মনসুর হেলাল
শ্রদ্ধাঞ্জলি
মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব
অপঘাতণ্ডঅপবাদে যতই বিদ্ধ হোক, কিন্তু কীর্তিমানের কোনো মৃত্যু নেই। তারা অমর, অবিনশ্বর। সৃষ্টির মাঝেই তারা অনন্তকাল বেঁচে থাকেন, বেঁচে থাকবেন। তেমনই এক কীর্তিমান নারী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। তিনি নিরহংকার, নির্লোভ, আদর্শ স্ত্রী, মা, গৃহিণী ও দক্ষ সংগঠক। বেগম মুজিব বিরূপ পরিস্থিতিতে ছিলেন অবিচল, নিয়েছেন সঠিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য সংগ্রামকেই প্রাধান্য দিয়ে, নিজেদের সুখণ্ডশান্তি বিসর্জন দিয়ে সংসার করেছেন। বেগম মুজিব জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গে থেকে নীরবে দেশ ও মানুষের সেবা করে গেছেন। মানুষের জন্য স্বামীর ত্যাগ ও সংগ্রামে নিরন্তর সহযোগিতা করেছেন, যা সত্যিই অনন্য, অতুলনীয়। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তার ভাবনা ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে আছে। স্বামীর প্রতি বেগম মুজিবের ছিল অগাধ বিশ্বাস। তারা একে অপরের আত্মা হয়ে থেকেছেন, কাজ করেছেন। দুজনের তীব্র ভালোবাসা ছাপিয়ে দেশের মানুষের প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রাধান্য পেয়েছে আমৃত্যু।
১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। তার বাবার নাম শেখ জহুরুল হক ও মায়ের নাম হোসনে আরা বেগম। দাদা শেখ আবুল কাশেম নাতনির নাম রাখেন ফজিলাতুন নেছা। ফুলের মতো গায়ের রং বলে মা হোসনে আরা বেগম ডাকতেন রেণু বলে। এক ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। শৈশবে মাণ্ডবাবাকে হারানোর পর শেখ ফজিলাতুন নেছা বেড়ে ওঠেন দাদা শেখ কাশেমের কাছে। সম্পর্কে তিনি জাতির পিতার আত্মীয় হতেন। খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছার। শ্বশুরণ্ডশাশুড়ি ও দেবরণ্ডননদের সঙ্গেই তিনি বেড়ে ওঠেন।
জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পেছনে মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অনন্য সাধারণ ভূমিকা ছিল। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে পর্দার অন্তরালে থেকে তিনি পরামর্শ, সাহস, অনুপ্রেরণা ও সব কাজে সহযোগিতা দিয়ে গেছেন। বঙ্গমাতার অবদান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকাণ্ডপয়সা জোগাড় করে রাখত, যাতে আমার কষ্ট না হয়।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ প্রেক্ষাপটে নেপথ্যে থেকে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি দুঃসময়ে প্রেরণা জুগিয়েছেন ও পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী হয়ে তার প্রতিটি কাজে প্রেরণার উৎস হয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে জাতির পিতার সঙ্গে বুলেটের নির্মম আঘাতে জীবন দিতে হয়েছে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে।
বঙ্গবন্ধু বেগম মুজিবকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। দেশের জন্য রাজনীতি করতে গিয়ে পরিবারের জন্য বিশেষ করে নিজের স্ত্রীকে যথেষ্ট সময় তিনি দিতে পারেননি। স্ত্রীর প্রতি জাতির পিতার ভালোবাসার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তার লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘রেণু তো নিশ্চয় পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরো বেশি ব্যথা লাগে।’
সারা জীবন শেখ মুজিবকে আগলে রেখেছেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বেগম মুজিবের গভীর ভালোবাসার কথাও উঠে এসেছে অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাতায়। বিদায় দেওয়ার একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রেণু আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় নীরবে চোখের পানি ফেলছিল। আমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম না, একটা চুমো দিয়ে বিদায় নিলাম। বলবার তো কিছুই আমার ছিল না, সবই তো ওকে বলেছি।’
বঙ্গবন্ধু বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, জেলণ্ডজুলুমের শিকার হয়েছেন; কিন্তু ভেঙে পড়েননি বেগম মুজিব, সব সময় জাতির পিতাকে সাহস জুগিয়েছেন। পরিবারের সদস্য ও দলের নেতাকর্মীদের আশ্রয়স্থল ছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব।
বিভিন্ন হামলাণ্ডমামলা, বিশেষ করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিষয়ে বেগম মুজিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। শেখ মুজিব যখন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে নেতাদের সঙ্গে বসতেন, বেগম মুজিব সব সময় খেয়াল রাখতেন কী সিদ্ধান্ত হচ্ছে। তিনি সময়মতো তার মতামত দিতেন; কিন্তু কখনো তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতেন না। তিনি তার বার্তাটি পৌঁছে দিতেন। মায়ের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘অসহযোগ আন্দোলনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে আমি দেখেছি মায়ের দৃঢ় ভূমিকা।’
বঙ্গবন্ধু জীবনে যত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছেন, সবটাতেই বঙ্গমাতা তাকে ছায়ার মতো সাহায্য করেছেন। তার উৎসাহে বঙ্গবন্ধু কারাগারে আত্মজীবনী লেখেন ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’। জাতির পিতার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক অজানা ইতিহাসের সম্ভার এ গ্রন্থ দুটি। বঙ্গবন্ধুর লেখা তৃতীয় বইয়ের নাম ‘আমার দেখা নয়াচীন’। তার আত্মজীবনী সংরক্ষণে বঙ্গমাতার ভূমিকা নিশ্চয়ই মনে রাখবে ইতিহাস। ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, তুমি তোমার মনের কথাই সেসময়ে বলবে। তোমার স্বপ্নের কথা বলবে।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণ। বঙ্গবন্ধু তার মনের কথাগুলো বলেছিলেন বলে আজ এটি শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় শ্রেষ্ঠতম স্থানে পৌঁছেছে। ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেসকো। এ ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে’ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
স্বাধীনতা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার এবং মুক্তিযুদ্ধের শুরু। তারপর এক রকম বন্দিজীবন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তিনি বিলাসী জীবনে ফিরে যেতে পারতেন; কিন্তু নিজের গড়া ৩২ নম্বরের বাড়িতেই থেকে যান। সারা জীবন ছায়ার মতো স্বামীর পাশেই ছিলেন। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি বলেছিলেন, ‘ওনাকে যখন মেরে ফেলেছো, আমাকেও মেরে ফেলো।’ প্রচারবিমুখ মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। পর্দার অন্তরালে থেকে দেশের স্বাধীনতাণ্ডসংগ্রামে নিরন্তর প্রেরণা জুগিয়েছেন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে ছায়ার মতো থেকে শক্তি তাকে জুগিয়েছেন। একটি স্বাধীন দেশের জন্য ইতিহাসের সঙ্গে যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেটা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। জাতির পিতার দীর্ঘ সংগ্রামে অনন্য ভূমিকার জন্য তিনি ক্রমেই হয়ে উঠেছেন বঙ্গমাতা।
এই মহীয়সী নারীর জীবন পরম গৌরবের। একদিকে তিনি জাতির পিতার পত্নী, শহীদ সন্তানদের জননী এবং দক্ষিণণ্ডপূর্ব এশিয়ার একজন শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও জন্মদাত্রী। তরুণ প্রজন্মের কাছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জীবন সংগ্রাম, শেখ মুজিবুর রহমানের কারাবাসকালে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংগঠিত করা এবং তার দেশপ্রেমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে আরো বেশি কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। আগামী ৮ আগস্ট মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯১তম জন্মদিবস। তার প্রতি রইল আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
munsurhelal70@ gmail.com
"