্লেখযোগ্য একটি পদ্ধতিই হচ্ছে ব্যায়াম; যা আমাদের মনের অবস্থা পরিবর্তন করে দিতে পারে।

যদি কোনো বিষয় আপনার বিরক্তির কারণ হয়ে থাকে, তাহলে সেটি নিয়ে আপনার পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব, ডাক্তার, বিশ^স্ত ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। নিজের সঙ্গেও কথা বলতে পারেন। আমরা আমাদের নিজেদের সঙ্গে কথা বলতে পারি, তবে তা হতে হবে পজিটিভ। ভালো বিষয় এবং আশাজাগানিয়া। আত্মকথন যদি নেগেটিভও হয় তাকেও পজিটিভের দিকে ধাবিত করতে হবে। তাহলে অনেকটাই মানসিক চাপ কমে যায়। কোনো নিকটাত্ময়ের মৃত্যু, মারাত্মক অসুস্থতা, পরিবারে কারোর মৃত্যু কিংবা দুঃসহ জীবন এগুলো মানসিক চাপ বাড়ায়। কিন্তু মনে করতে হবে, এগুলো পুরোটাই প্রাকৃতিক, যার ওপর মানুষের কোনো হাত নেই। আর মানুষের যেখানে হাত নেই, সেটি তো হবেই। সেটি নিয়ে দুশ্চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। বরং সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, এগুলোকে প্রাকৃতিক বিষয় হিসেবেই নিতে হবে।

আপনি যা পছন্দ করেন, তা করার জন্য একটি সময় আলাদা করে রাখতে হবে। আপনার যা করতে ভালো লাগে, তা প্রতিদিনই করতে পারেন, যা আপনার মানসিক চাপকে কমিয়ে দেবে। এজন্য ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময়ই যথেষ্ট। এসব হতে পারে পড়া, সেলাই করা, কিছু অঙ্কন করা, খেলা করা, সিনেমা দেখা, পাজল খেলা করা, আধুনিক জীবন অত্যন্ত ব্যস্ত। তাই মাঝেমধ্যে আমাদের কাজের গতি কিছুটা কমিয়ে আনতে হবে। যেমন এক দিনে হয়তো ৫০টি মেইলের উত্তর দিতে হবে, সেখানে ৫০টির উত্তর দেওয়া যদি শরীরে না কুলোয়, কমিয়ে দিন। অন্য আর একসময় কিংবা পরদিন বাকি উত্তর দিন। আমরা যখন চাপের মধ্যে থাকি, আমাদের মাংসপেশিগুলো উত্তেজিত থাকে। আমরা তখন হাত-পা প্রসারিত করে দিয়ে, ম্যাসাজ করে, হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করে, পর্যাপ্ত ঘুম দিয়ে হালকা করতে পারি।

শারীরিক স্পর্শ স্ট্রেস কমাতে বেশ সহায়ক। ভালোবাসার কাউকে জড়িয়ে ধরলে অক্সিটক্সিন হরমোন বের হয়, যার আর এক নাম ‘কাডেল হরমোন’। এই হরমোন উচ্চমাত্রার আনন্দের সঙ্গে যুক্ত এবং কম মাত্রার স্ট্রেসের সঙ্গে যুক্ত। এটি রক্ষের চাপও কমায়। স্ট্রেস হরমোন ‘নোরপাইনফ্রাইন’ কমিয়ে শরীর ও মনে আরামবোধ তৈরি করে। অতএব সুযোগ থাকলে এটি আমরা করতে পারি। স্ট্রেস কমানোর ক্ষেত্রে এটি দুজনের জন্যই ভালো। আপনার রক্ষে সুগার যখন ভাঙতে থাকে, তখন আপনাকে অত্যন্ত স্ট্রেসড এবং অস্থির মনে হবে। তাই কুকি, আলুর চিপ না খাওয়াই ভালো। কারণ এগুলো ব্লাড সুগার বাড়ায়। বেশি সুগারযুক্ত খাবার আখেরে স্ট্রেস বাড়ায়। স্বাস্থ্যকর খাবার আপনার স্ট্রেস ম্যানেজ করতে সহায়তা করে। যেমন ডিম, অ্যাভাকেডো, ওয়ালনাট শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করে এবং মুড নিয়ন্ত্রণ করে।

ধনাত্মক আত্মকথন একটি চমৎকার দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিতে পারে। আশাবাদী এবং সহানুভূতিশীল আলোচনা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফলে ভালো কাজ সম্পাদিত হয়। নিজের সামর্থ্যে সন্দেহ জাগলে নিজের সহানুভূতির সঙ্গে বোঝাতে হবে। এজন্য নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলার ধরন অনেকটাই মূল্যবান। কারণ এটি অনেক কিছু প্রভাবিত করতে পারে। নিজ সম্পর্কে কঠোর সমালোচনা, সন্দেহ, ধ্বংসাত্মক পূর্ব লক্ষণ প্রকাশ করা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। এ ধরনের চিন্তা নিজেকে স্ট্রেসের মধ্যে ফেলে দেয়। নিয়মিত এবং সুষম খাবার আপনার ভেতর সুন্দর অনুভূতি জাগাবে এবং আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করবে। তাই খাবারে যথেষ্ট ফলমূল, শস্যদানা থাকতে হবে, প্রোটিন থাকতে হবে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য। খাবারের কারণে মুড খারাপ হলে তা আপনার মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেবে।

দেখা যায়, আমাদের প্রায়ই খুব অস্থির মনে হয়। কাজে মনোনিবেশ করা যায় না। ঘন ঘন মত পরিবর্তন, মেজাজ সহজে বিগড়ে যাওয়া, সান্ত্বনা না পাওয়া, আত্ম-সম্মানবোধ কমে যাওয়া, স্বাভাবিকের চেয়ে কম কিংবা বেশি খাওয়া, ঘুমের পরিবর্তন হওয়া অর্থাৎ অস্বাভাবিক ঘুম কিংবা একেবারে কম ঘুম, তামাক-বিড়ি, অ্যালকোহল খাওয়ার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়া, মাংসপেশিতে ব্যথা, ডায়রিয়া কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্য, অস্থিরতা এমন যে এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসতে না পারা, যৌনক্ষমতা কমে যাওয়া, কোনো কিছুতে সহজেই বিস্মিত হওয়া এই লক্ষণগুলো যখন কোনো মানুষের মধ্যে প্রকাশ পেতে থাকে; তখন বুঝতে হবে তিনি মানসিক চাপের মধ্যে আছেন। আর এগুলো দীর্ঘদিন চলতে থাকলে মানুষের শরীর, মন ও মানসিকতা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব ক্ষেত্রে মানসিক ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াটাই শ্রেয়।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, স্ট্রেস বা চাপ মাঝেমধ্যে উপকারী কিংবা ধনাত্মক। এটি আমাদের বেশি সতর্ক করে এবং কোনো কোনো অবস্থায় ভালো কাজ করতে সহায়তা করে। তবে এটি যদি অল্প সময়ের জন্য হয়। দীর্ঘস্থায়ী হলেই এটি হ্রদযন্ত্রের ব্যাধি, মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে, হতাশা বাড়িয়ে দেয়। নির্দিষ্ট কিছু অভ্যাস স্ট্রেস কমাতে সহায়তা করে এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে কাজ করে। অতএব সেই অভ্যাসগুলোকে আমরা অনুশীলন করতে পারি। আমাদের স্বাভাবিক কাজের সময়ের মধ্যেই অবকাশের জন্য একটু সময় বের করে নিতে হবে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, আমার শরীর ও মন যখন ভালো লাগবে, আমার কাজও তখন ভালো লাগবে। আর ভালো লাগানো ও খারাপ লাগানো বিষয় অনেকটাই আমাদের নিয়ন্ত্রণে। আমাদের নিজেদের বৃহত্তর স্বার্থেই খারাপ লাগার কারণগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close