আসাদুল্লাহ আল গালিব

  ৩০ জুলাই, ২০২১

দৃষ্টিপাত

ইসলামে দান-সদকার গুরুত্ব ও ফজিলত

আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান তথা ইসলামে ফরজ বিধানের পাশাপাশি এমন কিছু আমল রয়েছে; যা করলে আল্লাহপাক দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মান-মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহর রাস্তায় দান-সদকা এই আমলগুলোর মধ্যে অন্যতম।

অসহায়, অসচ্ছল মানুষের সেবায় এগিয়ে আসা ইসলামে উল্লেখযোগ্য ইবাদতগুলোর একটি। আল্লাহ যাকে অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন তিনি সে সম্পদ থেকে অভাবী মানুষকে সাহায্য করলে তাতে আল্লাহতায়ালা খুশি হন। এ ধরনের মানবিক কর্তব্য পালন রাত জেগে অবিরাম নফল নামাজ আদায় ও অবিরত নফল রোজার সমতুল্য।

সদকা অর্থাৎ দান বান্দার প্রতি পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার অন্যতম নির্দেশিত বিধান। এর মাধ্যমে মানবজীবনের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ সাধিত হয়। সচ্ছল ও সামর্থ্যবান ব্যক্তি কর্তৃক অসচ্ছল এবং অসামর্থ্যবান ব্যক্তিকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় কিছু দান করাকে সদকা বলে। সদকা দুই ধরনের হতে পারে। ১. বাধ্যতামূলক, ২. ঐচ্ছিক। জাকাত ও ফিতরা বাধ্যতামূলক সদকা। এ ছাড়া অন্যান্য দান ঐচ্ছিক সদকার পর্যায়ভুক্ত। উভয় শ্রেণির সদকাই সওয়াবের হলেও কিছু পার্থক্য রয়েছে। বাধ্যতামূলক সদকা প্রদান না করা পাপ। যেমন বছরান্তে অবস্থিত সম্পদের মধ্য থেকে নির্ধারিত অংশ জাকাত প্রদান না করলে ওই সমুদয় সম্পদই অবৈধ হয়ে যায়। তখন ওই সম্পদ ভোগ করাও অবৈধ বা পাপ। আবার রমজানের রোজা রাখার পর রোজাদার ব্যক্তি যদি নির্ধারিত পরিমাণের ফিতরা প্রদান না করেন, তাহলে ওই রোজা অসম্পূর্ণ হয়ে থাকে। এ ধরনের সদকা প্রদানে ব্যর্থ হলে গুনাহ হয়। আর প্রদান করলে গুনাহ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। কিন্তু ঐচ্ছিক সদকা প্রদানে সওয়াবেরই অংশ বেশি। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে এটাই বলা যেতে পারে যে, বাধ্যতামূলক সদকার ব্যাপারে উদ্দেশ্য হলো গুনাহমুক্তি এবং ঐচ্ছিক সদকার ব্যাপারে উদ্দেশ্য সওয়াব অর্জন করা।

কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহপাক বান্দার আমলনামার হিসাব নেবেন, তখন যদি কোনো নেককার মুসলমানের ফরজ আমলের ঘাটতি হয়, সেসময় আল্লাহ ফেরেশতাদের বলবেন দেখো এই বান্দার কোনো নফল আমল আছে কি না, তখন ওই নফল আমলগুলোকে ফরজের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করে হিসাব করা হবে। দান-সদকা আমাদের আমলনামায় অতিরিক্ত নেকি যুক্ত করে। আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও পবিত্র রিজিক লাভের জন্য দান করা উচিত। এ ছাড়াও আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য, নবীজীকে অনুসরণের জন্য, নিজের মাল-সম্পদকে পবিত্র করার জন্য, মৃত্যুর পর সদকায়ে জারিয়ার নেকি লাভের জন্যও দান করা উচিত।

দান-সদকার ক্ষেত্রে নিয়তের বিশুদ্ধতার গুরুত্ব রয়েছে। দান হতে হবে স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। যদি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে, লোকমুখে প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্যে দান করা করা হয় অর্থাৎ নিয়ত যদি বিশুদ্ধ না থাকে, তবে আল্লাহপাক ওই দান-সদকা তো কবুল করবেনই না; বরং ওই ব্যক্তি পাপী হবে। কেননা ‘রিয়া’ তথা লোক দেখানো ইবাদত আল্লাহর কাছে খুবই ঘৃণিত একটি বিষয়। অধিকাংশ লোকের দান-সদকা বাতিল হয় শুধু এ কারণেই। সুতরাং অন্তরের খুলুসিয়াত তথা উদ্দেশ্য ও নিয়ত বিশুদ্ধ থাকতে হবে।

দান-সদকার ফজিলত সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিস এসেছে। একটি হাদিসে বলা হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণ সদকা করে আর আল্লাহ হালাল ব্যতীত অন্যকিছু গ্রহণ করেন না, আল্লাহতায়ালা ওই সদকাকে তার ডান হাতে গ্রহণ করেন এরপর তিনি তা লালন করেন, যেমন তোমাদের কেউ তার ঘোড়ার বাচ্চাকে লালন করে এমনকি একসময় সে সদকা পাহাড়তুল্য হয়ে যায়’ (বোখারি : ১৪১০)। অপর একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবু বকর (রা.)-এর খেলাফতকালে একবার দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়। খাদ্যদ্রব্য একেবারেই দুর্লভ হয়ে পড়ে এবং মানুষের দুঃখ-দুর্দশা চরম আকার ধারণ করে। সেসময় হজরত ওসমান (রা.)-এর প্রায় এক হাজার মণ গমের একটি চালান বিদেশ হতে মদিনায় পৌঁছাল। শহরের কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী হজরত ওসমান (রা.)-এর কাছে এলেন। তারা তার সব গমের চালান ৫০ শতাংশ লাভে ক্রয় করার প্রস্তাব দিলেন। সেই সঙ্গে তারা এটাও প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, তারা দুর্ভিক্ষপীড়িত জনগণের দুর্দশা লাঘবের জন্যই এই গম ক্রয় করতে চান। হজরত ওসমান (রা.) বললেন, ‘তোমরা যদি আমাকে এক হাজার গুণ লাভ দিতে পারো, তবে আমি দিতে পারি। কেননা অন্য একজন আমাকে ৭০০ গুণ লাভ দিতে চেয়েছেন।’

ব্যবসায়ীরা বললেন, ‘বলেন কী? চালান মদিনায় আসার পর তো আমরাই প্রথম এলাম আপনার কাছে। ৭০০ গুণ লাভের প্রস্তাব কে কখন দিয়েছেন?’ হজরত ওসমান বললেন, ‘এই প্রস্তাব আমি পেয়েছি আল্লাহর কাছ থেকে। আমি এই চালানের সব গম বিনামূল্যে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করব। এর বিনিময়ে আল্লাহ আমাকে সাতশ গুণ বেশি পুণ্য দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’

হজরত সোলায়মান (আ.)-এর যুগের একটি ঘটনা। জনৈক এক ব্যক্তির বাড়ির পাশে ছিল একটি গাছ। সেই গাছে ছিল একটি পাখির বাসা। সেই বাসায় পাখিটি যখনই ডিম দিত, তখনই লোকটি তা নিয়ে খেয়ে ফেলত। লোকটির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এক দিন পাখিটি হজরত সোলায়মান (আ.)-এর কাছে অভিযোগ করল। সোলায়মান (আ.) লোকটিকে ডেকে নিষেধ করে বললেন, আর কোনো দিন যেন ওই পাখির ডিম সে না খায়। হজরত সোলায়মান (আ.)-এর নিষেধ অমান্য করে লোকটি আবারও পাখির ডিম খেয়ে ফেলল। নিরুপায় হয়ে পাখিটি পুনরায় হজরত সোলায়মান (আ.)-এর কাছে অভিযোগ করল। সোলায়মান (আ.) এক জিনকে নির্দেশ দিলেন লোকটি এবার যখন গাছে চড়বে, তখন খুব জোরে তাকে ধাক্কা দিয়ে যেন নিচে ফেলে দেয়, যাতে লোকটি আর কোনো দিন গাছে চড়তে না পারে। এরপর এক দিন লোকটি পাখির ডিমের জন্য গাছে উঠতে যাবে, এমন সময় এক ভিক্ষুক এসে হাঁক দিল বাবা! কিছু ভিক্ষা দিন। তখন লোকটি প্রথমে ভিক্ষুককে এক মুষ্টি খাবার দান করল। তারপর শান্ত মনে গাছে থেকে ডিম নামিয়ে খেয়ে ফেলল। পাখিটি আবার সোলায়মান (আ.)-এর কাছে অভিযোগ করল। সোলায়মান (আ.) সেই জিনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নির্দেশ পালন করলে না কেন? তখন জিন জবাব দিল, আমি আপনার নির্দেশ পালন করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। এমন সময় পূর্ব ও পশ্চিম থেকে দুজন ফেরেশতা এসে আমাকে অনেকদূরে ফেলে দিল। সোলায়মান (আ.) বিস্মিত হয়ে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন, জিনটি বলল, আমি দেখলাম, লোকটি গাছে ওঠার আগে জনৈক ভিক্ষুককে এক মুষ্টি খাবার দান করল। সম্ভবত এর বরকতে আল্লাহপাক তাকে আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন। সোলায়মান (আ.) বললেন, হ্যাঁ সদকা বালা-মুসিবত দূর করে। এ কারণেই সে তখন মহাবিপদ থেকে বেঁচে গেছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে, আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করলে স্বয়ং আল্লাহ সেই ব্যক্তির হেফাজতকারী হয়ে যান।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সমাজে সেই মানুষেরই একটা অংশ গরিব-দুস্থ। তারা আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গরিব-দুস্থসহ সমাজের আশ্রয়হীন, দুর্বল ও অসহায় মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করা ইসলামে অন্যতম ইবাদত। অসচ্ছল, বিপদগ্রস্ত এবং অভাবী মানুষের সাহায্যে কেউ এগিয়ে এলে

আল্লাহ খুব খুশি হন। তাই গরিব-অসহায়, দুস্থের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা প্রদর্শন ও সহানুভূতিশীল হওয়া অত্যাবশ্যক।

ভ্রাতৃত্বের নৈতিক ও মৌলিক দাবি হলো, একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, বিপদাপদে একে অপরের পাশে দাঁড়ানো এবং একে অন্যের প্রতি সহায়তা ও সহমর্মিতার হাত

প্রসারিত করা। তবেই আল্লাহর নৈকট্য ও বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করা সম্ভব হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close